আদালতই তবে নাগরিকের একমাত্র ভরসা। কথাটি এই দেশে বার বার বলিতে হয়। কলিকাতা হাইকোর্টের সোমবারের নির্দেশটির কারণে যে কোনও সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক আরও এক বার তাহা ভাবিয়াছেন। বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় কেবল পূজামণ্ডপে দর্শকের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন নাই, স্পষ্ট ভাষায় বলিয়া দিয়াছেন যে, দর্শকদের মণ্ডপে ঢুকিতে দিলে ভিড় সামাল দেওয়ার ক্ষমতা পুলিশের হইবে না, নিছক পুলিশের সংখ্যাই তাহা বুঝাইয়া দেয়। পুলিশ তথা প্রশাসন যাঁহারা চালাইতেছেন তাঁহারাও পাটিগণিত জানেন। জানিয়াও তাঁহারা উৎসবের ছাড়পত্র দিয়াছেন এবং নানাবিধ বিধিনিষেধ জারি করিয়া ও অনুরোধ উপরোধ করিয়া জনসমাগম নিয়ন্ত্রণের ‘পরিকল্পনা’ করিতেছেন। পূজা শুরুর এক সপ্তাহ আগে কোনও কোনও পূজামণ্ডপে জনপ্লাবনের দৃশ্য বুঝাইয়া দেয়, সব পরিকল্পনা ও সুভাষিতাবলি উৎসবজলতরঙ্গে ভাসিয়া যাইবে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিচারপতিদের নির্দেশে নিহিত তিরস্কার: ভাবের ঘরে চুরি করিয়া কোনও লাভ নাই। সর্বজনীন পূজা সম্পূর্ণ বন্ধ হইলে হয়তো বিপদ আরও অনেকটা কমিত। লক্ষ্মণরেখার চারিপাশে মণ্ডপ ও আলোকসজ্জা দেখিবার জন্যও জনসমাগম ঘটিবে না, তেমন ভরসা নাই। কিন্তু জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বিচারপতিদের পক্ষে যত দূর করা সম্ভব ছিল, তাঁহারা করিয়াছেন।
এই নির্দেশ আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক, কারণ তাহা ব্যাধির গ্রাস হইতে অনেক মানুষকে বাঁচাইতে পারিবে, মৃত্যুর মুখ হইতে অনেক জীবনকে রক্ষা করিতে পারিবে। লক্ষণীয়, কেন্দ্রীয় ‘ন্যাশনাল সুপারমডেল কমিটি ফর কোভিড-১৯’-এর বিচারে দেশে ব্যাধির মাত্রা শিখরে পৌঁছাইয়া নামিতে শুরু করিলেও উৎসবের মরসুমে সংক্রমণ প্রতিরোধে তৎপর না থাকিলে রেখচিত্রটি আবার ঊর্ধ্বগামী হইতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ লইয়া দুশ্চিন্তা সমধিক— সর্বভারতীয় চিত্রে যে রেখাটি নিম্নগামী, রাজ্যে তাহা এখনও উঠিতেছে। এই প্রেক্ষাপটে শারদোৎসব সমাগত। এবং অগণিত মানুষ বেপরোয়া উচ্ছ্বাসে বাহির হইয়া পড়িয়াছেন। সামাজিক মেলামেশার বাঁধ ভাঙিয়া গিয়াছে, পূজার বাজারে নানা অঞ্চলে বিপুল লোকসমাগম, সর্বোপরি শুরু হইয়া গিয়াছে পূজামণ্ডপে দর্শনার্থীর ভিড়। মুখচ্ছদ গলায় নামাইয়া রাখিবার অভ্যাসটিতে প্রবল ইন্ধন দিয়াছে মণ্ডপে সেলফি তুলিবার অদম্য তাড়না। এই বঙ্গের নাগরিক অন্যের কথা ভাবা তো দূরস্থান, নিজের কথা ভাবিবার দায়িত্বও পালন করিতে অনিচ্ছুক।
এই বিপজ্জনক আচরণের পিছনে প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলির দায় বিরাট। রাজ্য সরকার সতর্কবাণী প্রচারে কার্পণ্য করে নাই, পূজার আয়োজকদের সাবধান থাকিবার দায়িত্ব সম্পর্কেও বারংবার সচেতন করিয়াছে, কিন্তু তাহার সুফল কতটুকু মিলিবে যখন সরকারি নেতারা নিজেরাই বিভিন্ন ভাবে পূজোৎসবে নামিয়া আসিয়াছেন? ‘ভুলত্রুটি করিয়া থাকিলে’ দেবীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী— এই প্রার্থনা হয়তো অন্তরের উদ্বেগ ও অনুশোচনারই প্রকাশ। কিন্তু ক্ষমা পাইলেই কি অঘটন এড়ানো যায়? বিরোধী দলগুলির সকলেরও দায়িত্ববোধের লক্ষণ নাই। বিজেপি নিজেই পূজা সংগঠনে মাতিয়াছে, দলীয় ভিত্তিতে, প্রথম বার! অর্থাৎ নাগরিক নিয়ম মানিতে অনাগ্রহী, নেতারাও তথৈবচ। বঙ্গসমাজ এই ভয়ঙ্কর বিপদেও সংযত রাখিতে নারাজ। চিকিৎসক, সমাজকর্মী, সুনাগরিক, পুলিশ প্রশাসনের সমস্ত বিপদবার্তা ও সাবধানবাণী ফুৎকারে উড়াইয়া আত্মঘাতী বাঙালি বীভৎস মজায় মাতিতে চাহে। আদালতের নির্দেশের পরে সমাজের সম্বিৎ ফিরিবে কি না, প্রশাসন নির্দেশ পালনে এবং এই নির্দেশে নিহিত গভীরতর সতর্কবাণীর মর্যাদা রক্ষায় তৎপর হইবে কি না, তাহাই অতঃপর প্রশ্ন। জীবনমরণ প্রশ্ন।