জয়ন্ত সিন্হার বিতর্কিত ছবি।
বিহার পুলিশের ডিজি গুপ্তেশ্বর পান্ডে মন্তব্য করিয়াছেন, অপরাধীদের ফুল-মালা দিয়া বরণ করাই যেখানে রেওয়াজ, সেইখানে অপরাধের সংখ্যাবৃদ্ধি লইয়া অভিযোগ করা চলে না। সত্য, বর্ণ-ধর্ম-রাজনীতির নামে যে ভাবে অপরাধীরা জনপুষ্টি লাভ করেন, নায়ক রূপে পূজিত হন, তাহাতে অপরাধ ঠেকাইবার কথা বলা ভাবের ঘরে চুরি। গণপিটুনিতে অভিযুক্ত আট ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পাইবার পর মালা পরাইয়া তাঁহাদের স্বাগত জানাইয়াছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়ন্ত সিন্হা, এবং সেই ঝাড়খণ্ডেই গত মাসে খুনে অভিযুক্ত এক ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মঞ্চে আবির্ভূত হইতে দেখা যায়। এই শাসনকর্তারাই কিন্তু অপরাধের বিরুদ্ধে লড়িবার অঙ্গীকার করেন, জনতাকে সেই দায়িত্বে উদ্বুদ্ধ করেন। বস্তুত, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে জয়ী সাংসদের পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশির নামে ফৌজদারি অভিযোগ আছে। এবং, বহু ক্ষেত্রেই অভিযোগ গুরুতর। ২০০৯ সালের তুলনায় সংখ্যাটি কার্যত দ্বিগুণ হইয়াছে। দলীয় টিকিটে জয়ী, কাজেই তাঁহাদের পিছনে যে রাজনৈতিক সমর্থন আছে, তাহা অনস্বীকার্য। তাহার পর কর্তারা অপরাধ দমনে কঠোর হইবার কথা বলিলে নিন্দুকে বলিবে, ইহা চোরকে চুরি করিতে বলিয়া গৃহস্থকে সতর্ক থাকিবার পরামর্শ দেওয়ার ন্যায় তঞ্চকতা।
মহিলাদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের ঘটনাতেও রাজনীতির যোগ অতি প্রকট। কাঠুয়ায় আট বৎসর বয়সি গুর্জর-বাখরেওয়াল সম্প্রদায়ের বালিকাটির ধর্ষকদের প্রকাশ্যে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়াছিলেন বিজেপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। উন্নাওয়ের কুখ্যাত কুলদীপ সিংহ সেঙ্গারও বহু দিন অবধি রাজনৈতিক মদত লাভ করিয়াছিলেন। ধর্ষণে অভিযুক্ত নেতা জেল হইতে ছাড়া পাইলে সমর্থকেরা জয়মাল্য হাতে তাঁহাকে বরণ করিতে যান, এই দৃশ্য ভারতে অতিপরিচিত। রাজনীতির এই যোগ ধর্ষণের ন্যায় মারাত্মক অপরাধকেও কার্যত ‘স্বাভাবিক’ করিয়া তোলে। রাজনীতির বদান্যতাও অন্য বহু অপরাধও ‘স্বাভাবিক’ হইয়া উঠিয়াছে। খুনজখম হইতে অবৈধ খাদানের ব্যবসা, চোরাচালান হইতে বেআইনি নির্মাণ— সব অপরাধই এখন ভারতে স্বাভাবিক। রাজনৈতিক নেতারা তাহা করিয়াই থাকেন, এবং ক্ষমতা থাকিলে সেই সব কাজ করাই যায়— ভারতের গণ-মানসিকতায় এই কথাটি গাঁথিয়া গিয়াছে। বস্তুত, যে কোনও অপরাধ করিয়া রাজনীতির স্নেহাঞ্চলে আশ্রয় লওয়াই এখন ভারতে দস্তুর। অপরাধের বিরুদ্ধে লড়িবার পথে এই মানসিকতাটি এক পর্বতপ্রমাণ বাধা।
নিষ্কৃতির পথ কঠিন, তবে অসম্ভব নহে। অপরাধ যে গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না, এবং অপরাধী যে সামাজিক সম্মানের দাবিদার হইতে পারে না, এই কথাটি সমাজকে বুঝাইয়া দিতে হইবে। সেই দায়িত্ব মূলত রাজনীতির। ভারতীয় সমাজ বহুলাংশে রাজনীতি-নির্ভর— রাজনৈতিক দল যে পথে চালায়, সমাজ এখনও সেই পথেই চলিতে অভ্যস্ত। ফলে, নেতা হিসাবে অথবা অন্য কোনও কারণে কোনও অপরাধী দলের নিকট যত গুরুত্বপূর্ণই হউক না কেন, তাহাকে বিষবৎ বর্জন করাই কর্তব্য। রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের সামাজিক কর্তব্য পালন করে, এমন দাবি করিবার উপায় নাই। কিন্তু, অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে, এই কর্তব্যে গাফিলতি করিলে ইতিহাস তাহাদের ক্ষমা করিবে না।