কাশ্মীর যে এখনও ‘স্বাভাবিকতা’ হইতে বহু যোজন দূরে, গত মঙ্গলবারের ঘটনাবলি প্রমাণ করিল। দেখাইয়া দিল যে, বাহির হইতে আসা মানুষেরা এখন সে রাজ্যে বিশেষ ভাবে বিপন্ন। বাস্তবিক, কাশ্মীরে জঙ্গি হানা ও তাহার পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর গোলাগুলির সুদীর্ঘ ইতিহাসের সূত্রে অনেক সময়ই বলা হইত যে নিরাপত্তার সঙ্কটটি প্রধানত কাশ্মীরিদের, বাহির হইতে যাঁহারা সেখানে কাজ করিতে বা বেড়াইতে যান, তাঁহাদের বিপদ তুলনায় সামান্য। সাম্প্রতিক ঘটনা বুঝাইয়া দিল, পরিস্থিতি পাল্টাইতেছে, কাশ্মীর উপত্যকা এখন বাহিরের মানুষের পক্ষেও ভয়ঙ্কর। কেন হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গ হইতে কাজের সুবাদে সে রাজ্যে বাসরত কয়েক জন ব্যক্তি জঙ্গি আক্রমণের নিশানা হইলেন, বলা মুশকিল। ইহার মধ্যে ভারত সরকারের প্রতি কোনও বার্তা আছে কি না, না কি ইহা নির্ভেজাল দিশাহীন হানাদারি? প্রসঙ্গত, অক্টোবর মাসের চোদ্দো তারিখেই শোপিয়ানে এক ট্রাক-ড্রাইভারকে মারিয়া ট্রাকে আগুন ধরাইয়া দেওয়া হইয়াছিল— ড্রাইভার ছিলেন রাজস্থানের মানুষ। অর্থাৎ হানার লক্ষ্যবৃত্ত বর্ধিত হইতেছে। এই মুহূর্তে জম্মু ও কাশ্মীরের বাস্তব পরিস্থিতি ও মানসিক জগৎ দুই-ই দ্রুত পরিবর্তনশীল বলিয়া জনশ্রুতি। বহিরাগতদের উপর উপর্যুপরি আক্রমণ কী ভাবে সেই পরিবর্তনের সহিত যুক্ত, বা আদৌ যুক্ত কি না, তাহা একটি গুরুতর বিচার্য বিষয়। তিনশত সত্তর ধারা প্রত্যাহারের সঙ্গে এই জঙ্গি হানার কোনও সংযোগ আছে কি না, তাহাও বিচার্য। এই সব অনিশ্চিত বিচারের মধ্যে একটি বিষয়ই নিশ্চিত: শক্ত বাঁধনে কাশ্মীরকে বাঁধিয়া রাখিলেও ফস্কা গেরো দিয়া তাহার ‘অ-স্বাভাবিক’ পরিস্থিতি নিজেকে প্রকাশ করিতেছে।
অগস্ট মাস হইতে যে বাঁধন কাশ্মীরের উপর চাপিয়া বসিয়াছে, তাহার সূত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প হইয়া দাঁড়াইয়াছে— কাশ্মীর যে ক্রমশ স্বাভাবিকতার দিকে ফিরিতেছে তাহা প্রমাণ করা। সত্য বলিতে, ইউরোপের যে সফরকারী দলটিকে কাশ্মীর উপত্যকা ‘দেখাইতে’ লইয়া যাওয়া হইয়াছে, তৎসূত্রে বিশ্বদুনিয়াকে কাশ্মীরের ‘স্বাভাবিকতা’র ছবি পাঠানোই সফরের প্রধান লক্ষ্য। গত কয়েক মাসে একাধিক বার সরকারের বিভিন্ন মহল এ বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করিয়াছে। আরও একটি জঙ্গি হানা প্রকারান্তরে জোর বাঁধনকে সজোরতর করার পক্ষেও ব্যবহৃত হইতে পারে। আবার অন্য ভাবে দেখিলে, যে কোনও বাঁধন কাটিয়াই যে কাশ্মীরের ‘অসুখ’ নিজেকে প্রকাশ ও প্রচার করিবে, এই দুর্ভাগ্যজনক বার্তাও দিতে পারে। যে পথে দিল্লি কাশ্মীরকে বশে আনিবার পরিকল্পনা করিতেছে, জঙ্গিদের এক-একটি আক্রমণ এক নিমেষে সেই পথে অনেক দূর পিছাইয়া দিতে সক্ষম।
একমাত্র এক ভাবেই কাশ্মীরকে বশে আনিবার সম্ভাবনা ছিল— সেখানকার অধিবাসীদের সমর্থন ও সহানুভূতি সংগ্রহ। একমাত্র সেই পথে জঙ্গিদের ঠেকাইবার সুদূর আশা করা যাইত। কিন্তু তিনশত সত্তর ধারা রদের পদ্ধতি ও তৎপরবর্তী ঘটনাক্রম এই পথটি বহু কালের জন্য রুদ্ধ করিয়া দিল বলিয়া সন্দেহ হয়। সফরকারী দলের সাহেবরা কী দেখিবেন, কী বুঝিবেন, অর্থাৎ সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাঁহাদের কী দেখিতে-বুঝিতে দেওয়া হইবে, জানা নাই। কিন্তু সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যে কাশ্মীর, তাহার হাল আশাব্যঞ্জক নহে। বিরক্ত, বিপন্ন, অধিকার-রহিত উপত্যকাবাসীরা হয়তো জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ হইতে চাহেন না, হয়তো শুধু নিজ বাসভূমে নিজের মতো করিয়া বাঁচিতে চাহেন। কিন্তু তাঁহাদের জন্য বেশি পথ খোলা নাই। এক দিকে পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসবাদ, অন্য দিকে আত্মনিয়ন্ত্রণপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদ, এবং এই দুইয়ের মোকাবিলায় ভারত সরকারের কঠিন নিষ্পেষণ— কাশ্মীরিদের নিজের মতো করিয়া বাঁচিবার সুযোগ দ্রুত বিলীয়মান।