ছোটবেলায় চোখে জল ভরে আসত জনগণমন গাইতে গিয়ে

না-বোঝা সেই স্বপ্ন দেশ  

একটি দেশ, তার হরেক রাজ্য, হরেক রাজ্যের মধ্যে হরেক জাতি, জাতপাত, ধর্মপরিচয়ের রকমফের। ইতিহাসের আলাদা আলাদা বয়ান এ ভাবে তার বহু রূপ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে আমাদের ওপর, কে ভেবেছিল! কোনও একরঙা, মেটে মেটে ভারতের আদল আর সম্ভব নয়।

Advertisement

যশোধরা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:২৭
Share:

আমার ভারত কি আপনার ভারত? আপনার ভারত কি ওঁর ভারত? তাঁর ভারত? আদৌ ভারত বলে কি কিছু আছে? ভারত যে কী, সত্যি আজ অবধি বুঝিনি। ভৌগোলিক সীমানাই কি ভারত? এই দোলায়মানতা থেকে শুরু করে, বুঝি না এখনও দেশপ্রেম আসলে কী। ভারতীয় সংস্কৃতির সংজ্ঞাতেও এখন ধোঁয়াশা। এমনকী ১৯৫০-এ যে ভারত আমরা বুঝতাম, সত্তরের দশকের পরবর্তীতে কি সেই ভারতই বোঝা যেত? না কি ২০১৪’র পরে অন্য কোনও ভারতীয়ত্বের ধারণা গড়ে উঠেছে আমাদের? নব নব রূপ পরিগ্রহ করছে কি ভারতীয়ত্বের ধারণা? তা হলে এত দিন যা বুঝতাম তা কি নেহাত ভাসাভাসা কিছু একটা নয়?

Advertisement

সত্তরের দশকের শুরুতে, ইশকুলে পড়ার সময়, পনেরো অগস্টের ভোরে চোখ জলে ভরে আসত জনগণমন গাইতে। গলা আজও বুজে আসে সিনেমাহলে ও গান গাইতে। সে আমার অবচেতনের ক্রিয়া। অথচ মুশকিল এই যে, সচেতনে দেশপ্রেমের প্রমাণ রাখায় বিশ্বাসী নই। প্রতি ছবির আগে দাঁড়িয়ে উঠে দেশভক্তির প্রমাণ রাখা, এটা নিছক আনুষ্ঠানিক বিব্রত করা দেখানেপনা বলে মনে হয়। আর এখন, এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও তো হয়নি। প্রতি দিনের কাগজ পড়ে বুঝতে হবে, সিনেমার আগে ও গান বাজবে কি না। বড় ক্ষীণ সুতোয় ঝুলছে আমার দেশপ্রেম আজ। অথচ সেই সে স্বর্ণিল ছোটবেলা থেকে ক’দিন আগে অবধি ছিলাম অজ্ঞতার স্বর্গে। একটা না-বোঝা ভারতবর্ষের গর্ভে।

এখন নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় এই ভেবে যে, জীবনের এতগুলো বছর যে ভারত কী, না বুঝেই কেটে গেল, এ-ও তো খুব বড় এক পাওয়া আমার। কেননা, আজকে যে শিশু বড় হয়ে উঠছে, তার পক্ষে বোধহয় এত সহজ হবে না এ সব না ভেবে পার পাওয়া। কী বাড়িতে, কী পাড়ায়, কী ইশকুলে। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, বাক্যটা বোঝা প্রায় অসম্ভবই দাঁড়াবে তার পক্ষে। এত বেশি বিভেদ, ভাগাভাগি, এত বেশি দেওয়ালের মধ্যে সে জন্মাচ্ছে, যে নিজের হাউসিং সোসাইটির বাইরেটাই তার কাছে বিদেশ। নিজের পরিবারের বাইরে অন্য মানুষকে আর এক জন স্বদেশবাসী বলে বুঝতে শিখছে কি সে? না তার কাছে সে কেবল দেওয়ালের ওপারের আর এক জন অচেনা, সন্দেহজনক অপর?

Advertisement

ইশকুলের বইতে সাদা গেরুয়া সবুজের ফালি ফালি রং, বা সারে জঁহাসে আচ্ছা, বন্দে মাতরম্ লেখা পাতা, ঝাপসা ম্যাটমেটে ছাপা ছবিতে গাঁধী আজাদ অম্বে়ডকর, সব ঘেঁটেঘুঁটে থাকা আমার ভারতেতিহাস চেতনা এখন আর ক’জনের পোষাবে? উচিত কি আদৌ এমন ঘেঁটে থাকা? তাকে তো বুঝতে হবে, এই দেশনেতাদের ভাবনার মধ্যেও কত না আলাদা চোরাস্রোত বয়ে যাচ্ছে। এত ঝাপসা হয়ে গেছে এই বীতসত্য বা পোস্ট ট্রুথের দুনিয়ায় সব একত্বের সংজ্ঞাই। সত্য কী আর মিথ্যা কী, তাও তো বার বার পরখ করতে হবে ।

ইশকুলের বইগুলো নাকি সব ঠিক লেখে না, এমন বেআক্কেলে কথা কে কবে শুনেছে। কিন্তু আজকের শিশুকে তাও শুনতে হবে। জানতে হবে, বইতে লেখা আছে এক রকম, কিন্তু সত্যিটা আর এক রকম। একটি দেশ, তার হরেক রাজ্য, হরেক রাজ্যের মধ্যে হরেক জাতি, জাতপাত, ধর্মপরিচয়ের রকমফের। ইতিহাসের আলাদা আলাদা বয়ান এ ভাবে তার বহু রূপ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে আমাদের ওপর, কে ভেবেছিল! কোনও একরঙা, মেটে মেটে ভারতের আদল আর সম্ভব নয়।

আপনি যদি মহারাষ্ট্রের মহার কমিউনিটির হন, আপনার কাছে যে ভারতেতিহাস, আপনি যদি ব্রাহ্মণ হন, অন্য। গৌরবে বহুবচন শব্দযুগল ব্যাকরণ থেকে উঠে এসে এখন সত্যি গৌরবের বহু-বাচনে পর্যবসিত। প্রতি মানুষ তাঁর স্ব স্ব জাত, গোষ্ঠী, ধর্ম অনুসারে গৌরবকে সংজ্ঞায়িত করবেন। এমনকী দুর্গাপুজোর সময়ে আপনাকে প্রশ্ন করা হবে, তুমি কোন দলে? অসুরের, না দেবতার? অথচ সিংহ থেকে মহিষাসুরকেও, লক্ষ্মী সরস্বতী দুর্গার সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি খাইয়ে বিদায় করতেন যে মা-মাসিরা, তাঁদের মনে এত সব প্রশ্ন ছিল না তো!

ছোটবেলায় কত সহজ ছিল অবনীন্দ্রনাথের রাজকাহিনির প্রতিটি গল্প নিয়ে বিভোর স্বপ্নকল্পনা। পদ্মিনী-কাহিনিও ছিল। দ্বিধা ছিল না, ভাবনার মধ্যে কাঁটাকাঁটা খোঁচাখোঁচা সংশয়ের কণ্টক ছিল না। এখন, এ সব পড়তে পড়তে এ-ও জানতে হয়, কোন সামাজিক প্রেক্ষিত থেকে লেখা রাজকাহিনি, দেশের গৌরবের ইতিহাস যে পর্যায়ে এসে জ্যোতিরিন্দ্র রবি ঠাকুর অবন ঠাকুরদের হাতে রচিত হচ্ছে, তখন তো আসলে ইংরেজ শাসনের বিপরীতে প্রতিস্পর্ধী এক জাতীয় গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনা ছিল জরুরি। পদ্মাবতীর দীর্ঘ ঈ কেন কাটা যায়, তা বোঝাও জরুরি হয়ে পড়ছে না কি তাই?

আমাদের ইশকুল জীবনে সবুজ খেলার মাঠের সবুজতা যতটাই ছিল গভীর, অজ্ঞতার স্বর্গ ততটাই ছিল নিশ্চিত, আর শিবাজি-শায়েস্তা খাঁয়ের লড়াই অবাধে পুনরভিনয় করাও ততটাই সহজ। যে কোনও দ্বৈত কত সপাটে ঢুকে পড়ত আমাদের মাথায়। ভাল খারাপ, সাদা কালো। শত্রু মিত্রও। ইতিহাস বই থেকে জীবনে ঢুকে পড়ত নাটক। এখন ফিরে পড়তে হয় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি, দেখে নিতে হয় ধর্মের একপেশেমি-চড়ানো কাহিনিসূত্রকে। তুঙ্গভদ্রার তীরে আমার ১৪-১৫ বয়সের চোখে ছিল কেবলই প্রেমের আখ্যান। আজ বিজয়নগর বনাম গোলকুণ্ডার গল্পটা কতটা একতরফা, তা-ও দেখে নিতে হয়।

এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে সে দিন শুনে ফেললাম আবার, বিবিধ ভারতী। রেডিয়ো ছিল না বহু দিন। সহসা খুঁজে পাই এক অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো অ্যাপ। এখন মোবাইল ফোনেও রেডিয়ো। বিবিধ ভারতী।

বিবিধ ভারতী নামটাকেই কেমন যেন গা ছমছমে ধরনের মনে হয়, অলৌকিক। বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান। আবার, আবার। সত্যি, আর যে-ই না রাতবিরেতের এই গানের অনুষ্ঠান চালু, আমিও ভাবি, আমাকে গতজন্মে নিয়ে গেল কে যেন। এখনকার বিভ্রান্ত, বীতসত্য, গোলমেলে ভারতীয়ত্বের বাইরে। পলিটিকাল কারেক্ট আর ইনকারেক্টের বাইরে, এক স্বপ্নময় ভারতবর্ষে।

কী সব পুরনো গান বাজে। বাজে আশা ভোঁসলের গলায়। মহম্মদ রফির গলায়। মধ্যরাতের সরু তার রিনরিন করে। গান শুনতে চেয়েছেন কারা? আওরঙ্গাবাদ থেকে গিরিশ ও তবসসুম। মোতিহারি থেকে বিপিন অউর সুমিত। রামদেওরা থেকে ইমতিয়াজ আলি। ১৯৪৮-এর শহিদ ছবির গান শুনতে চেয়েছেন ইটারসি থেকে মুহম্মদ আলম। তাতিসিলওয়াই থেকে লখমন চৌবে।

আমি ঘুমের অতলে তলিয়ে যাই। ট্রেনের ভোঁ বাজে। বি-বি-ধ ভা-র-তী। সময়ের সিঁড়িগুলো পেছনের দিকে দ্রুত ঘুরছে আর অন্ধকারের ভেতর তলিয়ে খুঁজে নিচ্ছি ভূগোল পড়া, পাশের বাড়ির থেকে ভেসে আসা বিবিধ ভারতীর গান। আমাদের বাড়িতে চলত না ওটা। পানের দোকানে বা পাশের বাড়িতে ছাড়া কোথাও চলত না। টিং টং বিজ্ঞাপন, খুব খারাপ শিশুমনের ওপর নাকি। তাই মা বলত... কিন্তু কান তো বন্ধ হত না। পেনসিল আরও ছুঁচলো করতে করতে শুনতাম ঝুমরিতালাইয়া থেকে রুকসানা বেগম, পাঠানকোট থেকে গুরশরণ কৌর শুনতে চেয়েছেন ১৯৫২ সালের ‘বেওয়াফা’ ছবির গান। তালাত মাহমুদ। তু আয়ে না আয়ে তেরি খুঁশি। কত যে অজানা জায়গা মনশ্চক্ষে ফুটে ফুটে উঠে মিলিয়ে যায়। মানচিত্র ঘেঁটে যায়, ঝাপসা হয়ে যায়। ভারতে ম্যাপে পেনসিল বোলাচ্ছি। ত্রিকোণাকৃতি, পরোটার মতো ভারত।

ওহ... ২০১৮-র জানুয়ারির রাত্তির দীর্ঘ সাপের মতো পেঁচিয়ে নিচ্ছে আমায়। কী নিশ্চিন্তি, কিচ্ছু পালটায়নি। আমার ভারতবর্ষ একই আছে... রামপুর রামদেওরা মহম্মদ গুরশরণ দশরথ... আওরঙ্গাবাদ মোগলসরাই… জায়গার নামে লেগে আছে গরম চায়ের গন্ধ, উনুনের ধোঁয়ার চোখ জ্বালা করা বাতাস। এই জানুয়ারিতেও তা হলে আছে সেই সব ঝুমরিতালাইয়ার মতো প্রান্তিক টাউন, গঞ্জ? সেই সব শুনশান রেলস্টেশন, একটিমাত্র গাছের তলায় পাতা একটিমাত্র দড়ির খাটিয়া। চোখে মোটা পুরু চশমায় একাকী স্টেশনমাস্টার, কে জানে তার নাম কী। শত্রুঘ্ন না ইসমাইল। সে কী খায়, কী ভাবে বাঁচে। তারা কী অধীর আগ্রহে হলুদ পোস্টকার্ড পাঠায় রেডিয়ো স্টেশনে আর সেই রেডিয়ো খুলে বসে থাকে রোজ, মাসের পর মাস, কখন, কবে, কোন গানের সঙ্গে তার নাম ডাকা হবে। শুনতে চেয়েছেন অমুক জায়গা থেকে তমুক...।

আহ, আরামে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি। মনে হয় আমার ভারত একই আছে, এখনও। আমার ভারত নিটোল। তার জনগণের মনও নিটোল।

বিভ্রান্ত ভারতীয়ের পক্ষে এখন, এই নস্টালজিয়া আর ঘুম, এটাই ওষুধ। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে কিন্তু চিনে নিতে হবে কে কোথায় দাঁড়িয়ে, কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যে। অথবা কোনটা কার সত্য। দুর্ভাগা ওরা, ওদের জন্য গলার কাছে ব্যথা ব্যথা করা কোনও ঝাপসা মধুর দেশপ্রেম আর রইল না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement