Jallianwala Bagh Massacre

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের শতবর্ষ: অনেক বেদনা আর প্রশ্ন জাগায়

১৯১৯-এর ১০ মার্চ যখন রাওলাট অ্যাক্ট চালু হল, তখন চিরকালের ব্রিটিশ-ভক্ত গাঁধী প্রথম বুঝলেন, ব্রিটিশরা ভারতীয়দের ঠকাচ্ছে। প্রথম মহাযুদ্ধে এত যে ভারতীয় ব্রিটিশদের হয়ে প্রাণ দিল, খিদমত খাটল, তার কোনও প্রতিদানই দিল না ব্রিটিশরা।

Advertisement

আশীষ লাহিড়ী

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ০২:১২
Share:

গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর কথায়, আমাদের দেশে ‘যদি কোনো একটা ভূমিখণ্ড, কোনো একটা স্থান, ইতিহাস বদলে দেওয়ার প্রতীক হয়ে উঠে থাকে, তো সেটা হল জালিয়ানওয়ালা। দু’হাজার বছর আগেকার গোলগোথা, সত্তর বছর আগের আউশভিৎস, ১৯৬০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভিল, ১৯৮৯ সালে চিনের তিয়েনআনমেন চক— এগুলো সবই একই গোত্রে পড়ে। এরা সকলেই ইতিহাস বদলে দিয়েছে।’

Advertisement

১৯১৯-এর ১০ মার্চ যখন রাওলাট অ্যাক্ট চালু হল, তখন চিরকালের ব্রিটিশ-ভক্ত গাঁধী প্রথম বুঝলেন, ব্রিটিশরা ভারতীয়দের ঠকাচ্ছে। প্রথম মহাযুদ্ধে এত যে ভারতীয় ব্রিটিশদের হয়ে প্রাণ দিল, খিদমত খাটল, তার কোনও প্রতিদানই দিল না ব্রিটিশরা। বিচারপতি স্যর সিডনি রাওলাট-এর মস্তিষ্কপ্রসূত ওই আইনে পুলিশকে যে-ক্ষমতা দেওয়া হল, তা পড়লে এখনকার ‘আর্বান নকশাল’দেরও হাড় হিম হয়ে যাবে। খবরের কাগজের ওপর নিষেধাজ্ঞা, বিনা-পরোয়ানায় গ্রেফতার, বিনা বিচারে দীর্ঘকাল কারাবাস, গোপনে ‘বিচার’— এ সব তো ছিলই, উপরন্তু অভিযুক্তরা জানতে পারত না কে অভিযোক্তা, কী সাক্ষ্যপ্রমাণ তাদের বিরুদ্ধে হাজির করা হয়েছে। মুক্তি পেলে তাদের জামানত দিয়ে মুচলেকা দিতে হত যে তারা কোনও রাজনৈতিক, শিক্ষাগত বা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকবে না। শোনা যায়, সার সিডনির প্রপৌত্র ভারতে এসে জালিয়ানওয়ালাবাগের চত্বর দেখে নাকি কেঁদে ফেলেছিলেন। তাঁর প্রপিতামহই তো ওই হত্যাকাণ্ডর আসল কাণ্ডারী।

যেখানে অত্যাচার, সেখানে প্রতিরোধ। পঞ্জাব তাই রাউলাট অ্যাক্টের বিরুদ্ধে ফেটে পড়েছিল ক্ষোভে। গাঁধী ঠিক করলেন, বিক্ষুব্ধ পঞ্জাব যাবেন। ৮ এপ্রিল ট্রেনে চড়ে দিল্লি রওনা হলেন। পথে তাঁকে গ্রেফতার করে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হল। তখনকার অবিভক্ত মহারাষ্ট্রের বাইরে বেরনো তাঁর নিষিদ্ধ হয়ে গেল। শুনে ক্রুদ্ধ অমৃতসরের জনতা তাণ্ডব চালাল। ব্রিটিশ ব্যাঙ্কের ওপর হামলা হল। খুন হলেন কয়েক জন ব্রিটিশ ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। এমনকি এক ব্রিটিশ নারী-মিশনারি প্রহৃত হলেন রাস্তায়। এ বার পঞ্জাবে চালু হল সামরিক শাসন। ক্ষমতার অধীশ্বর জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ার। অমৃতসরের নাগরিকদের চিঠিপত্র সেন্সর হতে লাগল। সন্দেহজনক ব্যক্তিদের বাড়ির জলের ও বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হল। মন্দির-মসজিদে ভক্তদের ঢোকা বারণ হয়ে গেল। বিদ্রোহীদের ধরে ধরে প্রকাশ্যে চাবকানো হল। যে-রাস্তায় ওই মহিলা মিশনারি আক্রান্ত হয়েছিলেন সেই রাস্তা দিয়ে চলবার সময় প্রত্যেক ভারতীয়কে হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করা হল।

Advertisement

ঘটনার চিত্রিত বর্ণনা। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

পঞ্জাবি প্রতিবাদীরা কিন্তু মাথা নোয়ালেন না। ঠিক করলেন জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে প্রতিবাদ সভা হবে ১৩ এপ্রিল। জেনারেল ডায়ারের নিষেধাজ্ঞার পরোয়া না করে কয়েক হাজার লোক জড়ো হল জালিয়ানওয়ালার মাঠে। ক্ষিপ্ত জেনারেল ভাবলেন আর একখানা ১৮৫৭ বুঝি ঘটতে চলেছে। আর দেরি না-করে নব্বই জন বালুচি আর গুর্খা সৈন্য নিয়ে জালিয়ানওয়ালায় ঢুকলেন। শ্বেতাঙ্গ ছিল মাত্র চার জন, দুজন অফিসার আর দুজন নিরাপত্তা প্রহরী। নেহাত রাস্তা সরু তাই, নইলে আরও সৈন্য, এমনকি, মেশিনগান আর সাঁজোয়া গাড়িও ঢুকিয়ে দিতেন।

পরের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতার সবচেয়ে অনুশোচনাহীন ও উদ্ধত প্রবক্তা উইনস্টন চার্চিল। ‘জনতার হাতে লাঠি ছাড়া কোনও অস্ত্র ছিল না। তারা কাউকে বা কোনও কিছুকে আক্রমণ করেনি। তারা একটি রাজদ্রোহমূলক সভা করছিল। যখন তাদের ছত্রভঙ্গ করবার জন্য গুলিবর্ষণ শুরু হল, তারা ইতস্তত ছুটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। ট্রাফালগার স্কোয়ারের চেয়েও অনেক ছোট এক চিলতে জায়গায় আটকে পড়েছিল তারা, বেরোবার কোনও জায়গা ছিল না বললেই চলে। এমনই গাদাগাদি অবস্থা যে একটা বুলেট তিন-চারটে দেহ ফুঁড়ে বেরিয়ে যেতে পারত। লোকে পাগলের মতো এ দিক-ও দিক ছোটাছুটি করতে শুরু করে দেয়। যখন ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসছিল মাঠের মাঝখান লক্ষ্য করে, তখন তারা মাঠের পাশের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। অমনি গুলি চালানো হল পাশের দিকে। অনেকেই মাটিতে শুয়ে পড়ে। তখন সেই মাটির দিকেই তাগ করে চালানো হল গুলি। ৮ থেকে ১০ মিনিট ধরে চলে এই গুলিবর্ষণ, গুলি চালানো বন্ধ হয় কেবল গুলির জোগান শেষ হওয়ার মুখে’।

কিছু গুলি অবশ্য রেখে দেওয়া হয়েছিল যাতে সৈন্যরা ‘নিরাপদে’ ফিরে যেতে পারে। সৈন্য যদি আরও বেশি থাকত, তা হলে ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি হত। অবশেষে, চার্চিলের হিসেবমতো ৩৭৯ জন (আসলে তার অনেক বেশি) মৃত আর ১২০০ বা ততোধিক জখম মানুষকে ফেলে রেখে বীর সেনারা (মানতেই হবে, তাদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ ছিল মাত্র চার জন) রণাঙ্গন ত্যাগ করে চলে যায়, দ্বিতীয় ‘সিপয় মিউটিনি’র সমস্ত সম্ভাবনা রোধ ক’রে, বীরদর্পে। ‘এ রকম ঘটনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধুনিক ইতিহাসে অভূতপূর্ব, বেনজির। বেসামরিক জনসমষ্টির সঙ্গে সৈন্যদের সংঘর্ষের অন্য যে সব বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে থাকে তার কোনওটার সঙ্গেই এর মিল নেই, এ একেবারে ভিন্ন গোত্রের একটি ঘটনা। এ ঘটনা অস্বাভাবিক, এ ঘটনা দানবিক, অশুভতার মাত্রাবিচারে এ ঘটনা একক, অনন্য।’

