—প্রতীকী চিত্র।
সমাজের সৌভাগ্য— অতি-আধুনিকতা তাহাদের এখনও গ্রাস করে নাই। রিজওয়ানা খাতুন এবং জয়া শর্মার কাজকর্ম ও দায়িত্ববোধের মধ্যে এখনও প্রাক-আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট। এক অসুস্থ, অচৈতন্য বৃদ্ধ পথচারীকে উদ্ধার করিয়া এই দুই সপ্তদশী হাসপাতালের দরজায় পৌঁছাইয়া দিয়াছে। শুধু তাহাই নহে, আত্মীয়সম স্নেহে অচেনা মানুষটির সাধ্যমতো চিকিৎসা এবং পথ্যের ব্যবস্থাটুকুও করিয়াছে। এই শিক্ষা এবং মানসিকতা তো একমাত্র প্রাক-আধুনিক কালেই দেখা যাইত। সেখানে শৈশব হইতেই শিক্ষা মিলিত দরিদ্র, আর্তের সেবা করিবার। সকলেই যে তাহা সমান ভাবে গ্রহণ করিতে পারিত, তাহা নহে। কিন্তু কিছু স্বাভাবিক মানবিকতাবোধ ছিল। দিনের বেলা শহরের রাজপথে কেহ মরিতে বসিলে এক গণ্ডূষ জল অন্তত মিলিত। আধুনিক সভ্যতা তাহার সন্তানদের শিখাইয়াছে, পৃথিবী আত্মময় এবং আত্মসর্বস্ব। অচেনা, অসুস্থ, মৃতপ্রায়, নির্যাতিতকে পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার বা নিরাপদ দূরত্ব হইতে তামাশা দেখিবার নামই তো ‘আধুনিকতা’।
এমন আধুনিকতাই এখন স্বাভাবিকতায় পর্যবসিত। এখানে দুই ধরনের মানুষ থাকেন। এক শ্রেণি প্রতি মুহূর্তে নিজ অভীষ্টে পৌঁছাইবার জন্য এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকেন। তাঁহাদের দৃষ্টি সেই লক্ষ্য হইতে সচরাচর নড়ে না। এক প্রবল নিরাপত্তাহীনতা তাঁহাদের কুরিয়া খায়। অন্যের জন্য এক সেকেন্ড বাড়তি সময় খরচ করিতে হইলেও তাঁহারা নিজেদের লক্ষ্যচ্যুত ভাবেন। নোটবন্দির সময় এটিএম-এর লাইনে ইঁহাদের অনেককেই দেখা গিয়াছে। লাইনেরই অন্য মানুষটি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হইয়া মৃত্যুর দিকে ঢলিয়া পড়িলেও তাঁহারা নিজ অভীষ্ট, অর্থাৎ বরাদ্দ দুই হাজার টাকা তুলিতেই ব্যস্ত ছিলেন। অন্য শ্রেণিটির হাতে আবার অঢেল সময়। তাঁহারা তুলনায় ধীর গতির এবং পরিপার্শ্বের মজা লুটিতে ভালবাসেন। সামনে শ্লীলতাহানি ঘটিলেও তাঁহারা নির্বাক দর্শক সাজিয়া বসিয়া থাকেন। মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটিলে সেই মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দি করিতে অধিক আগ্রহী হন। রিজওয়ানারা এই দুই শ্রেণির বাহিরে। তাহারা সরল মনে জীবনকে দেখিতেই অভ্যস্ত, যে মন বলে, আর্তকে সাহায্য করিতে হয়, কারণ তাহাই মানুষের ধর্ম। দুর্ভাগ্য, অতি আধুনিকতার চাপে রিজওয়ানাদের সংখ্যা ক্রমশ কমিতেছে।
কমিবারই কথা। পরিবর্তিত মানসিকতা তাহার একটি কারণ, একমাত্র নহে। পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতার অভাবেও পরোপকারীর নাভিশ্বাস উঠিয়া যায়। অচেনা অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে লইয়া যাইবার পরে যে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ এবং হাসপাতালের হয়রানির সম্মুখীন হইতে হয়, তাহাতে পরোপকারের উৎসাহ উবিয়া যাইতে সময় লাগে না। সাধারণ মানুষের প্রতি এই রাজ্যের পুলিশ এবং সরকারি হাসপাতালের বন্ধুভাবাপন্ন হইতে এখনও ঢের বাকি। দুই কিশোরীর পরিবারও প্রথমে সেই থানা-পুলিশের ভয় পাইয়া মেয়েদের থামাইতে চাহিয়াছিল। কৈশোরের উৎসাহ সেই বারণ শোনে নাই ঠিকই, কিন্তু ইহাকে ব্যতিক্রমই বলা যায়। এ হেন ‘ভয়’টি না থাকিলে হয়তো সমাজে উপকারী মানুষের সংখ্যা কিছু বাড়িত। আরও কিছু অসুস্থ পথচারী ন্যূনতম চিকিৎসাটুকুর সুযোগ পাইতেন।