ক্রমশ বিকল হইতেছে কলিকাতার বৃক্ক। অর্থাৎ পূর্ব কলিকাতার জলাভূমি। বেআইনি নির্মাণকার্যের গ্রাসে ক্রমশ ভরাট হইতেছে রামসার তালিকাভুক্ত অঞ্চলটি। এত কাল এই অভিযোগ ছিল পরিবেশবিদদের। সম্প্রতি রাজ্যের পরিবেশ দফতর জলাভূমি ভরাটের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করিয়া একটি তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে কার্যত সেই অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করিয়া লইল। মানিয়া লইল যে, গত এগারো বৎসরে জলাভূমি ভরাট করিয়া বেআইনি নির্মাণের অভিযোগে সাড়ে তিনশোরও অধিক এফআইআর দায়ের করা হইয়াছে। অথচ, কোনও ব্যবস্থা করা যায় নাই। বেআইনি নির্মাণও বন্ধ হয় নাই, বরং তাহা ক্রমশ বাড়িতেছে।
এই স্বীকারোক্তির মধ্যে অকর্মণ্যতার চিহ্ন প্রকট। সরকারের নিকট নিয়মিত অভিযোগ জমা পড়া সত্ত্বেও এত কাল ব্যবস্থা করা হয় নাই কেন? সদুত্তর নাই। অথচ জলাভূমিতে নির্মাণ লইয়া সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ রহিয়াছে, জলাভূমি সংরক্ষণ আইন রহিয়াছে, মুখ্যমন্ত্রীও যাবতীয় বেআইনি নির্মাণ ভাঙিয়া জলাভূমিকে পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া দিবার নির্দেশ দিয়াছেন। তবুও বেআইনি দখলদারদের রোখা যায় নাই। সাড়ে তিনশো এফআইআর দায়ের করা হইয়াছে, অথচ দায়িত্বপ্রাপ্তদের কেহ শাস্তির মুখে পড়েন নাই। কোনও জনপ্রতিনিধির শাস্তি হয় নাই। বেআইনি প্রোমোটাররা সরকারের নাকের ডগায় বসিয়া জলা ভরাট করিয়া, জমির চরিত্র বদল করিয়া বাড়ি, গ্যারাজ, দোকান নির্মাণ করিয়া ফেলিলেন, অথচ পুলিশ-প্রশাসন দর্শকের ভূমিকায়। কয় জন বেআইনি দখলদারকে জলাভূমি সংরক্ষণ আইনে গ্রেফতার করা হইয়াছে? হিসাব জানা নাই। অপদার্থতার নমুনা আরও আছে। জাতীয় পরিবেশ আদালত বিধাননগর পুরসভাকে জুন মাসের মধ্যে মোল্লার ভেড়ি ঘিরিয়া দিতে নির্দেশ দিয়াছিল। উপগ্রহ চিত্রে প্রকাশ, মোল্লার ভেড়ি হইতে বর্জ্য উপচাইয়া পূর্ব কলিকাতার জলাভূমির একাংশকে ভরাট করিতেছে। পুরসভা এত দিনেও সেই কাজ করিয়া উঠিতে পারিল না।
পরিবেশের প্রশ্নে এই সকল অপদার্থতার কোনও জায়গা নাই। সরকারের মনে রাখা প্রয়োজন, পূর্ব কলিকাতার জলাভূমি অঞ্চল শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক তকমাপ্রাপ্তই নহে, তাহা কলিকাতাকে এত কাল বাঁচাইয়া রাখিয়াছে। প্রায় ১২,৫০০ হেক্টর বিস্তৃত জলাজমিকে কলিকাতার বৃক্ক বলা হয়। শহর হইতে নিষ্কাশিত দূষিত জল এই অঞ্চলেই প্রাকৃতিক উপায়ে পরিশোধিত হয়। এবং সেই শোধিত জলে সবজি, মাছ চাষ করিয়া দিনাতিপাত করেন কৃষিজীবী এবং মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ। অথচ সেই অমূল্য সম্পদটিকে রক্ষা করিবার পরিবর্তে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে ঠেলিয়া দেওয়া হইতেছে। কংক্রিটের আগ্রাসনে সম্পূর্ণ নষ্ট হইতে বসিয়াছে জলাভূমির বাস্তুতন্ত্র। সরকারের উচিত অবিলম্বে বিশেষজ্ঞ পরামর্শমতো জলাভূমি সংরক্ষণের একটি রূপরেখা নির্মাণ। সঙ্গে যাহা ভরাট হইয়াছে, সেইগুলি চিহ্নিত করিয়া তাহাকে পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া দেওয়া। এবং আর একটি বেআইনি নির্মাণও যেন ওই অঞ্চলে হইতে না পারে, তাহা নিশ্চিত করা। আইন অমান্য করা হইলে অমান্যকারীর সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনকেও কড়া শাস্তি দিতে হইবে। যাহা হারাইয়াছে, তাহার সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধার হয়তো অসম্ভব। কিন্তু নিজ অস্তিত্বের স্বার্থেই অবশিষ্টাংশের সংরক্ষণ জরুরি।