নিহতদের শ্রদ্ধার্ঘে তৈরি স্মৃতিসৌধ ।ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

আত্মপক্ষ সমর্থনে জেনারেল ডায়ার বলেছিলেন, কী করব, আমাকে যে একটা ‘বিপ্লবী সেনাদলের’ মোকাবিলা করতে হয়েছিল। চার্চিলের বিদ্রূপ: ‘বটে, যে কোনও সেনাদলের মুখ্য বৈশিষ্ট্য হল, তারা সশস্ত্র। (অমৃতসরের) এই জনতা ছিল নিরস্ত্র’। তারা একটা ঢিলও ছোড়েনি। সভ্য সাম্রাজ্যবাদী চার্চিলের আক্ষেপ, ‘ব্রিটিশদের কাজকর্ম চালানোর দস্তুর এটা নয়’। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ন্যায়পরতার গায়ে এ নাকি এক অনপনেয় কলঙ্ক। অকারণ আতঙ্কে জেনারেল ডায়ারের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

এত বড় নারকীয় কাণ্ড ঘটানোর অপরাধে জেনারেল ডায়ারকে স-পেন্সন অকাল-অবসরের মতো ভয়ঙ্কর প্রচণ্ড শাস্তি পেতে হয়েছিল! অকাল-অবসর নিয়ে দেশে ফেরার পর বীরত্বের পুরস্কারস্বরূপ একটি মহিলা সঙ্ঘ তাঁকে ২৬০০০ পাউন্ড (আজকের হিসেবে এক লক্ষ পাউন্ড)-এর তোড়া উপহার দিয়েছিল। তিনি যা করেছিলেন সেটা নাকি মহিলাদের সম্মানরক্ষার্থে অনিবার্য ছিল! পঞ্জাবের সেই সময়কার লেফ্টেনান্ট গভর্নর মাইকেল ও’ডায়ার-ও জেনারেল ডায়ারকে লম্বাচওড়া সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন।

ও’ডায়ারকেও তাঁর পদ থেকে অপসারিত করা হয়েছিল। কিন্তু কী অসম্ভব জেদ এই সব অনুশোচনাহীন সাম্রাজ্যবাদীদের! ১৯২২ সালে শঙ্করণ নায়ার যখন একটি বইতে ও’ডায়ারকে ওই ঘটনার জন্য দায়ী করেন, আইনভীরু ওডায়ার তখন মানহানির মামলা করেন, এবং, আশ্চর্য, সে-মামলা জেতেন। পাঁচশো পাউন্ড জরিমানা দিতে হয়েছিল শঙ্করণ নায়ারকে! ব্রিটিশ আইন বলে কথা। তবে পাওনাগণ্ডা চুকিয়ে দেওয়ার কতকগুলো নিজস্ব পথ আছে ইতিহাসের। ১৩ মার্চ ১৯৪০ শহিদ উধম সিংহ লন্ডনে ও’ডায়ারকে গুলি করে মারেন। অমর হয়ে আছে বিচারকালে উধম সিংহের উক্তি: ‘এটা ওঁর প্রাপ্য ছিল। আসল অপরাধী তো উনিই। উনি আমাদের দেশের মানুষের মনোবল গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাই আমিই ওঁকে গুঁড়িয়ে দিলাম। পাক্কা ২১ বছর ধরে আমি বদলা নেবার অপেক্ষায় ছিলাম। আজ সে কাজ করতে পেরে আমি খুশি। মরতে আমি ভয় পাই না। আমি তো দেশের জন্য মরছি। আমি তো দেখেছি ব্রিটিশ শাসনে আমার দেশের মানুষ কী ভাবে না-খেয়ে কাটিয়েছে।’

