শবরীমালা রায়: গোষ্ঠীর অধিকারের আগে ব্যক্তির অধিকার
Supreme Court

বিচারপতিরা যা বলতে চান

সমাজের ভিতর এবং তলা থেকেই যদি সংস্কারের দাবি না আসে, তা হলে বাইরে থেকে সংস্কার চাপিয়ে দেওয়া কি উচিত কাজ? রাষ্ট্রকে এক বার এতখানি ক্ষমতা দিয়ে ফেললে রাষ্ট্র তো ভাল কাজের সঙ্গে অনেক খারাপ কাজও করে ফেলতে পারে। তখন, খারাপ কাজের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে আটকাব কোন যুক্তিতে? এই যে আমরা হরদম লিখি, রাষ্ট্রের ‘জ্যেষ্ঠতাতসুলভ ব্যবহার’ ইত্যাদি, সেগুলো কেন এখন বলছি না, শবরীমালার রায়ের বিপক্ষে?

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৮ ০০:১০
Share:

শবরীমালা মন্দির। ফাইল চিত্র।

আমরা যারা নিজেদের প্রগতিশীল বলে মনে করি, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি ইন্দু মলহোত্র তাদের এক মহা সঙ্কটে ফেলেছেন। শবরীমালা মন্দিরে দশ থেকে পঞ্চাশ বছরের ‘ঋতুযোগ্য’ মেয়েরা প্রবেশ করতে পারবে না— বহু বছরব্যাপী এই ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের রায়টি বেরোলে দেখা গেল, পাঁচ বিচারকের সাংবিধানিক বেঞ্চে একমাত্র একা মহিলা বিচারপতি ইন্দু মলহোত্র ঐতিহ্যের সপক্ষে রায় দিয়েছেন। অর্থাৎ বাকি চার জনের ঐতিহ্যের বিপক্ষে মতের উল্টো দিকে তাঁর ঐতিহ্যের সপক্ষে মতটি হয়ে দাঁড়িয়েছে একমাত্র বিরুদ্ধ কণ্ঠ বা ‘ডিসেন্ট’। মলহোত্রের দীর্ঘ বলিষ্ঠ বক্তব্যকে একটি বাক্যে প্রকাশ করার ধৃষ্টতা দেখালে বলতে হয়: ধর্ম বা ধর্ম-ঐতিহ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বাঞ্ছিত নয়, এই তাঁর মত। ওই মন্দিরে মহিলারা প্রবেশের অনুমতি পাবেন কি না, সেটা একান্ত ভাবে ওই মন্দিরের ধর্মোপাসকরাই ঠিক করবেন।

Advertisement

লিবারালরা এখন কী করবেন? মন্দিরে মেয়েরা ঢুকতে পারবেন না, এত বড় বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাটাই তাঁরা মেনে নেবেন? না কি মন্দিরের (ধর্মের) ব্যাপারে রাষ্ট্র মাথা ঘামাবে না, এটা মানাই উচিত কাজ হবে? সাঁড়াশি সঙ্কট আর কাকে বলে!

তবে এ কেবল দেশের হাতে-গোনা লিবারালদের সমস্যা বলেই মনে হচ্ছে। রায় জানার পর থেকেই কেরলবাসীরা দলে দলে প্রমাণ করে দিচ্ছেন যে তাঁদের তেমন কোনও সঙ্কট নেই, তাঁদের মত স্পষ্ট ও এককাট্টা। তাঁরা মন্দিরের ঐতিহ্যের পক্ষে। সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহ্য-বিনষ্টকারী রায়ের বিপক্ষে। হাজার হাজার মানুষ ঝান্ডা হাতে নেমে পড়েছেন, ‘সেভ শবরীমালা’। আর কী চরম আশ্চর্য, মিছিল আন্দোলন বিক্ষোভে সব কিছুতে সামনের সারিতেই দেখা দিচ্ছেন ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়েরা। অর্থাৎ কিনা— মেয়েদের কেন মন্দিরে প্রবেশাধিকার দেওয়া হচ্ছে, এই নিয়ে মেয়েরাই বিষম বিক্ষুব্ধ!

Advertisement

রক্ষণশীলতার এই চিৎকৃত পক্ষাবলম্বন নিয়ে ইতিমধ্যেই লেখা হয়েছে (বিমল লামা, আবাপ, ‘শবরীমালা ও নারী অধিকার’, ১১-১০)। এখানে শুধু এটুকুই বলার যে, দেখতে পাচ্ছি, শবরীমালা নিয়ে অতি-রক্ষণশীল ও অতি-প্রগতিশীলদের অবস্থান এখন বিপজ্জনক রকমের কাছাকাছি। অবাক হওয়ার কিছুই নেই, সমাজে রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকা কত যে অনুচিত, এই মর্মে বাজার থেকে মন্দির বহু প্রসঙ্গেই এঁরা এক সুরে কথা বলেছেন। সেই সব জটে না ঢুকে, অর্থাৎ রক্ষণশীলতার যুক্তি নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে এখানে কেবল বলতে চাই, এত মানুষের মিছিল দেখে আমাদের মতো লিবারালদের সঙ্কট আরও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। মনে হচ্ছে, যাঁরা নিজেদের অধিকার চান না, তাঁদের মাথায় জোর করে অধিকারের বোঝা চাপানোর দরকার কী? এ-ও কি এক ধরনের ‘এলিটিস্ট ইন্টারভেনশন’ বা উঁচু তলার চাপ নয়? সমাজের ভিতর এবং তলা থেকেই যদি সংস্কারের দাবি না আসে, তা হলে বাইরে থেকে সংস্কার চাপিয়ে দেওয়া কি উচিত কাজ? রাষ্ট্রকে এক বার এতখানি ক্ষমতা দিয়ে ফেললে রাষ্ট্র তো ভাল কাজের সঙ্গে অনেক খারাপ কাজও করে ফেলতে পারে। তখন, খারাপ কাজের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে আটকাব কোন যুক্তিতে? এই যে আমরা হরদম লিখি, রাষ্ট্রের ‘জ্যেষ্ঠতাতসুলভ ব্যবহার’ ইত্যাদি, সেগুলো কেন এখন বলছি না, শবরীমালার রায়ের বিপক্ষে?

প্রশ্নগুলো গুরুতর। এবং জটিল। কেরল হাইকোর্ট এক বছর আগে এই সব প্রশ্ন তুলে ধরেই শবরীমালার মন্দিরের ঐতিহ্যকে সমর্থন জানিয়ে রায় দিয়েছিল। এ বার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও এই প্রশ্নগুলো সামনে নিয়েই বসেছিলেন, সংবিধানকে টেবিলে রেখে কেরল হাইকোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে প্রশ্নগুলোর নতুন ভাবে বিচার করতে চাইছিলেন। তাঁদের রায়ের বক্তব্য পুরোটা আলোচনার অবকাশ আমাদের নেই, কিন্তু বিচারের সারাংশটুকু অন্তত জানা ও জানানো খুব জরুরি বলে বোধ হয়। লিবারালদের সঙ্কট থেকে মুক্তির একটা পথও হয়তো তাতে নিহিত আছে।

বিচারের ভাষায়, আদালতের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে হয় ‘হ্যান্ডস-অফ’ নয়তো ‘হ্যান্ডস-অন’ হতে হবে। ‘হ্যান্ডস-অফ’ অর্থে, কেরলের ১৯৬৫ সালে তৈরি ‘কেরালা হিন্দু প্লেসেস অব পাবলিক ওয়রশিপ অ্যাক্ট’-এর ৩(ক) বিধি অনুযায়ী ধর্মীয় আচারে বাইরের হস্তক্ষেপ না করা। আর ‘হ্যান্ডস-অন’ অর্থে, ব্যক্তির সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকারের যুক্তিতে উপরের ৩(ক) বিধিটিকে ‘স্ট্রাইক-ডাউন’ বা অমান্য করা। এখন তা হলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সামনে সমস্যা দাঁড়াল— যদি তাঁদের দ্বিতীয় কাজটি করতে হয়, সে ক্ষেত্রে প্রশ্নটা হয়ে যায় ব্যক্তির অধিকার বনাম ধর্মের অধিকারের। কিন্তু ধর্মের অধিকারের মধ্যেও কি ব্যক্তির ধর্মের অধিকারটা নিহিত নেই? কেরল রাজ্যের কোনও মহিলা যদি বলেন (আন্দোলনকারী কেরলবাসিনী ছাড়াও ভিন্ন মতের মহিলারা সে রাজ্যে আছেন বইকি) যে, মন্দিরে গিয়ে পুজো করতে পারাটাই আমার ধর্মপালনের অধিকার, সেটা আমি চাই! মন্দিরের তথাকথিত ‘বিশুদ্ধতা’ নষ্ট করেও কি সেই মহিলার ধর্মাচরণের অধিকার মানা উচিত?

বিচারপতিরা বলবেন, হ্যাঁ, উচিত। তাতেও কিন্তু সমস্যা ফুরোয় না। দেখা যাচ্ছে, সংবিধানের দুই রকম ধারা দুই দিককে সমর্থন করছে। ২৫(২খ) ধারা বলছে, হিন্দু পূজার্চনার স্থান সমাজের সব গোষ্ঠী সব শ্রেণির জন্য খুলে দিতে পারে রাষ্ট্র। আর সংবিধানের ২৬(খ) বলছে, মন্দিরের নিজস্ব পরিধিতে মন্দিরের নিজস্ব আচরণবিধি থাকতে পারে। বাস্তবিক, ২৫ ও ২৬-এর এই দ্বন্দ্বেই বিচারপতিরা বিশেষ ভাবে গ্রস্ত ছিলেন। তাঁদের ভাবতে হচ্ছিল যে, ব্যক্তির মৌলিক অধিকার খর্ব করেও কি মন্দির তার নিজস্ব আচরণের অধিকার বজায় রাখতে পারে? ২৬ নম্বর ধারা কি ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ধ্বস্ত করার ক্ষমতা রাখে? অর্থাৎ, আরও সরল করে বললে— গোষ্ঠীর অধিকার কি ব্যক্তির অধিকারের উপরে উঠতে পারে?

এই জায়গাটাতে এসেই ইন্দু মলহোত্র ছাড়া অন্য বিচারপতিরা একটা বৃহত্তর যুক্তির উপর নির্ভর করলেন। সেই যুক্তি— ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠার যুক্তি। ভারতীয় সংবিধানের মূল ভরটি শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিকে অধিকারান্বিত করা, এই তাঁরা বুঝেছেন এবং বোঝাতে চাইছেন। গোষ্ঠীর অধিকার তখনই গ্রাহ্য, যখন গোষ্ঠীর মাধ্যমে ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জমি গ্রাস করার বিরুদ্ধতা করে ভারতীয় রাষ্ট্র, কেননা তা দিয়ে— গোষ্ঠী নয়, ব্যক্তির ধর্মাচরণ নিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু গোষ্ঠীর অধিকার যদি সরাসরি ব্যক্তির অধিকারকে সঙ্কুচিত করে? তা হলে কে অগ্রাধিকার পাবে? অবশ্যই, ব্যক্তি। এটাই ভারতীয় সংবিধানের নৈতিকতার মূল পয়েন্ট। সাংবিধানিক নৈতিকতার ভর। যদ্দূর বোঝা যায়, তিন তালাকের বিরুদ্ধে রায়টিও এই যুক্তিতেই গ্রথিত হয়েছিল।

আরও একটা কথা না বললেই নয়। আমরা জানি, ভারতীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্কটা জটিল, মোটেই পশ্চিমি দেশগুলোর মতো নয়, যেখানে ধর্ম ও রাষ্ট্র পরস্পরের থেকে পুরোপুরি আলাদা ক্ষেত্রে বিরাজ করে। ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার মানে ধর্মের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা নয়, বরং সমস্ত ধর্মকে সমান ভাবে কোল দেওয়া। তাই যদি হয়, তা হলে ধর্মের ক্ষেত্রে ভারতীয় রাষ্ট্রের কিছুই বলার থাকতে পারে না— এই যুক্তিও খাটে না। যে কোল দেয়, সে তো প্রয়োজনে শাসনও করতে পারে, এটাই তো সভ্যতার গোড়ার কথা! আশ্চর্য এই যে, আরএসএস ও বিজেপি মনপ্রাণ দিয়ে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধতা করে, আবার শবরীমালার মতো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হাত কেন, রাষ্ট্র কেন নির্বিকার বা নিরপেক্ষ হচ্ছে না, এই মর্মে চেঁচামেচিও জুড়তে পারে! আর কংগ্রেস যে কী করে কী বলে, তা কংগ্রেসই জানে। এই সব ভোট-রাজনীতির মধ্যে ঢুকছি না। তার থেকে বিচারপতিরা কী বলতে চান, সে দিকে মনোযোগ দেওয়াই ভাল। শবরীমালা রায়ও সাম্প্রতিক কালের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে একটি দিকেই ইঙ্গিত করছে—বিচারপতিরা ভারতীয় রাষ্ট্রের ‘এসেন্স’ অর্থাৎ মূলে ফিরতে চান। যেখানে ব্যক্তিকে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্র সতত প্রহরা দেবে। সব রকম অত্যাচার বৈষম্য ও অমর্যাদা থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করবে।

আমরা বাঁচতে চাই কি না, সেটা অবশ্যই আলাদা প্রশ্ন। বিচারবিভাগ করছে, যত দূর সে করতে পারে। আর কেরল দেখিয়ে দিচ্ছে, আমরা হাঁটছি, যত দূর পিছনে হাঁটতে পারি!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement