কলকলি একটা নদীর নাম। আর সেই নদীর সঙ্গে মিলেমিশে থাকা স্মৃতিও ম্লান হয়ে গিয়েছে। শুধু আছে নদীকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা। এক সময় নদী তার আপন সৌন্দর্যে নিজের স্থান করে নিয়েছিল ‘আনন্দমঠ’-এ। কী ভাবে? সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক সময় বহরমপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তিনি থাকতেন ব্যারাক স্কোয়ারের আবাসনে। ১৮৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর অফিস ছুটির পরে ঘরে ফেরার সময় তিনি গোরা সৈনিকদের ক্রিকেট খেলার মধ্যে পড়ে যান। এক গোরা ক্যাপ্টেন ড্যাফিন সাহেবের সঙ্গে তাঁর বচসার জেরে বহরমপুর জেলা আদালতে একটি মামলা হয়। আর এই মামলাকে কেন্দ্র করে লালগোলার রাজা ও বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে। এই সময় বেশ কয়েক বার বঙ্কিমচন্দ্র লালগোলায় আসেন। সেখানে এলেই তিনি থাকতেন কলকলি নদীপাড়ের অতিথিশালায়। কথিত আছে যে, এই নদীর ধারে বসেই তিনি ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের বেশ কিছু রসদ সংগ্রহ করেছিলেন। যার প্রমাণও পাওয়া যায় ‘আনন্দমঠ’-এ।
জলঙ্গির সংসারে কলকলি নদীর আজ কোনও ভূমিকা নেই। তবে একটা সময় ছিল। কলকলি ছিল পদ্মার শাখানদী। ভগবানগোলার কাছ থেকে বেরিয়ে পদ্মার এই শাখানদীটি পুরনো ভগবানগোলা, চন্দ্রবাদ, শুঙ্গরপুর, মারীচ, পুরন্দরপুর, আজিমগঞ্জ, মহম্মদপুর, বৈদ্যপাড়া, রায়পুর হয়ে জুরানপুরের কাছে জলঙ্গি নদীতে মিশত। রেনেল সাহেব তাঁর ‘ম্যাপ অব কোশিমবাজার আইল্যান্ড’ মানচিত্রে এই নদীটিকে প্রথম চিহ্নিত করেন। তিনি এই স্রোতধারাটির নাম লেখেন ‘Culcully River’। ১৭৭৪ সালে এই নদীটি বহমান ছিল। ১৮৪০ সালে ট্যাসিন সাহেবের মানচিত্রটি প্রকাশিত হয়। সেখানে কলকলিকে একটি মৃত নদী হিসাবে দেখানো হয়। ১৭৭৪ থেকে ১৮৪০ সাল। মাঝে কেবল ৬৬টি বছর। এর মধ্যেই নদীটি মরে গেল। ট্যাসিন সাহেব এই নদীটিকে তাঁর মানচিত্রে একটি মৃত নদী হিসাবে দেখালেন। কী এমন হল যে, নদীটি মরে গেল! আসুন, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
গাঙ্গেয় দ্বীপের একটি স্বভাবসিদ্ধ বিষয় বন্যা। বাংলার নদীগুলো বন্যার সময় আপন খেয়ালে আপনি রাজার মতো। কোনও কিছুর সে পরোয়া করে না। দুরন্ত শিশুর মতো সে এ দিক ও দিক ছোটে। ঠিক এমনটাই ঘটল ১৮২৩ সালে। বড় বন্যা এল। বৃষ্টির জলে নদীর কুল ছাপিয়ে গেল। সেই বন্যাতেই পদ্মা নদীর মূল স্রোত কিছুটা উত্তর দিকে সরে গেল। ফলে বন্যার পরবর্তী সময়ে পদ্মার জল কলকলি আর সারা বছর ধরে সমান ভাবে পেত না।
এর পর ১৮৭১ সাল। ভয়াবহ এক বন্যা হল। এই বন্যাতে পদ্মার জল ২৯ ফুট উঁচুতে ওঠে। আর তারই সঙ্গে পদ্মা তার চলার পথ পরিবর্তন করে আরও বাঁ দিকে সরে যায়। ফলে কলকলি নদী পদ্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে কলকলির উৎসের দিকে একটি বড় চরও তৈরি হয়। যার ফলে পদ্মার জল কলকলিতে ঢোকার মুখে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ১৯২৬ সালে আরও একটি বন্যা হয়। বন্যাতে কলকলি নদীতে সর্বোচ্চ জলস্তর ওঠে ৬৬ ফুট। শুরু হয় পদ্মার ভাঙনও। আর তাতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় মারীচা গ্রাম। গ্রামটি ভাঙনে মুছে যাওয়ার পরে কলকলি দু’টি ধারায় ভাগ হয়ে যায়। মারীচার উজানের দিকে একটি ধারা হাবাসপুর হয়ে সাহেবনগরের কাছে ভৈরব নদীতে মেশে। অপর ধারা কুপিলা গ্রামের পাশ দিয়ে গিয়ে পুরোনো জলঙ্গি নদীর ধারার সঙ্গে মিলিত হয়। পরবর্তী সময়ে এই ধারাটি শিয়ালমারি নদী হিসাবে পরিচিত হয়।
‘অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন নদিয়া রিভারস’-এর ১৯২৬ সালের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বন্যার পরে পলিতে ঢেকে যায় কলকলির বুক। সে বছরেই নদীর বুকে চাষবাস শুরু হয়। ভগবানগোলার কাছে কলকলি নদীর অংশ ছোট ছোট পুকুরে পরিণত হয়। তবে নদীর ভাটির দিকটাতে সামান্য জল ছিল। আর সে জলের জোগান দিত ভৈরব থেকে আসা একটি শাখা।
তালতলার কাছে নদীর ‘গেজ’ মাপা হতো। অর্থাৎ নদীতে কী পরিমাণ জল আছে তা পরিমাপ করা। উল্লেখ্য, ১৯২৫ সালে নদীর কোনও গেজ মাপা হয়নি। কারণ, সে বার নদীতে সারা বছর জল ছিল না। তবে ১৯২৬ সালে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। যে পরিকল্পনার ভিতরে কলকলি থেকে একটা খাল কেটে গোবরা নালার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার কথা ভাবা হয়। যে খালটি কাটার কথা ভাবা হয়েছিল, সেটা তালতলা থেকে বেরিয়ে গোবরা নালাতে গিয়ে মিশবে। পরে এই কাজটিকে বাস্তবায়িত করাও হয়। ওই কাটা খালটি বর্তমানে রত্নাকর খাল নামে পরিচিত।
কলকলি নদীর মূল দৈর্ঘ্য ছিল ১৩ মাইল বা ২০.৯২ কিলোমিটার। ১৯২৯-৩০ সালে পদ্মার জলের সঙ্গে কলকলি ভৈরব নদীর জলও পেয়েছিল। ১৯৩১-৩২ সাল নাগাদ কলকলি নদীকে সেচ আইনের আওতায় আনা হয়। এই বছর নদীতে দ্রুত পলি পড়া শুরু হয়। নদীর উৎসমুখের দিকে এক মাইল অংশে পলি জমে নদীর খাত চার ফুট উঁচু হয়ে যায়। ঠিক এই কারণেই সেচ দফতর থেকে ‘গোবরা নালা ফ্লাশিং স্কিম’ প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়। এর ঠিক কয়েক বছর পরে, ১৯৩৫ সালেও শুখা মরসুমে ভগবানগোলার পরের আড়াই মাইল পথে নদীর জল ছিল। ১৯২৯, ১৯৩০ ও ১৯৩১ সালে বর্ষার সময় সর্বোচ্চ জলস্তর ওঠে যথাক্রমে ৬৩.৭০, ৬৪.৫৯ ও ৬৫.৫০ মিটার।
১৯৩২ সালের পর থেকে ফের পদ্মার জল নদী খাতে না ঢোকার ফলে কলকলি নদী মারা গেল। আজ যদি কলকলি নদীকে খুঁজতে যাওয়া যায়, তা হলে তার শরীরের একটি মাত্র টুকরোই আমরা পাব। লালগোলা বিডিও আফিসের পিছনে একটা বড় দিঘি আছে। ওই দিঘিটা আসলে কলকলি নদীরই অংশ। বর্তমানে এই অংশটি কলকলি দিঘি নামে পরিচিত। এখন এখানে মাছ চাষ হয়।
আরও অনেক স্মৃতির চারণভূমি এই নদীর অববাহিকা। কলকলি নদীর কূলে প্রাচীন বৌদ্ধদেবী মন্দির সংলগ্ন অংশে বনভূমি পরিষ্কার করে দলেল রায় ও রাজনাথ রায় সন্দরাপুর গ্রাম থেকে এসে বাসা বাঁধেন। এই ভাবেই সকলের অলক্ষে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় লালগোলা রাজের ভিত্তিভূমি। এছাড়াও অতীত কালে নদী সংলগ্ন প্রাচীন লালগোলা থেকে ভগবানগোলা পর্যন্ত যে বনভূমি ছিল, সেই বনভূমিতে ভ্রমণে এসেছিলেন বিশপ হিবার। সময়টা ছিল ১৮২৪ সালের ২ অক্টোবর। নদী পরিবেষ্টিত বনভূমির রমনীয়তায় মুগ্ধ হয়ে তিনি কবিতাও লিখে ফেলেন। এছাড়াও কলকলি নদীর তীরে রয়েছে রঘুমন্দির, বুড়োশিব মন্দির, বটন্তীকালী প্রভৃতি। যা নদীর সমৃদ্ধির নিদর্শন বহন করে।
প্রাকৃতিক কারণে নদীটি মারা গিয়েছে ঠিকই। তবে নদীকে সম্পূর্ণ ভাবে বাঁচিয়ে তোলা অসম্ভব নয়। কেরলের মানুষেরা মৃত নদী কুট্টাম্পেরুরকে মাত্র ৭০ দিনে সংস্কার করে বাঁচিয়ে তুলতে পেরেছিল। এমনকি বাঁকুড়া জেলার ওন্দা ব্লকের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া বিড়াই নদীকে একশো দিনের কাজে সংস্কার করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা হয়েছে। নদীকে বাঁচিয়ে তারা ফিরে পেয়েছে মাটির তলার সমৃদ্ধ জল ভাণ্ডারকে ও নদী পাড়ের সংস্কৃতিকে। তা হলে নদীভরা জেলা মুর্শিদাবাদ কেন পারবে না?
নদী বিশেষজ্ঞ