অ্যাসিড আক্রান্ত। ফাইল ছবি
মেয়েটি কলেজে পড়ত। সামনে রঙিন ভবিষ্যৎ। কিন্তু হঠাৎ সব তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। বেশ কিছু দিন ধরেই একটি ছেলে তাঁকে বিরক্ত করছিল। নিজের ভাললাগার কথা জানাচ্ছিল। প্রথমে গুরুত্ব দেননি শবনম। ‘না’ বলেছিলেন। এক দিন দুপুরে বাড়ির বেল বেজে ওঠে। দরজা খুলতে গিয়েছিলেন শবনম। খোলার সঙ্গে সঙ্গে মুখে আছড়ে পরেছিল অ্যাসিড। ছুঁড়ে ছিল ছেলেটি। প্রেমে ‘না’ বলার শাস্তি। তার পরে দমে জাননি শবনম। লড়াই করে গিয়েছেন। এখন এমবিএ শেষ করে বেঙ্গালুরুতে চাকরি করছেন তিনি।
শবনম একা নন, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) সর্বশেষ প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে, সারা দেশে অ্যাসিড আক্রমণের যতগুলি ঘটনা ঘটেছে, তার ২৬ শতাংশ এ রাজ্যের। ২০১৫-’১৬ সালে ৮১টি এরকম ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এই রিপোর্টে আর একটি তথ্য মিলেছে। যেটি আরও বেশি আতঙ্কের। আগে অ্যাসিড আক্রান্তের সংখ্যায় সেরা দেশে সব থেকে উপরে ছিল উত্তরপ্রদেশ। এখন বাংলা!
অ্যাসিড আক্রমণ নারী নির্যাতনের অন্য একটি মাত্রা হয়ে উঠেছে। অ্যাসিড আক্রমণে সাধারণত ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩২৬এ এবং ৩২৬বি এই দু’ইটি ধারা দেওয়া হয়। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে অপরাধীকে কম করে দেড় লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং দশ বছরের কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হতে পারে। কিন্তু এর মোকাবিলা সে ভাবে হচ্ছে কই? যে ধরনের অ্যাসিড থেকে শরীরের ক্ষতি হতে পারে, এমনকি, মৃত্যুও হতে পারে তার বিক্রিতে নানা শর্ত আরোপ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। রাজ্য সরকার বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে। কিন্তু বাস্তবে এই সব অ্যাসিডের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয়নি। বার বার মহিলাদের উপরে অ্যাসিড আক্রমণ থেকে তা প্রমাণিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অনেক সময়ে নাইট্রিক অ্যাসিড ব্যবহার করা হচ্ছে। আশঙ্কার কথা হল, এখনও বাজারে তা সহজে মিলছে। এই অ্যাসিড রাখার জন্য কেউ আটক হয়েছে, বা কারও শাস্তি হয়েছে এমন নজির সে ভাবে চোখে পড়ে না। মনে রাখতে হবে নিরাপত্তার ব্যবস্থাও সরকারেরই কর্তব্য। ক্ষতিকারক অ্যাসিড বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করা সেই নিরাপত্তারই একটি অংশ। আরও একটি দিক অবহেলিত থেকে যাচ্ছে, তা হল, অ্যাসিড আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে আমরা মনীষা পৈলানের কথা বলতে পারি। অ্যাসিড-আক্রান্ত এই তরুণীকে আদালত তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছিল। রাজ্য সরকার দীর্ঘ দিন টালবাহানা করছিল। ফের হাইকোর্টে যান মনীষা। তার পরে ক্ষতিপূরণ পান। অ্যাসিড-আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতে এই টালবাহানা কেন?
সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, অ্যাসিড আক্রমণের ফলে যে মহিলাদের অঙ্গহানি হয় তার পরিমাণ কোনও টাকার অঙ্কে করা সমীচীন নয়। কারণ এই সময় একটি মেয়েকে যে শারীরিক মানসিক বিধ্বস্ততার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তার কোনও পরিমাপ করার চেষ্টা বৃথা। এই ধরনের ঘটনা এক জন মানুষের মনোবল যেমন চিরতরে নষ্ট করে দিতে পারে তেমনই তাকে মানসিক ভাবে পঙ্গু করে দিতেও পারে। আর একটি কথা মনে রাখতে হবে, অ্যাসিডে শরীরে পুড়লে দীর্ঘ দিন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। বার বার অস্ত্রোপচারের দরকার হয়। বেশ কয়েক বছর এমন চলতে পারে। অনেক অ্যাসিড-আক্রান্তের পক্ষে সেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। পাশাপাশি, মেয়েটির পড়াশোনা বা কাজেরও ক্ষতি হয়। এই ক্ষেত্রেও সরকারে দ্রুত আক্রান্তের পাশে দাঁড়াতে হবে।
তবে অ্যাসিড আক্রমণ সাম্প্রতিক সমস্যা হলেও এর বীজ বোধহয় নারীকে ভোগপণ্য হিসেবে দেখার মধ্যে লুকিয়ে আছে। নারী প্রত্যাখ্যান করলে তাঁর রূপ বিকৃত করে শাস্তি দেওয়ার মানসিকতা সেখান থেকেই উঠে আসে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ উপন্যাসে অভিমানিনী পার্বতীকে শাস্তি দিতে চেয়ে দেবদাস বলেছিলেন, ‘‘শোন পার্বতী, অতটা রূপ থাকা ভাল নয়। অহঙ্কার বড় বেড়ে যায়।...এস, তোমারও মুখে কিছু কলঙ্কের ছাপ দিয়ে দিই।’’ এর পরে লেখকের ভাষায়, ‘‘সে দৃঢ়মুষ্টিতে ছিপের বাঁট ঘুরাইয়া লইয়া সজোরে পার্বতীর মাথায় আঘাত করিল; সঙ্গে সঙ্গেই কপালের উপর বাম ভ্রূর নীচে পর্যন্ত চিরিয়া গেল।’’ আশ্চর্যের বিষয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু আক্রমণকারী পুরুষ এবং আক্রান্ত মেয়ে। অনেকে বলেন, আক্রমণকারী ও আক্রান্তের এই পরম্পরার জন্য দায়ী আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। ছেলেবেলা থেকেই আমরা মেয়েদের থেকে শ্রেষ্ঠ এই ধারণা পুরুষদের মনে গেঁথে যায়। ফলে সে যখন একজন নারীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয় তখন তা মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। এটা প্রকৃতপক্ষে মেয়েদের প্রতি সন্ত্রাস। সন্ত্রাসবাদীর মতোই অতর্কিতে হানা দিয়ে নিমেষের মধ্যে প্রাণহানি, অঙ্গহানি করছে কিছু লোক। শুধু নির্দিষ্ট মেয়েটির উপরেই আক্রমণ নয়, মেয়েদের স্বতন্ত্র মত, স্বাধীন জীবনযাত্রার সম্ভাবনা নস্যাৎ করার প্রয়াস। এই অপরাধ আলাদা প্রকৃতির। এটা স্বীকার করে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ এবং অপরাধীর বিচার করিতে হবে রাষ্ট্রকে। তবে সাম্প্রতি অ্যাসিড হানার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। আক্রান্তকে জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে নানা বেসরকারি সংস্থা চেষ্টা চালাচ্ছে।
রানিগঞ্জ টিডিবি কলেজের অর্থনীতি স্নাতকস্তরের প্রথম বর্ষের ছাত্র