মর্মান্তিক পথ-দুর্ঘটনায় মৃত শিল্পী কালিকাপ্রসাদের গাড়িচালক অর্ণব ঘোষের মা এমন একটি প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছেন এই সমাজকে, এই প্রশাসনকে, যাহার সূত্রে এক এক করিয়া আরও অনেক জরুরি, অত্যন্ত জরুরি প্রশ্ন ভিড় করিয়া আসিয়া পড়ে। দুইটি একই ধরনের দুর্ঘটনায় কেন দুই রকম বিচার, তাহার জবাব পুলিশ-প্রশাসনকে দিতে হইবে বইকী। প্রথম দুর্ঘটনার পর গাড়িচালক অর্ণব এখনও জামিন-অযোগ্য ধারায় জেলের অভ্যন্তরে, অথচ দ্বিতীয় দুর্ঘটনার পর গাড়িচালক তারকা বিক্রম মুক্তবিহারী। গণতান্ত্রিক দেশে এই বৈষম্য কোন যুক্তিতে, ইহা প্রথম প্রশ্ন। পুলিশ এক এক ক্ষেত্রে এক এক রকম ধারায় অভিযোগ আনিবার অধিকারী কেন, ইহা দ্বিতীয় প্রশ্ন। দেশের আইনকানুন অনুযায়ীই পুলিশের চলিবার কথা, পুলিশের মর্জিমাফিক আইন চলিবার কথা নহে। পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু বারংবার এই অভিযোগ ওঠে যে, আইন কাহার ক্ষেত্রে কী বলিবে, তাহা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবে স্থির হয়। অর্ণবের জননী সামাজিক উচ্চাবচতার কথা তুলিয়াছেন ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিষয়টি শুধু ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানের বিষয় নয়, রাজনৈতিক প্রভাব কে খাটাইতে পারে, কে পারে না, সেই বিষয়। সুতরাং তৃতীয় প্রশ্ন: যে রাজ্যে আইন এবং বিচার রাজনৈতিক প্রভাবসূত্র ধরিয়া চলে, সেখানে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার অবসিত বলিয়াই তবে ধরিয়া লওয়া হউক?
শাসনবিভাগের পক্ষপাতদুষ্টতার আশঙ্কা প্রবল বলিয়াই মহামান্য আদালত হয়তো বিবেচনা করিতে পারেন, তাঁহাদের আরও বেশি কঠোর হওয়া প্রয়োজন কি না। কোনও অভিযুক্তকে যদি পুলিশ গিয়া অন্যায় ভাবে বলে যে, তাহার বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় অভিযোগ আছে, অমনি তাহাই সাব্যস্ত হইবে? সত্যই তাহার বিরুদ্ধে যে ধারা আনা হইয়াছে, তাহা ন্যায্য কি অন্যায্য, তাহার বিবেচনা হইবে না? গণতন্ত্রের বহুশ্রুত, বহুচর্চিত চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস-এর ব্যবস্থা কি পশ্চিমবঙ্গে আজ উবিয়া গিয়াছে? সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহের প্রেক্ষিতে প্রশাসনকে জিজ্ঞাসা— গাড়ির দুর্ঘটনা হইলে তাহার চালককে, কিংবা গণতান্ত্রিক মতে বিক্ষোভ-আন্দোলন হইলে তাহার অংশগ্রহণকারীদের যদি অনবরত জামিন-অযোগ্য ধারায় জেলে আটকাইয়া রাখা হয়, তাহা হইলে ঠিক কোন ক্ষেত্রে জামিনের যোগ্য ক্ষেত্র বলিয়া বিবেচিত হইবার কথা? দুর্ঘটনা যে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা নয়, কিংবা মানবাধিকার আন্দোলন যে খুনখারাপি-ধর্ষণের তুল্য নয়, তাহা তো শিশুরাও জানে। তবে, অবশ্যই, শিশুরা ইহা জানে না যে, এ রাজ্যে তাহাদের সারারাতব্যাপী গণধর্ষণের শিকার হইতে হইলেও অপরাধীদের গ্রেফতারের, এমনকী অনুসন্ধানের, ব্যবস্থা হয় না। আইনের শাসন এ রাজ্যে ক্ষেত্রবিশেষে এতটাই অন্ধ, বধির এবং পঙ্গু।
আসল কথা, পুলিশ-প্রশাসনের অকর্মণ্যতার মধ্যে একটি ব্যবহারিক অনৈতিকতা প্রাত্যহিক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। জামিন বিষয়টিকে গুরুত্ব-সহকারে না লইবার অনৈতিকতা। জামিন কিন্তু পুলিশ কর্তাদের মেজাজমর্জির বিষয় নয়, ইহা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বসবাসকারী নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। অভিযুক্ত যতক্ষণ পর্যন্ত না অপরাধী হিসাবে বিচারে সাব্যস্ত, তত ক্ষণ পর্যন্ত অভিযুক্তও এক জন নিরপরাধ নাগরিক মাত্র, তাঁহার নাগরিক অধিকার একই রকম অলঙ্ঘনীয়। সেই অধিকারে হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত যখন যাঁহারা লইবেন, তাঁহাদের কিন্তু সতর্ক থাকিতে হইবে: অধিকার লঙ্ঘনের দায়টি তাঁহারা আদালতে যুক্তিসহকারে প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবেন তো? জামিন-অযোগ্যতার বিষয়টি প্রশাসন দায়িত্ব লইয়া প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবে তো? পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন ঠিক উল্টা দিকে দৌড়াইতেছে।