জেএনইউ-তে পড়ুয়াদের বিক্ষোভ
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নরেন্দ্র মোদীদের রাগ কেন, সেটা বরং বোঝা সহজ। কিন্তু, এই বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজনীতি, কোনওটার সঙ্গেই প্রত্যক্ষ যোগ না থাকা মধ্যবিত্তের জেএনইউ-এর ছাত্রদের ওপর এমন রাগের কারণ কী? ‘ছাত্ররা রোজগারের চেষ্টামাত্র না করে করের টাকায় সারা দিন রাজনীতি করে আর স্লোগান দেয়’— গত কয়েক দিনে ফেসবুকে বা হোয়াটসঅ্যাপে এমন কথা চোখে পড়েছে বহু বার। মুখোমুখি আড্ডাতেও বেশ কয়েক জন শুনিয়েছেন, ‘আমার দেওয়া করের টাকায় ওরা ফুর্তি করে বেড়াবে কেন?’ করের টাকায় তো কত কিছুই হয়— কর্পোরেটগুলো ভর্তুকি পায়; রিয়াল এস্টেট ক্ষেত্রের জন্য বেল-আউট প্যাকেজ হয়; নরেন্দ্র মোদীর বিজ্ঞাপনী প্রচার হয়; অসমে যে এনআরসি সম্ভবত বাতিল হবে, তার জন্যও ১,৬০০ কোটি টাকা খরচ হয়। হ্যাঁ, ভোটের আগে কৃষকদের ঋণমকুবও হয়। তার কোনটা ভাল কোনটা খারাপ, সেই তর্কে যাওয়ার দরকার নেই— কিন্তু, তার কোনওটাতেই চটে না গিয়ে জেএনইউ-এর ছাত্রদের পিছনে করের টাকা খরচে মধ্যবিত্তের এত গোসা কেন, এই প্রশ্নটা বেশ ভাবিয়ে তুলল।
লেখাপড়ার নামে দেখা নেই, খালি পলিটিক্স করে বেড়ায়, এমন ছেলেমেয়েদের দেখলে মধ্যবয়সি মধ্যবিত্তদের খানিক রাগ হয় ঠিকই। কিন্তু, সেই রাগের জোর কি এতই বেশি যে পুলিশের মার খেয়ে তাদের কারও মাথা থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে, কেউ কাঁধ ধরে বসে পড়েছে যন্ত্রণায়— এই দৃশ্যগুলো দেখার পরও মনে হতে পারে, বেশ হয়েছে? উঁহু, তেমনটা হয় শত্রুকে মার খেতে দেখলে। তা হলে জেএনইউ-এর ছেলেমেয়েরা মধ্যবিত্তের শত্রু? যাদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হল না কোনও দিন, যারা কখনও কোনও প্রত্যক্ষ ক্ষতি করল না— তাদের সঙ্গে শত্রুতার সম্পর্ক কি হয়? হতে পারে? এখানেই নরেন্দ্র মোদীদের মস্ত বড় জয়। গত চার-পাঁচ বছরে তাঁরা জেএনইউ-এর ছেলেমেয়েদের দেশের শত্রু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দিতে পেরেছেন।
কেন প্রয়োজন হল জেএনইউ-র ছাত্রদের গণশত্রু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার? অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রদের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থীদের যে লড়াই, জেএনইউ-এর সঙ্গে লড়াই কি তার চেয়ে তীব্রতর? গত চার-পাঁচ বছরের ঘটনাক্রমকে ফিরে দেখলে মনে হতে বাধ্য যে সত্যিই জেএনইউ আলাদা। আর খানিকটা আলাদা যাদবপুর। কেন আলাদা, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় তার একটা কারণ একেবারে স্পষ্ট করে দিয়েছে। সেখানে মুসলমান অধ্যাপক সংস্কৃত পড়াবেন, তার প্রতিবাদে একটা গোটা আন্দোলনই তৈরি হয়ে গেল। সব ছাত্র সেই আন্দোলনে ছিল না, সত্যি; বিরুদ্ধবাদী ছাত্ররা সেই মুসলমান অধ্যাপকের পাশে দাঁড়িয়ে পাল্টা আন্দোলন করেছে, তাও সত্যি; এবং তার চেয়েও বড় সত্যি হল, হিন্দুত্ববাদী ছাত্রদের এই আশ্চর্য দাবি আদৌ স্বপ্রবৃত্ত নয়, এর পিছনে অনেক বড় রাজনীতি আছে— কিন্তু, এটাও তো সত্যি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই এমন অভাবনীয় অন্যায় দাবি করেছে, করতে পেরেছে। অর্থাৎ, এমন দাবি করার পরিসর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিতে আছে। ঠিক এখানেই জেএনইউ আলাদা। অন্তত, চার বছর আগে অবধি আলাদা ছিল। মনের কোণে যে অন্ধকারই জমে থাকুক না কেন, চরমতম হিন্দুত্ববাদী কোনও ছাত্রও ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে বলার সাহস করত না যে মুসলমান অধ্যাপকের কাছে সংস্কৃত পড়ব না। এই কথাটা এতখানিই অবৈধ ছিল জেএনইউ ক্যাম্পাসে। কাজেই, জেএনইউ-কে দখল করতে হলে আগে তাকে ভাঙতে হবে, মোদীরা বিলক্ষণ জানেন।
শুধু মুসলমান অধ্যাপকের কাছে সংস্কৃত পড়ায় আপত্তিই নয়, হিন্দুত্ববাদী মনের অনেক কথাই জেএনইউ ক্যাম্পাসে উচ্চারণ করা যেত না। জাতপাতের কথা, মেয়েদের খাটো করে দেখার কথা, ভিন্ন যৌনতার মানুষদের হেয় করার কথা— বলা যেত না অনেক কিছুই। সেটা অকারণ নয়। যে ছাত্র-রাজনীতি নিয়ে এখন মধ্যবিত্তের গাত্রদাহ, সেই রাজনীতিই তৈরি করে দিয়েছিল এই সর্বজনীন উদারবাদী পরিবেশ। তৈরি করে দিয়েছিল একটা অদৃশ্য পাঁচিল— ক্যাম্পাসের বাইরে গোটা দেশ যখন প্রাণপণ দৌড়েছে পিছনের দিকে, বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস করে নিয়েছে রাষ্ট্রের তৈরি করা গালগল্প, জেএনইউ-এর পরিসর তখন নিজের উদারবাদকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল। দেখতে পেরেছিল বাইরের অন্ধকার, তাকে প্রশ্ন করতে পেরেছিল। ভারতের গণতান্ত্রিক পরিসরটার জন্য এই জেএনইউ কতখানি জরুরি, সেটা বোঝার জন্য দু’একটা উদাহরণই যথেষ্ট— অগস্টে যখন কাশ্মীরের দখল নিল কেন্দ্র, বিরোধী রাজনীতিকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল, কে আগে সমর্থন করতে পারেন এই সিদ্ধান্ত; নভেম্বরে যখন অযোধ্যার বিতর্কিত জমির অধিকার পেলেন কাল্পনিক রামলালা, বিরোধী রাজনীতি কার্যত টুঁ শব্দটি করল না। এটাই এখনকার ভারত— প্রতিবাদহীনতার মৃত্যু উপত্যকা— এখানে জেএনইউ-এর কণ্ঠস্বরের গুরুত্ব অসীম।
আর ঠিক সেই কারণেই জেএনইউ-এর দখল নেওয়া দরকার পড়েছে বিজেপির। কানহাইয়া কুমারদের দিয়ে যুদ্ধের শুরু— তার পর কখনও ক্যাম্পাসে কামান আর সাঁজোয়া গাড়ি বসানোর পরিকল্পনা হয়েছে, কখনও অধ্যাপকদের ডেকে বলে দেওয়া হয়েছে ক্লাসে রোলকল করতে, কখনও ক্যাম্পাসে ডাকা হয়েছে আধাসামরিক বাহিনী। এ সব করে ছাত্রদের মন পাল্টে দেওয়া যায় বলে মোদীরাও বিশ্বাস করেন না। কিন্তু, একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা যায়। কাশ্মীরের আজাদির পক্ষে স্লোগান দিতে গিয়ে, বা নিপীড়িত দলিতদের পক্ষে বিক্ষোভে পথে নেমে পুলিশের হাতে হেনস্থা হওয়ার আশঙ্কা যত বাড়ে, সেই রাজনীতির পথে হাঁটার সাহসও তত কমে। তত কম ছাত্রছাত্রী উদারবাদী রাজনীতির চত্বরে এসে দাঁড়ায়। বিজেপির কাছে এটা একটা মস্ত জয়, কারণ জেএনইউ-এর উদারবাদী রাজনীতির পিছনে টাকা নেই, বড় রাজনৈতিক দলের লোকবল নেই— তার পুরোটা দাঁড়িয়ে আছে ছেলেমেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ওপর। সেটা বন্ধ করে দিতে পারলেই ক্যাম্পাসের দখল নেওয়া সহজ হয়।
হঠাৎ করে হস্টেল খরচ বহু গুণ বাড়িয়ে দেওয়ার কারণও কি সেখানেই নয়? উচ্চশিক্ষা কেন সর্বজনীন হওয়া উচিত, তার খরচ কেন সবার নাগালের মধ্যে রাখতেই হবে, সেই আলোচনা হচ্ছে, হবে। জেএনইউ-তে ছাত্রপিছু ঠিক কত খরচ হয়, মোদীর বিজ্ঞাপনী প্রচারবাবদ খরচের তুলনায় সেটা ক’আনা— সেই হিসেবও দিচ্ছেন অনেকেই। পাশাপাশি শোনা যাচ্ছে একটা অন্য কথা— সবার জন্য পড়ার খরচ কম রাখতে হবে কেন? গরিবদের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা রাখলেই তো হয়। সত্যি কথা বলতে, তেমন স্কলারশিপ এখনও আছে। সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাইলে তার টাকার অঙ্ক বাড়াতেই পারে, বাড়াতে পারে প্রাপকের সংখ্যাও। হয়তো বাড়াবেও। গরিব ছাত্রের লেখাপড়া আটকে যাবে না টাকার অভাবে। কিন্তু, সেই সুযোগ তখন তার অধিকার থাকবে না, এটুকু নিশ্চিত। কারণটা খুব সহজ— যে কর্তৃপক্ষের হাতে যে কোনও সময় স্কলারশিপের টাকা বন্ধ করে তার পড়া থামিয়ে দেওয়ার অধিকার আছে, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা, পথে নামা, নামতেই থাকা মুখের কথা নয়। কেউ কেউ হয়তো পারবে, বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই পারবে না। অর্থাৎ, ক্যাম্পাসে সিআরপিএফ ঢোকালে যা ফল, গরিব ছাত্রদের স্কলারশিপের ওপর নির্ভরশীল করে তুললেও একই ফল— উদারবাদী রাজনীতির হয়ে পথে নামার মতো ছেলেমেয়ের সংখ্যা কমবে। তার চেয়েও বড় কথা, স্কলারশিপের বকলস যাদের গলায় ক্রমশ চেপে বসবে, জেএনইউ-এর রাজনীতির আসল জোর কিন্তু তারাই। হরেক ভাবে প্রান্তিক অবস্থান থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েরা। নিজেদের প্রান্তিকতার কথা তারা হাড়েমজ্জায় জানে। এই জানা ছাড়া রাজনীতি হয় না— উচ্চবিত্ত-বর্ণ তাদের সব সদিচ্ছা দিয়েও এই জানার জোরের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে না।
জেএনইউ তার রাজনীতি ধরে রাখতে পারবে, প্রাণপণে সেই কামনা করি, কিন্তু খুব আশার আলো দেখতে পাই না। বেশ কয়েক জন বন্ধু এখন জেএনইউ-এ পড়ান। তাঁদের কাছেই শুনি, অবিরত লড়াইয়ের ক্লান্তিতে কী ভাবে দুর্বল হচ্ছে ছাত্ররা। এক দিন হয়তো তাদের শেষ প্রতিরোধও ভেঙে পড়বে। অনলাইন মধ্যবিত্ত তাতে খুশি হবে নিশ্চয়। কিন্তু, তেমনই কোনও এক মধ্যবিত্তের ছেলে যদি সমকামী হয়? কোনও হিন্দু মধ্যবিত্তের মেয়ে যদি প্রেমে পড়ে গরিব মুসলমান ছেলের? পরশু যদি হিন্দুত্ববাদীরা এসে বাঙালির পাতের মাছটুকুও কেড়ে নিতে চায়? তখন লড়তে হবে তো? কাকে পাশে পাবেন তখন?
আজ যাঁরা অখণ্ড রাষ্ট্রবাদী, জাতীয়তাবাদী গল্পে যাঁদের রক্ত টগবগ করে ফোটে, কাল না হোক পরশুর পরের দিন তাঁদের অনেকেই টের পাবেন, সর্বাধিপত্যকামী রাষ্ট্র তত ক্ষণই ভাল, যত ক্ষণ অবধি তার ন্যারেটিভের সঙ্গে আপনার বিন্দুমাত্র বিরোধ নেই। যে মুহূর্তে আপনি ভিন্ন কথা বলবেন, যে মুহূর্তে আপনি বাধ্য হবেন রাষ্ট্রীয় গতিপথ থেকে সরে দাঁড়াতে, সেই মুহূর্ত থেকে আপনিও সেই সর্বাধিপত্যকামী রাষ্ট্রের শত্রু। কাজেই, রাষ্ট্রকে উদারবাদী রাখা, থাকতে বাধ্য করা শুধু জেএনইউ-এর ছেলেমেয়েদের জন্য জরুরি নয়, আমাদের সবার জন্য সমান জরুরি। ওরা আসলে সবার হয়ে লড়ছে।
এই কথাটা এক বার বুঝে নিলেই দেখবেন, জেএনইউ-কে আর শত্রু বলে মনে হচ্ছে না।