১৩ এপ্রিল ১৯১৯-এর ঘটনার পর প্রচারমাধ্যমের ওপর যে-কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল তার কাছে ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থা নেহাত ছেলেখেলা। শোনা যায়, গাঁধী স্বয়ং জুন মাসের আগে ১৩ এপ্রিলের এই ভয়াবহ ঘটনার খবর পাননি। তবু, মুখে মুখে ছড়াতে থাকে খবর। শুনে, কলকাতায় আক্ষরিক অর্থে ঘুম চলে গেল রবীন্দ্রনাথের, যিনি স্বদেশি যুগের পর থেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে থাকতেন। তিনি গান্ধীকে বললেন, চলুন আমরা একত্রে দিল্লি গিয়ে সেখান থেকে অমৃতসরে পদযাত্রা করি। অনেকে বলেন, বিপজ্জনক রাজনীতির এত কাছাকাছি তিনি আর কখনও যাননি। কেননা ওই পদযাত্রা করলে তিনি যে গ্রেফতার হয়ে যেতেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কেজোবুদ্ধির লোক গাঁধী অবশ্য বললেন, এটা হঠকারিতার সময় নয়, ধৈর্য ধরার সময়। রবীন্দ্রনাথ তখন ছুটলেন চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে, বললেন, চিত্ত, এত বড় ঘটনার কোনও প্রকাশ্য প্রতিবাদ হবে না? চিত্তরঞ্জন বললেন, ঠিক কথা, প্রতিবাদ হওয়া দরকার। আপনি সভা ডাকুন মনুমেন্টের তলায়, আমি পাশে থাকব। কিন্তু আমি নিজে সভা ডাকব না।

হতবাক রবীন্দ্রনাথ ছটফট করতে থাকেন। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ৩০ মে অনেক রাতে জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে বাড়ি চলে আসেন। পর দিন একেবারে ভোরে আবার গেলেন তাঁর কাছে। নীচ থেকে দেখতে পেলেন, কবি তখনও ঠায় বসে আছেন দোতলার ঘরে টেবিলের সামনে তাঁর চেয়ারে। দরোয়ানকে ডেকে তুলে দরজা খুলিয়ে প্রশান্তচন্দ্র ওপরে গেলেন। রাতজাগা ক্লান্ত চোখে আটান্ন বছরের কবি তাঁকে দেখে বললেন, এই নাও। অবশেষে শেষ করেছি। বিহ্বল প্রশান্তচন্দ্র দেখেন ইংরেজিতে লেখা একখানা চিঠি, যার মধ্যে রয়েছে সেই অমর পঙ্‌ক্তিগুলি: ‘অবমাননার এই অসংগত প্রেক্ষাপটে সম্মানের তকমাগুলি আমাদের লজ্জাকেই আরো প্রকট করে তোলে। আমার তরফ থেকে সকল বিশিষ্টতার চিহ্ন ছেঁটে ফেলে আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াতে চাই আমার সেইসব তথাকথিত অকিঞ্চিৎকর দেশবাসীর পাশে, অকিঞ্চিৎকরতার মূল্য হিসেবে যাদের এমন অসম্মানের শিকার হতে হল যা মানুষের অযোগ্য’। (The time has come when badges of honour make our shame glaring in the incongruous context of humiliation, and I for my part wish to stand, shorn of all special distinctions, by the side of those of my countrymen, who, for their so-called insignificance, are liable to suffer degradation not fit for human beings.) ‘ছার’ খেতাব ত্যাগ করে কবি কিছুটা হালকা হলেন। হয়ে উঠলেন স্বদেশ-আত্মার বাণীমূর্তি। সারা দেশের রাজনৈতিক নেতারা যেখানে কৌশলগত কারণে চুপ, সেখানে এক জন কবি এগিয়ে এসে ভাষা দিলেন মানুষের বিবেকী প্রতিবাদকে। ক্রমে ব্রিটিশ মহত্ত্ব-মোহমুক্ত গাঁধীও ১৯২০ সালে ছেড়ে দেন দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশ-সেবার পুরস্কার হিসেবে প্রাপ্ত তাঁর কাইজার-ই-হিন্দ খেতাব। জিন্না ইম্পিরিয়াল কাউন্সিলের সদস্যপদ ছেড়ে দেন। মোতিলাল নেহরু পুড়িয়ে ফেলেন তাঁর সাহেবি পোশাক। কিন্তু পথ দেখিয়েছিলেন ওই সাহসী বাঙালি কবি।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চার্চিলের যে-বক্তৃতা থেকে ওপরে উদ্ধৃতি দিয়েছি, সেটির তারিখ ৮ জুলাই ১৯২০। তার মাসখানেক আগেই ৫ জুন ১৯২০ রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জালিয়ানওয়ালাবাগ-বিতর্ক স্বকর্ণে শুনে লিখেছিলেন, ‘প্রচণ্ডতা এদের মজ্জায় নিহিত, এদের রক্তে বহমান। ডায়ারের কীর্তিকে এরা কেউ কেউ ‘splendid brutality’ বলে প্রশংসা করেছে।’ এই উপলক্ষে ‘এদের মেয়েদের মধ্যেও রক্তলোলুপ হিংস্রতার পরিচয় পেয়ে’ তিনি মর্মাহত হন, বোঝেন, ‘এদের কাছ থেকে আমাদের কিছু আশা করবার নেই– আশা করা আত্মাবমাননা’। আরও খেয়াল করেছিলেন, ইংল্যান্ডে তাঁর বহুনন্দিত ‘বড়ো ইংরাজ’রাও অনেকেই তাঁকে এড়িয়ে চলছেন!

ইতিহাসে এমন ঘটনা কমই ঘটেছে। তবে ইতিহাস বড় নির্মম। তা যেমন স্মরণ করিয়ে দেয় যে ওই হত্যাকাণ্ডের আয়োজকরা ব্রিটিশ হলেও বন্দুক হাতে যারা গুলি চালিয়েছিল তারা বালুচ আর গুর্খা, তেমনই প্রশ্ন তোলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের অবস্থান নিয়ে। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের এক বছর পরে যখন শহিদদের স্মরণার্থে একটি স্তম্ভ নির্মাণের প্রস্তাব ওঠে, তখন প্রবল বিরোধিতা করেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর যুক্তি, ‘হৃদয়ের মধ্যে প্রতিশোধের কলুষস্বপ্ন পোষণ করে নৈতিক পরাজয়কে মেনে নিতে আমরা অস্বীকার করব।...আমরা যারা আমাদের প্রতিবেশে নিরীহ প্রাণের এই হত্যালীলা প্রত্যক্ষ করেছি তারা যেন ঈশ্বরের আপন করুণাকে স্বীকার করে নিতে পারি, অপরাধের রক্তচিহ্নকে যেন এই প্রার্থনা দিয়ে আবৃত করতে পারি: রুদ্র ইয়তে দক্ষিণম্‌ মুখম সম্মুখম তেন মাম পাহি নিত্যম!’ (হে রুদ্র, হে ভয়ঙ্কর, দেখাও তোমার সেই দয়ার্দ্র, সহাস্য মুখ, সেই মধুর হাস্য রক্ষা করুক আমায়।) সবুজ ঘাস ঢেকে দিক জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্তে ভেজা মাটিকে, ঢাকা পড়ুক ভারতবাসীদের বেদনাও। অর্থাৎ ভারতবাসী যেন সেই অমর শহিদদের মনে না রাখে। আশ্চর্য! কখনও কখনও ক্ষমা ক্ষীণ দুর্বলতারই নামান্তর, কখনও কখনও রুদ্রের আদেশেই কঠোর হতে হয়, এ শিক্ষা আমরা কার কাছে পেয়েছি! কে শিখিয়েছিলেন, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, উভয়কেই তৃণসম ঘৃণা করতে? রক্তের বদলে রক্ত চাওয়ার উন্মাদনা নয়, দানবের সঙ্গে সংগ্রামের জিগির তুলে ঘরে ঘরে প্রস্তুত থাকার আহ্বান নয়, নিছক মৃত শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা-স্মারক নির্মাণেও এত আপত্তি সেই একই রবীন্দ্রনাথের?

অবধারিত ভাবে মনে পড়ে যায় একই উপলক্ষে তরুণ নজরুলের কণ্ঠ: ‘এই যেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়া গেল, যেখানে আমাদের ভাইরা নিজের বুকের রক্ত দিয়া আমাদিগকে এমনভাবে উদ্বুদ্ধ করিয়া গেল, সেই জালিয়ানওয়ালাবাগের নিহত সব হতভাগ্যেরই স্মৃতিস্তম্ভ বেদনা-শেলের মত আমাদের সামনে জাগিয়া থাক, ইহা খুব ভাল কথা – কিন্তু সেই সঙ্গে তাহাদেরই দুশমন ডায়ারকে বাদ দিলে চলিবে না।...আমাদের এই নির্লজ্জ কাপুরুষতাকে ভীম পদাঘাতে দূর করিয়া দিয়াছে এই জেনারেল ডায়ার! গোলামের সঙ্গে প্রভুর সম্পর্ক কিরকম তাহাই সে নির্মম কঠোরভাবে জানাইয়া দিয়াছে’। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার পর ভারতের রাজনীতি আর এক থাকেনি।

জালিয়ানওয়ালাবাগের একশো বছর তাই অনেক বেদনা, অনেক শৌর্য, অনেক গর্ব আর অনেক প্রশ্ন জাগায় আমাদের মনে।

(লেখক প্রাবন্ধিক ও গবেষক)
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement