ভারতে শ্রম আইন শিথিল করলেই শিল্পের মন্দা কেটে যাবে, কথাটা নিতান্ত ভিত্তিহীন। তবু কোভিড-১৯-আক্রান্ত অর্থব্যবস্থাকে বাঁচাতে অনেক রাজ্যে শ্রম আইন শিথিল করার হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। উত্তরপ্রদেশ ঘোষণা করেছে, দুই-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে সেই রাজ্যে আগামী তিন বছর কোনও শ্রম আইন কার্যকর হবে না। অনুরূপ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাত সরকারও। আরও কিছু রাজ্য কর্মদিবসের মেয়াদ বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করতে চাইছে। যেন বেয়াড়া শ্রমিকগুলিকে কাবু করতে পারলেই এসে যাবে অচ্ছে দিন!
সত্যিই আসবে? ২০১৭-১৮ সালের হিসেবে ভারতে অ-কৃষি ক্ষেত্রে নিযুক্ত শ্রমিকের মধ্যে ৮৯% অসংগঠিত শ্রমিক, যাঁরা কোনও শ্রম আইনের আওতায় নেই। এই ক্ষেত্রে শ্রমিক নিয়োগ বা ছাঁটাইয়ের জন্য সরকারের অনুমতি নিতে হয় না। এত বড় শ্রমশক্তি শ্রম আইনের বাইরে থাকার পরেও দেশে কিন্তু শিল্পের জোয়ার আসেনি। যাঁদের শ্রম আইনের আওতায় আসার সম্ভাবনা সর্বাধিক, ২০০৪-০৫ সালে সেই বেতনপ্রাপ্ত শ্রমিকদের ৫৯ শতাংশের কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত হওয়ার কোনও লিখিত চুক্তি ছিল না। ২০১৭-১৮ সালে তা বেড়ে হয় ৭১%। এই বিপুলসংখ্যক শ্রমিক, যাঁদের লিখিত চুক্তিই নেই, তাঁরা কোন শ্রম আইনের আওতায় নিজেদের অধিকার সুরক্ষিত করতে পারবেন?
আবার সংগঠিত ক্ষেত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেখানেও ক্রমাগত শ্রম আইনের প্রভাব শিথিল হয়েছে। যেমন, সংগঠিত ক্ষেত্রে ঠিকা শ্রমিকের অনুপাত ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। অধিকাংশ শ্রম আইন সেই সব কারখানার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যেখানে ১০০ বা তার অধিক শ্রমিক কর্মরত। ২০১৭-১৮ সালের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, দেশের ৮১ শতাংশ চালু কারখানাতেই নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা ১০০ জনের কম। এক দিকে এই ধরনের কারখানার শ্রমিক, আর অন্য দিকে ঠিকা শ্রমিক— শ্রম আইনের আওতার বাইরেই আছেন দেশের মোট ৫৯ শতাংশ শ্রমিক। অনেক রাজ্যে ৩০০ জনের বেশি শ্রমিক নিযুক্ত হলে তবেই শ্রম আইন প্রযোজ্য হয়। যদি ৩০০ জন শ্রমিক সংখ্যাকে মাপকাঠি ধরি, তবে ৯০ শতাংশের বেশি কারখানা শ্রম আইনের বাইরে থাকবে। দেশের সিংহভাগ শ্রমিককে শ্রম আইনের বাইরে রেখেও কিন্তু ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প সফল হয়নি।
এর পরেও কেউ যুক্তি দিতে পারেন যে শ্রম আইন আছে বলেই পুঁজিপতিরা বড় কারখানা তৈরি করেন না। ছোট কারখানা থাকলে শ্রম আইনের বাইরে থাকা যায়, তাই ভারতে বড় কারখানা নেই। তথ্যের ধোপে এই যুক্তি টিকবে না। ২০১৭-১৮ সালের তথ্য বলছে, দেশের ৩৮ শতাংশ কারখানা ১৪ জন অবধি শ্রমিক নিয়োগ করে; ১৫ থেকে ১৯ জন শ্রমিক নিয়োগ করে আরও ৯ শতাংশ কারখানা। এই কারখানাগুলি কোনও শ্রম আইনের আওতায় না এসেও সহজেই ১০০ জন অবধি শ্রমিক নিয়োগ করতে পারে। কিন্তু, করছে না। কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তো শ্রম আইনের কথা বলা যাবে না।
এ কথা ঠিক যে ভারতে প্রচুর সংখ্যায় শ্রম আইন রয়েছে, যেগুলোর সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু, তা না করে শ্রম আইন বাতিল করার মধ্যে এক তীব্র শ্রমিক-বিদ্বেষ প্রকাশ পায়। উত্তরপ্রদেশে যে আইনগুলি আগামী তিন বছরের জন্য বাতিল করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ১৯৪৭ সালের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট, ১৯৪৮ সালের ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট, ও মিনিমাম ওয়েজেস অ্যাক্ট। ফ্যাক্টরি আইনে বলা রয়েছে কী ভাবে কারখানা পরিচালিত হবে, শ্রমিকরা কত ঘণ্টা কাজ করবেন ইত্যাদি। শৌচাগারসহ কর্মক্ষেত্রের সুযোগ সুবিধা, টিফিনের সময় ইত্যাদিও নির্ধারিত হয় এই আইনের ভিত্তিতে। প্রত্যেক শ্রমিক যাতে নিদেনপক্ষে সরকার-ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি পান, ন্যূনতম মজুরি আইনের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা হয়। উত্তরপ্রদেশ সরকার এই দুটো আইন বাতিল করেছে। অতঃপর কাজের সময়, অন্তর্বর্তী বিরতি, বা ন্যূনতম মজুরি কী ভাবে নির্ধারিত হবে, তা জানায়নি। এর আগে বিভিন্ন রাজ্যে একটা প্রবণতা ছিল— এই আইনগুলো ঠিক ভাবে মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য যে পরিদর্শক প্রয়োজন, তার সংখ্যা বহু রাজ্যেই কমছিল। উত্তরপ্রদেশ সাহস করে গোটা আইনি ব্যবস্থাকেই বাতিল করে দিল।
স্বাধীনতার পরে ভারতে যে ভাবে শ্রম আইন তৈরি করা হয়েছিল, তার একটা স্পষ্ট অভিমুখ ছিল— শিল্পক্ষেত্রে কোনও বিরোধ দেখা দিলে রাষ্ট্র, পুঁজির মালিক এবং শ্রমিক, এই তিন পক্ষ মিলে আলাপ-আলোচনার মধ্যমে আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধানসূত্র খুঁজবে। স্বাধীনতার পরে পরিকল্পনাভিত্তিক অর্থব্যবস্থাকে জোরদার করার জন্য শ্রমিক এবং পুঁজি, দুই পক্ষকেই নিয়ন্ত্রণ করতে এই ধরনের ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। বিশ্বায়ন এসে পাল্টে দিল এই গল্পটা। শ্রমিক আর পুঁজির দ্বন্দ্বে রাষ্ট্র ধীরে ধীরে মালিকের পক্ষে অবস্থান নিতে শুরু করল। অস্বীকার করার উপায় নেই— কারণও নেই— যে আগেকার সময়েও এই ত্রিপাক্ষিক বিধির বাইরে বেরিয়ে রাজনৈতিক দল ও নেতারা কারখানার ভিতরের দ্বন্দ্বে হস্তক্ষেপ করতেন, শ্রমিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতেন। তবু, এই ত্রিপাক্ষিক ব্যবস্থায় শ্রমিকের অধিকার ছিল আইনি পথে তাঁদের ক্ষোভ জানানোর, তার সমাধান খোঁজার। উত্তরপ্রদেশে শ্রমিক-পুঁজি দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত আইন বাতিলের মধ্যে দিয়ে গোটা প্রক্রিয়াকেই বিসর্জন দেওয়া হল। এখন শ্রমিক-পুঁজি দ্বন্দ্বের নিরসন কী ভাবে হবে? গায়ের জোরে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমশক্তিও পণ্য। কিন্তু, অন্য পণ্যগুলোর চেয়ে আলাদা। আপনি যখন আপেল বাজার থেকে কিনে খান, তখন আপেল আপনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে পারে না, কারণ আপেলের কোনও চেতনা নেই। কিন্তু শ্রমশক্তি যে শ্রমিকের মধ্যে নিহিত, তাঁর চেতনা আছে— তিনি এক জন মানুষ। এ দিকে, শ্রমিক ছাড়া পুঁজি বাড়তে পারে না, উৎপাদন করতে পারে না। তাই পুঁজির শ্রমশক্তিকে চাই। কিন্তু শ্রমশক্তিকে দিয়ে যা খুশি করানো যায় না, শ্রমিক প্রতিরোধ করতে জানে। তাই পুঁজিকে এমন ব্যবস্থা করতে হয়, যাতে শ্রমিকের উপর তার নিয়ন্ত্রণ থাকে। নয়তো উৎপাদন মার খাবে। কিন্তু মুনাফার অপরিসীম লালসা পুঁজিকে বাধ্য করে ক্রমাগত শ্রমশক্তিকে নিংড়ে নিতে। তাই শ্রমিকের কাজের ঘণ্টা হয়ে ওঠে এই নিংড়ে নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পুঁজি চায় কাজের সময় বাড়াতে, আর শ্রমিক চায় কমাতে। কিন্তু দিনে তো আর ২৪ ঘণ্টার বেশি নেই। শ্রমিককে খেতে হবে, ঘুমোতেও হবে পরের দিন কাজে আসার জন্য। তাই কাজের ঘণ্টা কত হবে, তা নিয়ে পুঁজিবাদের ইতিহাসে নিরন্তর লড়াই চলেছে। কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, এই ক্ষেত্রে পুঁজিপতি ও শ্রমিক, দুইয়েরই দাবি ‘ন্যায্য’। আর দুই ন্যায্য দাবির মধ্যে ফয়সালা করে শক্তি।
আপাতত দেশে শ্রমিকদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি তলানিতে। তাই শহরে বন্ধাবস্থায় নাভিশ্বাস উঠলে তাঁরা গ্রামে ফিরতে চান, কিন্তু কোনও সঙ্ঘবদ্ধ সংগঠনের অভাবে তাঁরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন না, যা সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। বরং গ্রামের দিকে তাঁদের অবিরাম পদযাত্রাই তাঁদের একমাত্র প্রতিবাদ হয়ে ভারতে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির জন্ম দেয়। তবু সেই ট্র্যাজেডি সরকারকে বিচলিত করে না। বরং কী ভাবে শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নিয়ে কারখানা চালু রাখা যায়, সরকার সেই চিন্তায় বেশি ব্যস্ত। কাজের সময় বাড়ানো এবং শ্রম আইন বাতিল বা শিথিল ভারতে পুঁজি ও রাষ্ট্রের মেলবন্ধনে তৈরি অমানবিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ।
তবু দুটি কথা মনে রাখতে হবে। এক, গোটা বিশ্ব যখন মন্দায় আক্রান্ত, তখন শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নিলেও দেশে বিনিয়োগ বাড়ার আশা ক্ষীণ, কারণ এই পথে বিনিয়োগ বাড়ে, এই তত্ত্বই ভিত্তিহীন। দ্বিতীয়, শ্রমিকরা যন্ত্র নন, মানুষ। শ্রম আইন বাতিল করে কার্যত পুঁজিপতিদের যথেচ্ছাচার করার সুযোগ করে দেওয়া হল। অধিকারহীন নিষ্পেষিত শ্রমিকের চেতনায় অসন্তোষ জাগবেই। শ্রম আইন বাতিল করলে সেই অসন্তোষ আইনের যেতে পারবে না। ফলে তা প্রতিরোধে পর্যবসিত হতে পারে। তখন স্বাভাবিক ভাবেই অশান্তি বাড়বে, যা পুঁজিবাদেও কাম্য নয়। কোভিড-১৯’পরবর্তী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে হলে সর্বাগ্রে চাই শ্রমিকদের সহযোগিতা। তাঁদের আইনি অধিকার কেড়ে নিয়ে সেই সহযোগিতার আশা করা যায় না।
অর্থনীতি বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা