দুটি দেশের সীমান্ত ঘিরে উত্তেজনার সঙ্গে দুটি পাশাপাশি বসবাসকারী পরিবারের ঝগড়ার যে তেমন মিল নেই, তা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ বা অর্থনীতিবিদরা যতই মনে করিয়ে দিন না কেন, মানুষজন কিছুতেই মেনে নেবেন না। না হলে এমন উত্তেজনার মধ্যে প্রথমেই পণ্য বয়কটের কথা মাথায় আসে কেন? ঝগড়ার অব্যবহিত আগে পর্যন্ত হয়তো এ বাড়ি থেকে মালাইকারি আর ও বাড়ি থেকে ফিশফ্রাইয়ের আদানপ্রদান চলছিল দিব্যি। কিন্তু ওর পাঁচিলের ন্যাজটা তিন ইঞ্চি এ দিকে সরে এল কেন, এ নিয়ে যেই ফাটাফাটি শুরু হল কর্তাদের মধ্যে, তৎক্ষণাৎ সব বন্ধ। ছন্দার হাতের ফিশফ্রাইটা এ বাড়ির বাবলুকে যতই বিমোহিত করুক না কেন, সুসম্পর্ক চলতে পারে না এমতাবস্থায়। ইজ্জত কা সওয়াল।
একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে, ইজ্জত রক্ষার লড়াইয়ে দুই পরিবারের সুসম্পর্ক নষ্ট হলেও তাদের আর্থিক ক্ষতি তেমন নেই। সবটাই মানসম্মানের ব্যাপার। অবশ্য ঝগড়াটা আদালত পর্যন্ত গড়ালে খরচ আছে। কিন্তু সম্পর্কটি যখন দুটি দেশের মধ্যে, সে সম্পর্কের অবনতিতে মর্মান্তিক জীবনহানি ছাড়াও দু’দেশেরই বস্তুগত ক্ষতির পরিমাণও বিস্তর, যে হেতু বৈদেশিক সম্পর্কের অনেকটাই অর্থনৈতিক। আর সে জন্যেই দুটি দেশের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটিতে বিস্তর স্নায়ুর লড়াই চলে, লাভক্ষতির হিসেব মাথায় রেখে চলতে হয়। মুখ্যত কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশল, চোখে চোখ রেখে নরমগরম হুমকির ব্যাপার। দু’পক্ষই চায় ক্ষতিটা যেন অল্পের ওপর দিয়ে যায়। কিন্তু পণ্য বয়কটের ডাকে স্পষ্টতই মগজাস্ত্র কম, আবেগ বেশি। আর, অভিজ্ঞ রাষ্ট্রনেতারা যে এই আবেগকে প্রভূত গুরুত্ব দেবেন, তা এক রকম স্বতঃসিদ্ধ। ‘শত্রু’দেশ যখন ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে, দেশরক্ষায় চলে যায় অমূল্য জীবন, এমন অবস্থায় দ্বেষ, ক্ষোভ, আবেগ থাকবে না, তা হয় না।
কিন্তু রাস্তায় নেমে এই মুহূর্তে চিনা পণ্য বয়কটের ডাক দিলে গাড্ডায় পড়ে যেতে পারেন, কারণ আপনার মুঠোয় ধরা ফোনটি যে চিনা! ধরা যাক আপনি এ নিয়ে হুঁশিয়ার, হাতে নিয়েছেন অ-চিনা ফোন। যদিও কাজটি সহজ নয়, কারণ ভারতীয়দের হাতে যত স্মার্টফোন রয়েছে তার ৭২ শতাংশই তো চিনা। আপনি পেটিএম-এ চিনা পুঁজি আছে বলে সেটিও উড়িয়ে দিয়েছেন ফোন থেকে। কিন্তু আপনার জানা ছিল না লাগাতার পেট খারাপ সারাতে ডাক্তারবাবু যে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধটি লিখেছিলেন, যাকে আপনি জানতেন হায়দরাবাদের দেশি কোম্পানির তৈরি, তার কাঁচামালটি এসেছে চিন থেকে। তাই ভয়টা থেকেই যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি আচমকা ঘোষণা করে বসেন, ‘আজ রাত্রি বারোটার পর থেকে…?’ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে তাঁর আকস্মিক ঘোষণার পরম্পরার সঙ্গে আমরা এখন বিলক্ষণ পরিচিত, এবং যারপরনাই ভীত। রাতবিরেতে কোথায় লাইন দেব অ-চিনা কাঁচামালে প্রস্তুত পেট খারাপের ওষুধ সংগ্রহ করতে? ভারতে তৈরি যাবতীয় ওষুধবিষুধে থাকে যে ‘অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট’, তার চার ভাগের তিন ভাগই তো আসে চিন থেকে। কিন্তু ফেসবুক গর্জে উঠে বলবে, এ সব ছোটখাটো ব্যক্তিগত স্বার্থ নিয়ে ভাবার সময় নয় এখন। এখন দুর্বৃত্তকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার সময়। নো চাইনিজ়।
যুদ্ধ পরিস্থিতি কেন হয়, কেনই বা হল এখনই, সে সব জটিল প্রশ্নের আলোচনা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা করবেন। আমার মাথাব্যথা ওই বয়কট নিয়ে। বিভ্রান্তি দূর করতে প্রথমেই বলে রাখি, এ দেশীয় বামপন্থীদের অনেকেই যেমন চিনের প্রসঙ্গে অকারণ চিত্তদৌর্বল্যে ভোগেন, কিংবা না ভুগলেও (রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে তা জানাতেও হচ্ছে নেতাদের) তাঁদের শত্রুপক্ষ তাঁদের সম্পর্কে যেমনটা ভেবে থাকেন, আমার তেমন ব্যামো নেই। তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সরল অঙ্ক এবং মানুষজনের ভালমন্দের নিরিখেই আমি এ আলোচনা করব। অতএব চিনের জায়গায় অন্য যে কোনও প্রতিবেশী দেশের ক্ষেত্রেই যুক্তিগুলি মোটামুটি একই থাকবে।
দু’দেশের বাণিজ্য হয় দু’পক্ষের প্রয়োজন থেকে। আমরা যেমন চিনা টুনিবাল্বের মালা দিয়ে সস্তায় দীপাবলি সাজিয়েছি, আমেরিকানরা যেমন চিনা বাজি পুড়িয়ে প্রতি বছর ৪ জুলাইয়ে স্বাধীনতা উদ্যাপন করেছেন, চিনারাও কিনেছেন আমাদের সুতো তামা পাথর। পাথর? আজ্ঞে হ্যাঁ। অতি-দামি এবং মধ্য-দামি টুকরো পাথর থেকে শুরু করে গ্র্যানাইট। কিন্তু চিনা ইলেকট্রনিক্স থেকে শুরু করে খেলনাপাতি বা গণেশমূর্তি আমরা যে রকম হামলে পড়ে কিনেছি, চিনারা কিন্তু তেমন কেনেনি। তা ছাড়া তামা, পাথর কতই বা কেনা যায়, দেশটা একশো চুয়াল্লিশ কোটির হলেও। চিনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যের পণ্যগুলির দিকে দেখলে একটা জিনিস নজরে পড়বেই— আমরা সে দেশ থেকে যেগুলি আমদানি করেছি, তাতে প্রাকৃতিক উপাদানের থেকে প্রযুক্তির উপস্থিতি বেশি, কারণ আমদানির অর্ধেকই ইলেকট্রনিক্স বর্গের। কিন্তু আমাদের রফতানির ক্ষেত্রে ঠিক উলটো— তামা বা পাথরকে বিক্রয়যোগ্য করতে প্রযুক্তির অবদান অতি সামান্য। তাই চিন থেকে আমদানি যেমন আমাদের মোট আমদানির প্রায় ১৫ শতাংশ, আমাদের রফতানির মাত্র ৪ শতাংশ যায় চিনে। ফলে চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যে ঘাটতি আছে বিপুল। সে ঘাটতি অন্য দিকের উদ্বৃত্ত দিয়ে পূরণ করতে হয়। অঙ্কটা এ রকম। রফতানি করলে আমাদের ভাঁড়ারে ডলার আসে, আর আমদানিতে ডলার বেরিয়ে যায়। সামগ্রিক ভাবে রফতানি কম করেও বেশি আমদানি করে যাওয়া যায় যদি অন্য ভাবে ডলার আসে ভাঁড়ারে, যা দিয়ে আমদানির বিল মেটানো যাবে। এ কাজটি অনেকটা করে বিদেশি বিনিয়োগ, যা ডলার-রূপে প্রবেশ করে। এক দিকে চিন থেকে আমদানি যেমন ক্রমশ বেড়েছে, অন্য দিকে বেড়েছে ভারতে চিনা পুঁজির বিনিয়োগ। ফ্লিপকার্ট থেকে জ়োম্যাটো, ওলা থেকে সুইগি— এমন অনেক কোম্পানিতেই এসেছে চিনা পুঁজি। ভারতের স্টার্ট-আপ কোম্পানিগুলির দুই-তৃতীয়াংশ বিনিয়োগই চিনা। বয়কটের উদ্দেশ্য যদি হয় আত্মমর্যাদা রক্ষা এবং অপরাধের শাস্তি, তা হলে তা পণ্যেই আটকে থাকতে পারে না, সঙ্গতি রাখতে চিনা পুঁজিও বয়কট করতে হবে। কিন্তু, চিনা পুঁজি যে শুধু চিন থেকেই আসছে তা তো নয়, সিঙ্গাপুরস্থিত কোনও চিনা সংস্থা যদি সেখান থেকে ভারতে বিনিয়োগ করে, বলার উপায় নেই সেটি চিনা কি না। চিনা পণ্যের মতো চিনা পুঁজি খুঁজতেও হয়রান হতে হবে।
বস্তুত, ভারতের যত্রতত্র চিনা লগ্নির শিং বাগিয়ে ঢুকে পড়া নিয়ে কোনও কোনও মহলে উদ্বেগ বাড়ছিলই। অতি সম্প্রতি ভারত মুক্ত অর্থনীতির উল্টো পথে হেঁটে চিন এবং হংকং থেকে আসা পোর্টফোলিয়ো বিনিয়োগের (যা শেয়ার বাজারে ঢোকে, সরাসরি উৎপাদন সংগঠনে ‘প্রত্যক্ষ’ বিনিয়োগ নয়) ওপর কিছু বাধানিষেধ চাপিয়েছে। এ সব যেমন রয়েছে এক দিকে, অন্য দিকে আমেরিকার দিকে ইঞ্চি ইঞ্চি এগোনোও রয়েছে। সব মিলিয়ে ভারত-চিন সম্পর্কে জটিলতা বাড়ছিলই। অথচ আধুনিক বিশ্ব অর্থনীতিতে পণ্য ও পুঁজির চলাচল এমন জটিল জালে জড়িয়ে পড়ে, সেখানে সম্পর্ক ছিন্ন করব বললেই করা যায় না। এ সব ভেবেই কি না জানি না, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ‘আত্মনির্ভরতা’র কথা, আগে বলেছিলেন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’।
‘মেক’ তো বললেন, কিন্তু বানাবেই বা কে আর কিনবেই বা কে? একটি সরল সত্য হল, চিনা পণ্য সস্তা, আর সস্তা বলেই মানুষ কিনছে, তাই আমদানিও হচ্ছে। আমদানি না করে সেগুলি এ দেশে বানাতে গেলে আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হয়। কিন্তু তা করা যায় না এখন, ডব্লুটিও আটকে দেবে। বিশ্বব্যাপী বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা— যা সব দেশের হয়ে নজরদারি করে— আমদানির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক চাপানো বা সরাসরি নিষেধাজ্ঞা বরদাস্ত করে না। তা হলে একমাত্র উপায় হল চিনা পণ্যকে দামের প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দেওয়া। দেশি ‘মেক’ও হল, সস্তাও হল। কিন্তু সে অনেক হ্যাপা। তার চেয়ে রাজনৈতিক মহলে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে কয়লা তামা তেল বক্সাইটে মালিকানা বাগিয়ে নিতে পারলে অনেক কম আয়াসে বিপুল লাভ। একগুচ্ছ বড়সড় ভারতীয় কোম্পানির লাভের উৎস নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে প্রাকৃতিক সম্পদে মালিকানাই তাদের লাভের প্রধান উৎস, নতুন প্রযুক্তি বা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নয়। তাই চিনা পণ্য বয়কটান্তে নাকের বদলে নরুন ভবিতব্য। আপাতত আমাদের শত্রু ‘দুর্ধর্ষ চৈনিক দস্যু ঘচাং ফুঃ’ (‘চারমূর্তি’ স্মর্তব্য)।
অর্থনীতি বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা