মা ত্র ৯০টি ভোট পেয়ে তিনি এখন প্রাচীন ইতিহাস। ষোলো বছরের দীর্ঘ উপবাস, নিরলস আন্দোলন, অদম্য জেদের ফল এই? ইরম শর্মিলা চানু, মণিপুরের থৌবল কেন্দ্র থেকে মুখ্যমন্ত্রী ওকরাম ইবোবি সিংহের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। পরাজিত হয়ে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছেন। ইরম ষোলো বছর ধরে থেকেছেন সততার প্রতীক, জেদের প্রতীক, অধিকারের প্রতীক। তিনি চেয়েছিলেন মণিপুর থেকে আফস্পা নামক অন্যায় আইন উঠে যাক। সেটাই ছিল তাঁর লাগাতার অনশন আন্দোলনের পাখির চোখ। কিন্তু অনশন ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর আর থই পেলেন না। অনশনের আত্মবিশ্বাসের পর রাজনীতির উঠোনে ইরমের ঝাপসা, অনিশ্চিত, অনির্দিষ্ট অবস্থান মণিপুরের মানুষকে ভরসা দিতে পারেনি। আসলে মণিপুরের মানুষ ইরমের মধ্যে যা দেখতে পাননি তা হল দৃঢ়তা, বুদ্ধি আর স্ট্র্যাটেজির প্রখর তালমেলে রাজনীতি চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা।
আরও ফাঁক রয়েছে। ইরমের ব্যবহার সাধারণ মানুষের মনে দোলাচল তৈরি করেছে। তিনি তাঁর কাজে অবিচল থাকতে পারেননি। দলের সদস্যদের মধ্যেও বোঝাপড়ার অভাব ছিল। দলের বিভ্রান্তি যদি সাধারণের সামনে প্রকট হয়ে ওঠে, ভাল সংগঠনের কোনও চিহ্ন না থাকে, তা হলে সেই পার্টির ওপর মানুষ ভরসা করবে কী করে? সোজা কথা, ইরম মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। দীর্ঘ কাল তিনি প্রতিবাদের প্রতীক ছিলেন, তখন তাঁকে মানুষ ভালবেসেছিল। এখন তিনি অতীত-প্রতীক, হয়তো মানুষ তাঁকে এখনও ভালবাসে, কিন্তু ভরসা করে দায়িত্ব ছাড়তে পারে না।
অথচ প্রতীক থেকেও যে কী তুখড় রাজনীতি করা যায়, তার উদাহরণ প্রতিবেশী রাষ্ট্রেই আছে। আউং সাঙ সু চি। তিনি গৃহবন্দি ছিলেন দীর্ঘ কুড়ি বছর। অথচ কী নিপুণভাবে পরিকল্পনা করেছেন তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পদক্ষেপ। তিনিও প্রতিবাদের প্রতীক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক ছিলেন। কিন্তু তিনি কেবলমাত্র প্রতীক হয়েই থেকে যাননি। রাজনীতির চাহিদা রাজনৈতিক বুদ্ধি ও সংগঠন দিয়ে মিটিয়েছেন। তিনি উপস্থিত না থেকেও নিয়ত যোগাযোগ রেখেছেন জনসাধারণের সঙ্গে। জনসাধারণের তাঁর প্রতি আস্থা জেগেছে। এবং রাজনীতিটা তিনি রাজনীতির নিয়মেই করেছেন। সে জন্যে নিজের প্রতীক-সত্তাটিকে প্রয়োজনে আড়ালে রাখতে কসুর করেননি। সরে এসেছেন মানবাধিকারের আদর্শ থেকেও। তাঁর দেশের রোহিঙ্গিয়ারা কী নিষ্ঠুর অত্যাচার আর দুর্দশার শিকার হচ্ছে, সে কথা গোটা বিশ্বের জানতে বাকি নেই। কিন্তু নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত সু চি সেই মানবাধিকার লঙ্ঘন দেখেও দেখেননি। হয়তো শেষ বিচারে তিনি কেবল রাজনীতিই করেছিলেন! আর মানবাধিকারনিষ্ঠ ইরম রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝতে পারলেন না বলে তাঁর আদর্শ, তাঁর আন্দোলন, তাঁর ন্যায়ের ধারণা— সব খেলো হয়ে গেল।
সত্যিই? ইরম রাজনীতিটা পারলেন না বলে তাঁর অনশন করার কারণটাই নাকচ হয়ে গেল আজ? এত সস্তা ছিল নাকি মণিপুরের মানুষজনের প্রাণ? তাঁদের মানবাধিকার? যে আইনের বিরুদ্ধে ষোলো বছর অনশন করলেন ইরম, সেই আফস্পার আর কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই?
হেরোর তকমা পেয়ে আর সাধারণ মানুষের দুয়ো নিয়ে ইরম চলে যান কেরলে। জনজাতির মানুষদের সঙ্গে কিছু সময় থাকতে। হতে পারে তিনি ব্যর্থতার আশ্রয় খুঁজেছেন সেখানে, হতে পারে মানুষ চিনতে চেয়েছেন ওখানে, হতে পারে অন্য ভাবে রাজনীতির কথা ভাবতে চেষ্টা করেছেন। ইরম বলেছেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই চালাবেন, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবেন। সে লড়াই কী করে অন্য ভাবে লড়তে হয়, হয়তো তার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, নেবেন। কেরল যাওয়াটা কেবল উপলক্ষ মাত্র।
আমরা কেউ জানি না এর পর ইরম ঠিক কী করবেন, কতটা রাজনীতি আর কতটা মানবনীতি। হয়তো নিজেও তিনি জানেন না। কেরলেও তিনি যেটুকু কথা বলেছেন, তাতে তাঁর নিজের মনের অনিশ্চয়তাই স্পষ্ট হয়েছে। তবে এত তাড়াতাড়ি তাঁকে বাতিল করে দেওয়া যায় কি? যে মেয়ে টানা ষোলো বছর অনশন করেছে, সে টানা ষোলো বছর রাজনীতি করে যাবে না, অন্য রকম রাজনীতি করবে না, এ কথা কি হলফ করে বলার সময় এসেছে? তিনি যখন বলেন, আর রাজনীতি নয়, তখন কি আসলে তিনি সেই অন্য রকম রাজনীতির কথাই বলেন? এক না-রাজনীতির কথা?
আমাদের রাজনীতির অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে, অন্য রকম না-রাজনীতিই হয়তো এখন ভরসা।