বলিহারি যাই ব্যাসদেবের। যাকে বলে ভারতীয় সভ্যতার কলঙ্ক। নইলে স্বামীর হাতে বিবাহিতা স্ত্রীর ধর্ষণের কাহিনি এ ভাবে সাতকাহন করে কেউ বলে! পঞ্চপাণ্ডবের পিতা পাণ্ডুর কথাই ধরুন! রাজপ্রাসাদ ছেড়ে দুই স্ত্রী কুন্তী ও মাদ্রীকে নিয়ে তখন অরণ্যে বাস করেন। বিভিন্ন দেবতার ঔরসে পাঁচ পুত্রের জন্মও হয়ে গিয়েছে। তার পর এক দিন ফের এল বসন্তকাল। গাছে গাছে ফুল, ভ্রমর চঞ্চল। পাণ্ডুর একটু আগে আগে হাঁটছেন ছোট বউ। সূক্ষ্ম পোশাক। সি থ্রু। পাণ্ডু তাঁকে দেখে কামবেগ সামলাতে পারলেন না, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। মাদ্রী বাধা দিতে গেলেন। তাঁর মনে আছে, অতীতে এক ঋষি শাপ দিয়েছিলেন, সঙ্গমকালে পাণ্ডুর মৃত্যু হবে। কিন্তু, মেন উইল বি মেন! মহাভারতের বর্ণনা: মাদ্রীং মৈথুনধর্মেণ সোহস্বগচ্ছদ্বলাদিব। হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ লাইনটির বাংলা অনুবাদে জানাচ্ছেন, পাণ্ডু বলপূর্বক মাদ্রীর সহিত মৈথুনে প্রবৃত্ত হইলেন।
স্ত্রীর সঙ্গে বলপূর্বক এই মৈথুন যুগযুগান্ত ধরে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে যায়, অবস্থা বদলায় না। ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু, সবাই পুরুবংশের। দুষ্মন্ত, যযাতি, নহুষ এঁদের পূর্বপুরুষ। বংশলতিকায় তারও আগে ছিলেন পুরুরবা। বিখ্যাত সেই রাজা স্বর্গের অপ্সরা উর্বশীকে বিয়ে করেছিলেন। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৯৫ নম্বর সূক্তে আছে, উর্বশী কেন স্বামী পুরুরবাকে ফেলে স্বর্গে চলে যাচ্ছেন। উর্বশী বলছেন, তুমি কথা দিয়েছিলে, দিনে মাত্র তিন বার আমরা রমণ করব। সেই শর্ত মানোনি, সময়ে-অসময়ে বারংবার বিদ্ধ করেছ আমাকে। স্বামী যত বার যত ভাবে চাইবেন, উর্বশীকে তত বার মেনে নিতে হবে? সূক্তটি তারই প্রতিবাদ।
কিন্তু এ সব শোনে কে? কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র-প্রতিমন্ত্রী হরিভাই পরতীভাই চৌধুরী রাজ্যসভায় সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘বৈবাহিক ধর্ষণের ধারণা ভারতীয় সংস্কৃতিতে প্রযোজ্য নয়।’’ প্রাচীন যুগে ঋগ্বেদের সূক্তকার প্রতিবাদী উর্বশীকে স্বর্গে ফেরত পাঠাতে পারেন, ব্যাসদেব পাণ্ডুর মৃত্যু ঘটাতে পারেন, কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর সরকার বৈবাহিক ধর্ষণ আটকাতে এখনই আনবে না কোনও বিল। ঋগ্বেদ, মহাভারত, দুটোই বোধ হয় ভারতীয় সংস্কৃতি নয়!
কিন্তু ইন্দ্র, সূর্য প্রমুখ দেবতারা? তাঁরাও কি নন ভারতীয়? সূর্যের স্ত্রী সংজ্ঞা। তিন সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরও সূর্যের তেজ সহ্য না করতে পেরে উত্তরকুরু দেশে পালিয়ে গেলেন। ঘর ছাড়ার আগে রেখে গেলেন তাঁরই এক প্রতিমূর্তি। ছায়া। সূর্য স্ত্রী ভেবে তাঁর সঙ্গেই সহবাস করলেন, সন্তানও জন্মাল। ইতিমধ্যে তিনি সংজ্ঞার ছলনা টের পেয়ে ঘোড়ার বেশে সটান উত্তরকুরুতে হাজির হলেন। অশ্বীরূপিণী স্ত্রীর সঙ্গে মিলনে জন্মাল অশ্বিনীকুমার নামে দুই পুত্র। স্বামীর কামনার জ্বালায় দূরে পালিয়ে গেলেও নিস্তার নেই। সাধে রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যান: বিবাহিতা ভারতীয় নারীদের ৭৫ শতাংশই বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার!
দেবরাজ ইন্দ্রই বা কম কীসে? পুলোমা দানবের কন্যা শচীর প্রেমে পড়ে তাকে ধর্ষণ ও বিয়ে। এ বার পুলোমা তাঁকে মারলে? ভয় পেয়ে শ্বশুরকে হত্যা করলেন দেবরাজ। মন্ত্রী-মশাই ঠিক বলেছেন। ভারতীয় বিবাহবন্ধন অতি পবিত্র। ধর্ষণ, খুনজখম কিছুই বাদ যায় না। মনুর বিধান, ঘুমন্ত, মদ্যপানে বিহ্বল মেয়েকেও গোপনে সম্ভোগ করা যাবে। তার নাম পৈশাচ বিবাহ। মেয়েপক্ষের আত্মীয়স্বজনকে লাঠি দিয়ে মেরে, খড়গ দিয়ে অঙ্গচ্ছেদন করে, ভয়ে চিৎকার ও কান্নাকাটি-করা মেয়েকে জোর করে ছিনিয়ে এনেও বিয়ে করা যায়। তার নাম রাক্ষসবিবাহ। দরকারে মেয়ে, মেয়ের বাবা সবাইকে অর্থ দিয়ে আসুরবিবাহও স্বীকৃত। আট রকম বিয়ের বিধানে পৈশাচ, আসুর সবই স্বীকৃত। বিয়েমাত্রেই ধীরেসুস্থে সপ্তপদী গমন, এমন কথা মনু বলেননি। উল্টে কখন পত্নীগমন করতে হবে সে বিষয়েও নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন। বিয়ের পর দিনই বউয়ের সঙ্গে রমণ নিষিদ্ধ। শুধু ঋতুকালেই সহবাস। অন্য দিকে ঋতুকাল না হলেও পত্নী চাইলে স্ত্রীগমন করা যাবে। কিন্তু শুধু নিজের ইচ্ছার বশীভূত হয়ে সেটি করা অন্যায়। এক দিকে শরীরের ওপর স্ত্রীর নিজস্ব অধিকার মেনে নিলেন, উপরন্তু বৈবাহিক ধর্ষণ আটকাতে স্বামীটিকেও সতর্ক করে দিলেন। লোকে যতই গালমন্দ করুক, মনু কিন্তু আজকের মন্ত্রী-সান্ত্রিদের চেয়েও চিন্তাভাবনায় ঢের বেশি সাবলীল।
এই সাবলীলতার অন্যতম কারণ, দুটি ধারণার তফাত। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ নম্বর ধারাটি আজও ঔপনিবেশিক আঁস্তাকুড়ে: কোনও পুরুষ যদি স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হন এবং স্ত্রীর বয়স ১৫ বছরের বেশি হয়ে থাকে, সেটি ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে না। মনু বা মহাভারত নয়, টমাস ব্যাবিংটন মেকলে সাহেবই আমাদের দেশকে বৈবাহিক ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচিয়ে গিয়েছেন। সাধে স্বরাষ্ট্র-প্রতিমন্ত্রী সংসদে সে দিন উপনিবেশের শেখানো জাতীয় সংহতির স্লোগান আউড়েছেন: বিচিত্র বিশ্বাস, বিচিত্র মূল্যবোধ ও ধর্মীয় বিশ্বাস সত্ত্বেও এ দেশে সবাই একটি বিষয়ে একমত। বিয়ে ব্যাপারটি পবিত্র। সেখানে ধর্ষণের প্রসঙ্গ আসে না। গুজরাতসন্তান হরিভাই খেয়াল করেননি, তামিল মহাভারতে আছে অলি-র কাহিনি। সুন্দরী অলি অর্জুনের বিবাহপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অর্জুন তখন কৃষ্ণের শরণাপন্ন হন। কৃষ্ণ অর্জুনকে সাপে পরিণত করে অলির বিছানায় গিয়ে ভয় দেখাতে বলেন। অলিও তখন সাপের রূপ ধারণ করে অর্জুনকে বিয়ে করেন, রতিক্রিয়ায় মগ্ন হন। সাপের ভয় দেখিয়ে বউকে সহবাসে বাধ্য করায় কি থাকে না বৈবাহিক ধর্ষণ?
ভারতীয় সমাজ যদি এই বৈবাহিক ধর্ষণ রোধ করতে চায়, উপনিবেশের হাতফেরতা ধারণা ছেড়ে ঋগ্বেদ, মহাভারতীয় চিন্তায় ঢুকতে হবে। উপনিবেশের ধারণা, পেনিট্রেশন বা লিঙ্গপ্রবেশ ঘটলে ধর্ষণ। রামায়ণ, মহাভারতে আবার ধর্ষণ আসে ‘ধৃষ’ ধাতু থেকে। মানে হিংসা। নারীর প্রতি যে কোনও হিংসাই ধর্ষণ। কীচক রান্নাঘরে গিয়ে সৈরিন্ধ্রীকে পেনিট্রেট না করলেও, জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে জোর করে রথে তুলে নিলেও মহাভারত তাকে প্রায় ধর্ষণ হিসাবেই দেখে।
সমাজের নেতারা অবশ্য এক তিমিরে। আজ হরিভাই এক রকম বলছেন। অন্য দিকে, নির্ভয়া কাণ্ডের পর বর্মা কমিশন যখন বৈবাহিক ধর্ষণকে আইনের আওতায় আনার কথা বলেছিল, তৎকালীন ইউপিএ সরকারের অস্ত্রও ছিল অখণ্ড নীরবতা।
এই নির্লজ্জ নীরবতা আর যা-ই হোক, ভারতীয় সংস্কৃতি নয়। বাল্মীকি রামায়ণে অরণ্যকাণ্ডে রাম-সীতা বনে যাচ্ছেন। সীতা রামকে বেশ বকুনি দিলেন, ‘মুনিঋষিদের তপস্যাস্থলে তিরধনুক নিয়ে হাঁটছ কেন? তোমার চরিত্রেই হিংসা আছে।’ তখনও অগ্নিপরীক্ষা, পাতালপ্রবেশ সব অনাগত ভবিষ্যৎ।
ভারতীয় সংস্কৃতি এ ভাবেই বিচিত্র ফাঁকেফোকরে বৈবাহিক হিংসার কথা বলে গিয়েছে। নেতারা বুকের ছাতি ফুলিয়ে যা খুশি বলুন কিংবা সুবিধে বুঝে নীরব থাকুন, উর্বশী, সংজ্ঞাদের তাতে কিছু যায় আসে না।