নগরায়ণ। নির্মীয়মাণ কসবা বাইপাস। সৌজন্য: কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট
কে সি শিবরামকৃষ্ণন ২৮ মে প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর কাজের পর্যালোচনা করে দিল্লির সংবাদপত্রে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছেন তাঁর এক বিশিষ্ট সহকর্মী, দিল্লিতে তাঁর স্মরণসভার আয়োজন হয়েছে। বাংলায় তাঁর মৃত্যুর খবরটাই থেকে গেছে
প্রায় অবিদিত। অথচ কলকাতা তথা আসানসোল-দুর্গাপুর অঞ্চল ছিল তাঁর প্রথম ও অন্যতম প্রধান কর্মক্ষেত্র, হাতেনাতে বাস্তব উন্নয়নের সবচেয়ে উজ্জ্বল স্বাক্ষর এখানেই তিনি রেখে গেছেন।
শিবরামকৃষ্ণন ছিলেন আইএএস আধিকারিক। কোনও একটি বিশেষ ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করে ধারাবাহিক ভাবে কাজের ও চিন্তার যে সুযোগ এখন প্রায় ইচ্ছা করেই আমলাদের দেওয়া হয় না, ষাট-সত্তরের দশকে তিনি সেটা পেয়েছিলেন। ক্ষেত্রটা ছিল নগর পরিকল্পনা। আসানসোল ও দুর্গাপুরের তৎকালীন উন্নয়ন সংস্থায় হাত পাকিয়ে ১৯৭১’এ তিনি সিএমডিএর প্রধান আধিকারিকের পদ গ্রহণ করেন।
উঁচকপালি মধ্যবিত্তের উপেক্ষা ও বিদ্রুপ সত্ত্বেও সেই যুগের সিএমডিএর কীর্তি গর্ব করার মতো। শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বের দরিদ্র দেশের শহরগুলি তখন (ও বহুলাংশে আজও) জনস্ফীতি, পরিকাঠামো ও কর্মসংস্থানের বিপুল সমস্যার ভারে ন্যুব্জ। অথচ সদ্য-স্বাধীন দেশগুলিতে এই সব শহর ঘিরে দেশবাসীর প্রচুর আশাভরসা, সুদিনের আবছা স্বপ্নে এখানেই তারা ভিড় জমাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের এই ‘প্রাইমেট সিটি’গুলির মধ্যেও কলকাতার অবস্থা ছিল সঙ্গিন। দেশভাগের পর পূর্ব ভারতে ঘটল সর্বদেশ সর্বকালের বৃহত্তম গণপ্রচরণ (ম্যাস মাইগ্রেশন)। তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হিসাব পেলাম শিবরামকৃষ্ণনেরই লেখায়: এক কোটি দশ লক্ষ। এর প্রবলতম ঢেউ আছড়ে পড়ল কলকাতায়। বৃহত্তর শহরাঞ্চলে জনসংখ্যা বাড়ল পঁচিশ বছরে প্রায় দ্বিগুণ, শহর ঘিরে গড়ে উঠল ছিন্নমূল মানুষে ঠাসা অভিশপ্ত ‘উদ্বাস্তু বলয়’। কেন্দ্রীয় সরকার তথা বাকি ভারত কিন্তু দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে। পঞ্জাবের সঙ্গে উৎকট বৈষম্যে সাহায্য মিলল ছিটেফোঁটা। নাগরিক পরিষেবা তলানিতে, শান্তিশৃঙ্খলা তথৈবচ। দানা বাঁধল হিংসাশ্রয়ী রাজনীতি। অগত্যা কিছু একটা করতে হল। ১৯৬১’তে গঠিত হল সিএমপিও, ১৯৭১’এ সিএমডিএ। দীর্ঘ বঞ্চনার প্রেক্ষিতে অ-পর্যাপ্ত হলেও কিছু অনুদান আসতে শুরু করল কেন্দ্র থেকে। যখন বাঙালি যুবকরা আইএএসে ঢুকলে অন্য রাজ্যে নিয়োগ খুঁজতেন, তখন সদ্য-স্থাপিত সিএমডিএর হাল ধরলেন এই দক্ষিণ ভারতীয় আধিকারিক। তাঁর নেতৃত্বে, এবং কিছু বিশিষ্ট প্রযুক্তিবিদ ও প্রশাসকের মিলিত প্রচেষ্টায়, গরিব দুনিয়ার নগরোন্নয়নে কায়রোর পাশাপাশি শীর্ষস্থান নিল কলকাতা।
পরবর্তী কালে শিবরামকৃষ্ণনের কর্মক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের নগরোন্নয়ন, বাণিজ্য ও পরিবেশ মন্ত্রকে তিনি বহাল ছিলেন। অবসরের পর ছিলেন বিশ্ব ব্যাঙ্কের পরামর্শদাতা, তার পর দিল্লির ‘সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ’-এর সদস্য। আট-দশটা মূল্যবান বই লিখেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, সারা জীবন নগর পরিকল্পনার উচ্চ দায়িত্ব পালন করেও এ বিষয়ে তাঁর ধারণা কোনও দিন ছকবন্দি হয়নি, জন্মায়নি আত্মতুষ্টি: শেষ অবধি তিনি নির্মোহ ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন নগরায়ণ নিয়ে প্রচলিত ভাবনা ও প্রশাসনরীতি।
আমার উদ্দেশ্য কিন্তু কেবল তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন নয়, আত্মসমীক্ষাও বটে। শ্রদ্ধার পালা আমাদের সমাজে বড় তরল, বড় চটুল হয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ থেকে শুরু করে প্রথম সারির মনীষীদের ঘিরে গান-ভাষণ-মিছিল-উৎসব, পাঁচমিশেলি প্রতিষ্ঠানের নামকরণের তোড়-হুজুগে শ্রদ্ধার নির্যাসটুকু ধুয়েমুছে গেছে। বর্তমানের দুদিনের নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে একের পর এক একরাত্রির অনুষ্ঠান, আর যাঁরা নক্ষত্রও নন, উল্কাও নন, মর্তলোকের আলো, একনিষ্ঠ কর্মদানে আমাদের দৈনন্দিন পথ আলোকিত করেন, তাঁদের জীবৎকালেও সেই রশ্মি আমাদের বড় খেয়ালে পড়ে না, মৃত্যুর পর আদৌ চোখে ভাসে না। তার একটা কারণ— না কি ফল?— এই যে, আমাদের সমাজে কিছু গড়ে তুললেও তা বাঁচিয়ে রাখা বড় কঠিন। পড়ে থাকে কেবল অনীহা ও বিস্মৃতি।
একটা অনুযোগ করতেই হয়। তথ্য পরিবেশন যে উদ্যোগের মূল লক্ষ্য, সেই সংবাদমাধ্যমগুলি এ বিষয়ে উদাসীন। একটা সময়ে খবরের কাগজে নিয়ম করে মৃত্যুসংবাদ বা ‘অবিচুয়ারি’ ছাপা হত। তাতে নেপথ্য বা মাঝারি মাপের তো বটেই, আরও সাধারণ কিন্তু কোনও কারণে স্মর্তব্য ব্যক্তিদের তিরোধানের খবর থাকত। থাকত তাঁদের জীবন ও কাজের বিবরণ, যা একত্র করেই প্রায় একটা চরিতাভিধান সংকলন করা যেত। বিদেশের সব নামী কাগজে এখনও এই রীতি; ভারতে কিন্তু কিছুদিন যাবৎ লোপ পেয়েছে। ক্ষীণদৃষ্টি মানুষ যেমন অতিকায় বস্তু ছাড়া দেখতে পায় না, আমাদের সংবাদমাধ্যমে রাজনীতি, খেলা, বিনোদন বা ক্বচিৎ অন্য ক্ষেত্রের তারকার মৃত্যুর পর কভারেজ-এর বান ডাকে; প্রচার বা জনপ্রিয়তায় যাঁরা এক ধাপও নীচে, তাঁরা থাকেন উপেক্ষিত। বড়জোর আত্মীয়বন্ধুরা বলে-কয়ে একটু উল্লেখের ব্যবস্থা করেন।
এতে আমরা কেবল তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি তা নয়, আমাদের সামাজিক দৃষ্টিটাই পালটে যাচ্ছে। আমরা ভুলে যাচ্ছি, আজও (বা যে কোনও কালে) কত গুণী ও নিষ্ঠাবান মানুষ সমাজে কত কিছু গড়ে তুলছেন, কত আবশ্যিক ব্যবস্থা চালু রাখছেন, আমাদের সামাজিক ও মানসিক জীবন সমৃদ্ধ করছেন। ভুলে যাচ্ছি, আমাদের জগৎটা চলমান থাকে ছোট-বড়-মাঝারি কত লোকের অবদানে, নাগরিককুলের যৌথ প্রচেষ্টায়। এক বার এই বোধটা জন্মালে আরও মনে হতে বাধ্য যে, তবে তো আমাদের সকলেরই সমাজে একটা সক্রিয় ভূমিকা আছে, সকলেই কিছু করে দেখাতে পারে।
এই উপলব্ধি না জন্মালে অনেক আপদ এড়ানো যায়, এই ভেবে সুখে থাকি, দেশোদ্ধার করবেন নেতারা, তাঁদের ক্লেদাক্ত কর্মকাণ্ড থেকে স্বস্তি জোগাবেন তারকার ঝাঁক। আমাদের কাজ টিভিতে তাঁদের কীর্তিদর্শন করা বা পছন্দসই পানীয় সহযোগে চর্চা করা। তার বদলে যদি শুনি আমাদের মতোই কোনও ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-শিক্ষক-আধিকারিক, করণিক-ব্যবসায়ী-গৃহবধূ মায় বেকার বাউণ্ডুলে, একটা কিছু করে দেখিয়েছেন, আমাদের উপরও তেমন করার তাগিদ জন্মায়, করছি না বলে একটা অস্ফুট গ্লানি বোধ হয়।
আর একটা দায় থাকে। তথ্যসন্ধানের, সচেতনতার দায়। শিবরামকৃষ্ণন যে কলকাতাবাসীর কাছে বিস্মৃত, তার কারণ আমাদের সরব শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজের শহর নিয়ে কখনওই তেমন মাথা ঘামায়নি, আজও ঘামায় না। কলকাতা নিয়ে আমাদের একমাত্র উচ্চারণ বন্ধ্যা ও প্রায়ই অজ্ঞ অভিযোগ-অনুযোগে। অভিযোগের কারণ আছে; কিন্তু এই মনোভাবের দ্বারা আমরা যেন সেই কারণগুলোকেই স্বীকৃতি দিচ্ছি, কর্তাদের গাফিলতি ও ভ্রষ্টাচারকে মিথ-এর স্তরে নিয়ে যাচ্ছি। কাল যদি মন্ত্রবলে শহরটা সুশৃঙ্খল ঝকঝকে হয়ে ওঠে, চায়ের আড্ডা জমবে কী নিয়ে? আমরাও কি রাস্তায় ময়লা ফেলে, দেরিতে অফিস গিয়ে নিজের কাছে জবাবদিহি করতে পারব?
আমাদের হেলদোল নেই বলেই উড়ালপুল-মেট্রোরেলের অর্ধাবয়ব ভ্রূণদশায় কঙ্কাল হয়ে রাস্তা ভেংচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের শাসককুল এই প্রকল্পগুলি রূপায়িত করেন বা করেন না তাঁদেরই স্বার্থ ও মর্জি অনুসারে, মানুষকে ব্যাখ্যা দিতে অবজ্ঞা বোধ করেন। তাঁদের অনুচরদের অবজ্ঞা আরও স্থূল ও হিংসাশ্রয়ী হবেই— জমি দখল, পুকুর ভরাট, নির্মাণদ্রব্যের লেনদেন সব বিষয়েই। তার প্রকোপে বিপন্ন হচ্ছে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি পর্যন্ত, যার পরিবেশবান্ধব বর্জ্যনিকাশের পদ্ধতি পৃথিবীতে অদ্বিতীয়, যা হতে পারত শহরের সবচেয়ে বড় নাগরিক গর্ব, অথচ আন্তর্জাতিক ‘রামসার’ ব্যবস্থাপত্রের আওতায় থাকা সত্ত্বেও যার অস্তিত্ব সংকটে। সংকটে আমাদের অস্তিত্ব, কারণ এই জলাভূমি ধ্বংস হলে কলকাতায় বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
এই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেই যেখানে আমরা উদাসীন, ইতিহাস নিয়ে যে হব তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। হাজারে এক জন উচ্চশিক্ষিত বাঙালি জানেন না বীরেন্দ্রনাথ দের নাম: দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ডাকে যিনি লণ্ডনের চাকরি ছেড়ে কলকাতা পুরসভায় যোগ দিয়েছিলেন, যাঁর নকশা মাফিক বিদ্যাধরীর বদলে কুলটিগাং নদীতে কলকাতার বর্জ্য জল প্রবাহিত করে শহরটাকে বাঁচানো গিয়েছিল।
অতএব আমার শেষ নিবেদন। কলকাতার উন্নয়নের ইতিবৃত্তেই নানা পর্যায়ে উঠে আসে বীরেন্দ্রনাথ, শৈবাল গুপ্ত বা শিবরামকৃষ্ণনের মতো প্রযুক্তিবিদ ও প্রশাসকের নাম। (জীবিত কারও কারও নাম করছি না, তাঁরা কুণ্ঠিত ও অন্তত একটি ক্ষেত্রে বিপন্ন হবেন বলে।) তাঁদের আমলেও নিশ্চয় রাজনৈতিক চাপ ছিল, খেয়োখেয়ি মারপ্যাঁচ ছিল, ছোটবড় নানা দুর্নীতি ছিল। তবু এমন পরিবেশ ছিল যাতে নিজেদের চিন্তা-পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন, কোনও রাজনৈতিক প্রভুর মুখাপেিক্ষর তাগিদ বোধ করেননি, কর্তৃপক্ষের সমর্থন পেয়েছেন, অন্তত বাধা অতিক্রম করতে পেরেছেন, একটা কর্মকাণ্ডের রূপকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। এমন দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক ভারতেও দু’একটি মিলবে, যেমন দিল্লি মেট্রোর রূপকার এলাত্তুভালাপিল শ্রীধরন। কিন্তু প্রশাসন এখন এতটাই নেতা-সর্বস্ব যে, আধিকারিকদের স্বাধীন পদক্ষেপের কথা কেবল শোনা যায় না তা-ই নয় (বরাবরই বিরল ছিল), তার সম্ভাবনাই যেন বিলুপ্ত।
কর্তাদের মানসিক বন্দিদশা, প্রজাদের? সমাজবিজ্ঞান ও সাধারণ বুদ্ধি বলে, দেশবাসী গণতন্ত্রের প্রথম পাঠ নিয়ে যথার্থ ‘নাগরিক’ হয়ে ওঠে স্থানীয় স্বশাসন অর্থাৎ পরিপার্শ্ব ও পুরব্যবস্থা ঘিরে। কূটনীতি বা অর্থনীতি না বুঝতে পারি, জল-নালা-রাস্তা-বিদ্যুৎ না বুঝলেই নয়। যারা কিঞ্চিৎ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছি, এগুলো নিয়ে লেখাপড়া ভাবনাচিন্তা কর্তব্য হিসাবেই নয়, বাঁচার তাগিদেও দরকার। তবেই গড়ে উঠবে সচেতন নাগরিক সমাজ, সম্ভব হবে সুষ্ঠু পুরসেবা। নইলে হড়প্পা-মহেঞ্জোদড়ো ইতিহাসের পাতায় বেঁচে থাকলেও আমরা তলিয়ে যাব বিস্মৃতির গহ্বরে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক