পদাতিক: ‘বামপন্থী নীতির প্রশ্নে আপসহীন, ব্যক্তিগত আদর্শের ক্ষেত্রেও অবিচল’। ছবি আপিলা-চাপিলা (আনন্দ) থেকে
অশোক মিত্র চলে যাওয়ার খবরে মনটা খারাপ হল। সত্তরের দশকের অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে এবং পরবর্তী কালে পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তথা দেশের এবং বিশ্বের চত্বরে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান তাপ-উত্তাপের সাক্ষী হিসেবে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতেই এই লেখা। আমার সঙ্গে বিভিন্ন সূত্রে তাঁর পরিচয় ছিল। কিন্তু সে পরিচয় হয়েছে ১৯৮১ সালে আমার বিদেশ যাত্রার পরে। পরে কলকাতায় থাকাকালীন কোনও কোনও সময়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু নিছক স্মৃতিচারণা আমার উদ্দেশ্য নয়।
ছোটবেলা থেকে গ্রামে ও মফস্সলে বড় হওয়ার সুবাদে বুঝতে শিখেছিলাম, পাড়ায় অত্যন্ত সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করেন এমন কোনও মানুষ, বা সর্বদা লোকের উপকারে এগিয়ে আসেন এবং নিতান্তই স্বার্থহীন চরিত্রের অধিকারী, এমন কেউ কেউ ‘কমিউনিস্ট’ বলে পরিচিত, যেমন কিছু ক্ষেত্রে আদ্যোপান্ত খাদি-নির্ভর তেমনই কোনও মানুষ ‘গান্ধীবাদী’ বলেও পরিচিত হতেন। শৈশবের নিষ্কলুষ মনে এঁদের ছাপ পড়ে যেত। সময় গড়িয়ে গেল, অল্প দিনের ছোটবেলা শেষ হয়ে দীর্ঘস্থায়ী বড়বেলার শুরু হল। পশ্চিমবঙ্গে বাম শাসনকালের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকের চরম অন্যায়-অবিচারের ফলে পরিবর্তন এল। স্বাভাবিক ভাবে অনেকে সময় বুঝে আত্মসমালোচনার পথ ধরলেন। অশোক মিত্র মশাই ছিলেন ব্যতিক্রম। মাঝে মাঝে তাঁর লেখা পড়ে খুবই রাগ করেছি, আমার মতের সঙ্গে খাপ খায়নি বলে, কিন্তু জানতাম শুধু বামপন্থী নীতির প্রশ্নে তিনি যে আপসহীন ছিলেন তা নয়, ব্যক্তিগত আদর্শের ক্ষেত্রেও তিনি অবিচল ছিলেন। শুধু রাজনীতির স্বার্থে নয়, অন্তর্দলীয় ক্ষুদ্র ও সঙ্কীর্ণমনা রাজনীতি এবং শিক্ষায় সংস্কৃতিতে তাঁর চেয়ে অনেক খাটো কিছু মানুষের রাজনৈতিক খবরদারি সহ্য করবেন না বলেও তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করেছিলেন। চেয়ারের লোভে নিজের আত্মাকে বিসর্জন দেওয়া যায়, এ কথা তিনি বিশ্বাস করতেন না। সারা জীবনে সেটা তিনি প্রমাণ করেছেন। তাঁর ইংরেজি-বিরোধিতাকে মানতে পারিনি, কিন্তু এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, লোকঠকানো সারদা কেলেঙ্কারির পূর্বসূরি এক কেলেঙ্কারিকে কঠোর হস্তে তিনিই দমন করেছিলেন। তাতে তাঁর ক্ষতিও হয়েছিল— ক্ষমতার অলিন্দে খানিকটা ব্রাত্য হয়েছিলেন, কিন্তু আমরা তাঁকে অভিবাদন করেছি।
আমি কেন সাম্যবাদ বা কমিউনিজম পছন্দ করি না সেটা লেখার জায়গা এই লেখা নয়। তা ছাড়া আমার পছন্দের উপর কিছু নির্ভর করে না। পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে বড় বেশি কচকচি হয়, সেটা হয়তো ট্র্যাডিশনের ফল। যদি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ইংরেজি পরিভাষা ‘পলিটিক্স অব দ্য রাইট’ হয়, তা হলে বলতে পারি, ‘রাইট’ কথাটাকেও তো ‘সঠিক’ সম্মান দেওয়া যায়! তবে একটা কথা জানিয়ে রাখি, দক্ষিণমুখী অর্থনীতির এক জন বিশেষ ভক্ত হলেও আমার বন্ধু এবং ঘনিষ্ঠদের তালিকায় বামপন্থীদেরই ভিড় বেশি। বলা বাহুল্য, তাঁরা কেউই বহুরূপী নন।
অশোকবাবুর খুব কাছের বন্ধু কবি অরুণ সরকারের পুত্র আমেরিকায় আমার রুমমেট ছিলেন। অরুণবাবুর অকালপ্রয়াণের পরে অশোকবাবুই আমার সেই অগ্রজপ্রতিম বন্ধুর অভিভাবকসম ছিলেন, প্রতি সপ্তাহে চিঠি দিতেন, এবং চিঠির শেষ লাইনে আমারও কুশলকামনা থাকত। এর কিছু দিন বাদেই তাঁর আর এক ঘনিষ্ঠ, এক কালে ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার সম্পাদকের কন্যার বিবাহের ব্যাপারে আমার বন্ধু সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য অশোক মিত্র মশাই আমাকে বলেছিলেন। মজার ব্যাপার, আমার সেই মুসলিম বন্ধুটির পরিবারও একই সময় কন্যাটির ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে অনুরোধ করেছিলেন। এ রকম টুকিটাকি ব্যাপারে খানিকটা যোগাযোগ ছিল।
নব্বইয়ের দশকে এক বার বিদেশযাত্রার সময় দমদম বিমানবন্দরে তাঁর সঙ্গে দেখা। তত দিনে উদারপন্থী আর্থিক সংস্কার শুরু হয়েছে পুরো দমে। আর এই পত্রিকায় লেখা এবং আমার নিজের গবেষণার খানিকটা পরিচিতির ফলে আমি যে উদার অর্থনীতির একনিষ্ঠ ভক্ত সেটাও অনেকেই জানেন। এমতাবস্থায় দেখা হতেই তিনি বললেন, ‘আপনারা তো এখন সতত উড্ডীয়মান’— উনি সবাইকেই আপনি বলতেন। ব্যাগ থেকে আমার সদ্য প্রকাশিত ‘জার্নাল অব ডেভেলপমেন্ট ইকনমিক্স’-এর একটি লেখার প্রতিলিপি তাঁকে দিলাম। লেখাটি পুরনো প্রযুক্তি আমদানির সমস্যা সম্পর্কে। বললাম, ‘‘সময় পেলে পড়বেন।’’ একই প্লেনে যাত্রা শুরু। উনি লেখাটি খানিকটা পড়ে দু’একটা প্রশংসাসূচক মন্তব্য করলেন বটে, কিন্তু আমার মনমোহন-অনুরাগকে খোঁচাও মারলেন, আবার এই ধরনের গবেষণা যে মূলধারার অর্থনীতিকে বাস্তবের কাছাকাছি আনছে তা নিয়ে আলোচনাও হল।
কেটে গেল অনেক দিন। বাংলায় মমতা সরকার এল। এই সময়েই তাঁর সঙ্গে অনেক দিন বাদে আবার যোগাযোগ হল। এক দিন এই পত্রিকায় একটি লেখা বেরোনোর পর হঠাৎ ফোন পেলাম। উনি যা বললেন তার সারমর্ম, ওঁর ভাষাতেই বলছি, ‘‘দেখুন, আপনার লেখার বিরুদ্ধে সাধারণত আমার অনেক বক্তব্য থাকে এবং আমি আপনার মত পছন্দ করি না। কিন্তু আজকের লেখাটি পড়ে খুব ভাল লাগল, তাই ফোন করলাম।’’ বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোনটি রেখে দিলেন। যত দূর মনে পড়ে, উন্নয়ন বলতে শপিং মল আর গগনচুম্বী অট্টালিকা বোঝায় না, নিম্নবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষার পূরণ বোঝায়, এই গোছের কিছু একটা বলা ছিল সেই লেখায়।
ইদানীং অশোকবাবু একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেছিলেন। পত্রিকাটি মাঝে মাঝে পড়েছি, তাতে বামপন্থী মেধাবী বুদ্ধিজীবীরা অনেক লেখেন। বামপন্থী রাজনীতির চরম দুর্দিনে বিভিন্ন ধরনের বা মতের বামপন্থী লেখক, অধ্যাপকরা একত্র হয়ে এই পত্রিকাটিতে লিখে থাকেন বলে আমার ধারণা। অশোক মিত্র মশাইয়ের এই প্রচেষ্টা ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং বামপন্থী চিন্তাধারার মূলস্রোতকে অন্তত বাংলায় জিইয়ে রাখার একটি সুপ্রচেষ্টা। ক্ষমতাসর্বস্ব এবং ‘আখের গোছানো’ বামপন্থী রাজনীতি মানুষের কাছ থেকে দূরে সরতে সরতে এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে বামপন্থায় আদর্শগত আনুগত্যের পরিসরও কেমন যেন হতাশায় ভুগছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই পত্রিকাটিতে মতানৈক্য ভুলে এক ধরনের বৌদ্ধিক সংহতির সৃষ্টি হচ্ছে। হয়তো অনধিকার চর্চা করছি, কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, বৌদ্ধিক চেতনার ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়ে সর্বক্ষণ হা-হুতাশ করা বিশেষ শ্রেণির মানুষদের শোভা পায় না। তবে বুদ্ধিচর্চার এই প্রয়াস ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে কতটা সফল হবে তা জানা নেই।
অশোক মিত্রের মতো মানুষ সমাজ, রাজনীতি, শ্রেণিসংগ্রাম, সব বিষয়েই আগামী প্রজন্মকে চিন্তার খোরাক জুগিয়ে যান। এটাই তাঁদের মাহাত্ম্য এবং আপসহীন চরিত্রের ধর্ম। ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে নীতির কথা বলে যাওয়া এবং আদর্শকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা এক ধরনের বিশিষ্ট চেতনার বহিঃপ্রকাশ। অন্য দিকে, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ক্ষমতা ত্যাগ করলে আরও একটু উন্নততর দেশ বা সমাজ গঠনই বা হবে কী করে? আদর্শ আর খানিকটা ক্ষয়ে-যাওয়া সমাজের উপকারসাধনের মধ্যে চিরকালই একটা সংঘাত চলতে থাকে। আপস বা সমঝোতা ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনীতিতে আমরা পড়েছি, স্পেশালাইজেশন দরকার। সবাই যদি দিনরাত চেয়ার আঁকড়ে ধরে বসে থাকেন তা হলে অপ্রিয় কটুকথা বলবে কে? কে-ই বা মৃতপ্রায় বিবেককে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবে?
মতাদর্শ, মতবাদ, বিশ্বাস, এ সব নিয়ে সংঘাত চলতেই থাকবে। সেটা মূলত বৌদ্ধিক সংঘাত। কিন্তু দলমতনির্বিশেষে কিছু মানুষ আদর্শ নিয়ে, পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়ন নিয়ে, এবং ক্ষমতার লোভে আত্মজলঞ্জলি দেওয়া মানুষদের এক হাত নিয়ে দু’চার কথা লিখবেন এবং বলবেন, এটাও ভীষণ জরুরি। শত দুঃখকষ্ট জ্বালাযন্ত্রণা সত্ত্বেও সব মানুষের মনে কোথাও এক ধরনের আপসহীনতার, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধাচরণের বীজ লুকিয়ে থাকে। দৈনন্দিন সংগ্রামে দীর্ণ মানুষ অনেক কিছু মেনে নিতে বাধ্য হয়। অশোক মিত্রের লেখায় অনেক সময় ক্রোধের মাত্রা বড় বেশি, কিন্তু সে লেখা দু’নৌকোয় পা দেওয়া লেখা নয়।
পরিশেষে আবার এ-যাবৎ-উত্তর-না-পাওয়া একটা প্রশ্ন মাথা চাড়া দিচ্ছে। চিরকাল যাঁরা শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলে এলেন, তাঁদের কেউ কেউ নিজেরাই একটা শ্রেণি, যে শ্রেণিতে জায়গা পায় এমন লোকের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য। এই শ্রেণিতে বাম-ডান-মধ্য সহিষ্ণু-অসহিষ্ণু সব মতেরই লোক থাকেন। এঁদের মেধা, মত প্রকাশের ক্ষমতা, যুক্তিবিন্যাসের ধার, সবই সাধারণের চেয়ে অনেক অনেক উপরে। সমমতাবলম্বী অনেক নিম্নতর মেধার আদর্শহীন মানুষদের সঙ্গে এঁদের ওঠাবসা। ‘শ্রেণিসংগ্রাম’-এর এই চেহারাটা হয়তো কোনও দিন পাল্টায় না। আর, এঁরা চলে গেলে সেই জায়গাটা চট করে পূর্ণ হওয়ারও নয়।
সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক