মহাসিংহাসনে। বল্লভভাই পটেলের জন্মদিনে নরেন্দ্র মোদীর শ্রদ্ধা। ছবি: পিটিআই
বেশ কয়েক দিন ধরে বিজেপি এবং আরএসএস বল্লভভাই পটেলকে নিয়ে মাতামাতি করছে। এই প্রবণতা কিছুটা বিস্ময়কর, কারণ পটেল তো গৈরিক পরিবারের শিক্ষাগুরু গোলওয়ালকরের মতো ঘোরতর মুসলমানবিদ্বেষী ছিলেন না।
সুমিত: আমি কিন্তু ততটা বিস্মিত হইনি। আসলে, স্বনামধন্য কোনও জাতীয় নেতা বা স্বাধীনতা সংগ্রামী বা বিদ্রোহী বা বিপ্লবী সংঘ-পরিবার থেকে বেরিয়ে আসেননি। ভাণ্ডার যাকে বলে শূন্য। এই পরিস্থিতিতেই বিজেপি এমন এক জন জাতীয় নেতাকে খুঁজছিল, যাঁকে তাদের দেবায়নে স্থান দেওয়া যেতে পারে। অবশ্যই নেহরু নন, অবশ্যই নেতাজি নন। কারণ তাঁরা ঘোরতর অসাম্প্রদায়িক। উপরন্তু নেহরু ছিলেন সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা। তাই তিনি, যাকে বলে— অস্পৃশ্য। অবশেষে তারা পটেলকেই বেছে নেয়, কারণ তিনি ছিলেন সুস্পষ্টই দক্ষিণপন্থী। তাঁকে আত্মসাৎ করা অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ। উপরন্তু, পটেল বিসমার্কের মতো দমনমূলক পদ্ধতি বারংবার প্রয়োগ করেছিলেন। দু’জনের এ ব্যাপারে যথেষ্ট মিল রয়েছে। বিসমার্ক যেমন ছোট ছোট জার্মান রাজ্যকে একত্রিত করে একটি জার্মান ‘নেশন’ তৈরি করেছিলেন, পটেলও স্বাধীনতা অর্জনের পর্বে ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজন্যবর্গকে একত্রিত করে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি দমননীতি প্রয়োগ করতে দ্বিধা করেননি। বিজেপিও দমনমূলক রাজনীতিতে কম-বেশি বিশ্বাস করে।
তনিকা: মনে রাখতে হবে, দিল্লিতে শাসনভার গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্ঘ-পরিবারের রাজনীতি মূলপ্রবাহের রাজনীতিতে পরিণত হয়। এবং ক্ষমতা অর্জনের সেই পর্ব থেকেই বিজেপি জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস করায়ত্ত করতে মরিয়া। কী করে সেটা সম্ভব?— পটেলের মতো দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদকে পরিবারভুক্ত করে। আমরা তো জানি যে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জুড়ে রয়েছে কংগ্রেস রাজনীতি; কৃষক সংগ্রাম বা আদিবাসীদের লড়াইকে এখনও সে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই অবস্থায় সঙ্ঘ-পরিবার মূল সংগ্রামের ইতিবৃত্তে প্রবেশ করতে চায় পটেলকে বারংবার শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে।
কেন? বীর সভরকর কী করলেন? তাঁকে নিয়ে কি কাজ হচ্ছে না?
তনিকা: সঙ্ঘ-পরিবার সভরকরকে দারুণ শ্রদ্ধা-ভক্তি করে। শাখায় শাখায় তাঁর নাম-সংকীর্তন করা হয়। কিন্তু তিনি আদৌ জাতীয় নেতা নন। তাঁকে গাঁধী-নেহরু-সুভাষের পাশে স্থান দেওয়া এক প্রকার অসম্ভব। সভরকর তো আন্দামান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর সক্রিয় ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতিতে অংশই নেননি। এক কথায়, তাঁর জাতীয় মাত্রা নেই। অন্য দিকে পটেলকে নিয়ে লেখা হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ। তাঁকে নিয়ে একাধিক সিনেমাও হয়েছে। পটেল স্বাধীনতার পর্বে জাতীয় সংহতির রূপকার ছিলেন। তুলনায় সভরকরের কোনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই নেই, জনমানসেও তাঁর স্থান নেই। অগত্যা বিজেপি পটেলের শরণাপন্ন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই কয়েক দিন আগেই পটেলের জন্মদিবসে ঘোষণা করেন যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে। কারণ, এ পর্যন্ত যা লেখা হয়েছে, তাতে নেহরু-গাঁধী পরিবারকে অকারণ অত্যধিক মূল্য দেওয়া হয়েছে। এর ফলে অবহেলিত থেকেছে পটেল, শ্যামাপ্রসাদ, মালব্য, জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং অন্যদের অবদান। এই অভিযোগ কতটা সত্যি? সুমিতবাবু, আপনার লেখা আধুনিক ভারতের ইতিহাসকে উচ্চবর্গের বলা হয়ে থাকে। সত্যিই কি সেই ইতিহাস একপেশে ও একমুখী, গাঁধী-নেহরুর ভজনায় নিবেদিত?
সুমিত: সমালোচকেরাই বলবেন আমার রচনা ও বিশ্লেষণ একমুখী কি না। আমার দিক থেকে আমি এটুকু বলতে পারি যে, আমি সমগ্র চিত্রটিই তুলে ধরতে চেয়েছি। যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ হওয়া যায়, ততটা হয়েছি। অবশ্যই আমি সভরকরকে নিয়ে বেশি বাক্য ব্যয় করিনি, কারণ তাঁর রাজনীতি ঘোরতর সাম্প্রদায়িক। তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে, প্রত্যেক ইতিহাসবিদেরই একটা ঝোঁক থেকে যায়। এবং আমার ঝোঁকটা ছিল বামপন্থার দিকে। এই ঝোঁক থাকা সত্ত্বেও আমি আমার গ্রন্থে গাঁধী ও নেহরুর ভূমিকা ও কার্যক্রমের বেশ কিছু সমালোচনা করেছি, যেহেতু আমি ব্যক্তিপূজায় একেবারেই বিশ্বাসী নই। একই সঙ্গে বলব যে, নিম্নবর্গের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের বিষয়েও বিশদ ভাবে লিখেছি, যা কিনা কংগ্রেসের রাজনীতি বৃত্তের ভিতর কোনও ভাবেই আবদ্ধ ছিল না।
তনিকা: দেখুন, স্বাধীনতা সংগ্রাম বিষয়ে বিস্তর বই লেখা হয়েছে। কে এম মুন্সি লিখেছেন, বিপান চন্দ্র লিখেছেন, সুমিত লিখেছেন। সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ বা নিম্নবর্গের ইতিহাস রচয়িতারাও লিখেছেন। এঁদের অবদানও সপ্রশংস উল্লেখ দাবি করে। আমাদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক, বীরপূজামূলক ইতিহাস রচনায় নেহরুর উপর আলো ফেলা হয়েছে, কেননা তিনি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক ভারতের রূপকার। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা, তাঁর সমাজতান্ত্রিক ভাবনা নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে। তা বলে অন্যদের অবজ্ঞা করা হয়নি।
আমাদের ইতিহাস-গবেষণা ও রচনা বড় ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সাধারণ মানুষের ইতিহাস, দৈনন্দিন জীবনের ইতিহাস, বঞ্চিতদের ইতিহাস সে ভাবে স্থান পায়নি। এই মুহূর্তে বি জে পি-র সব থেকে বড় অ্যাজেন্ডা হল মসৃণ, সমস্যাহীন ইতিহাস লেখা। সঙ্ঘ-পরিবার থেকে বলে দেওয়া হয়েছে যে, জাতিভেদ, জাতিবৈর, শ্রেণিবৈষম্য, শ্রেণিসংঘাত, শ্রেণিসংঘর্ষ নিয়ে কিছুই লেখা যাবে না। অর্থাৎ, ইতিহাসবিদেরা উপহার দেবেন নিষ্কলঙ্ক, সমস্যারিক্ত আধুনিক ইতিহাস। আমি আমার একটি পাঠ্য রচনায় পেরিয়ার আর রমা বাই-এর চিন্তা ও কার্যক্রম নিয়ে লিখেছিলাম। গৈরিক পরিবারের বিশেষজ্ঞরা তার কঠোর সমালোচনা করেছেন। অন্য দিকে, আর এস এস অম্বেডকরকে গিলতেও পারছে না আবার ফেলতেও পারছে না। তাই অবশেষে তারা অম্বেডকরকে বিকৃত করে পাঠ্যপুস্তকে পেশ করছে। অম্বেডকরকে ভেবে দেখুন— তাঁরা হিন্দু নেতা হিসেবে চিত্রায়িত করছেন। তিনি নাকি হিন্দুদের ধারক ও বাহক!!
এই তথাকথিত বিকল্প ইতিহাসে মৌলানা আজাদের বৃত্তান্ত কি আদৌ স্থান পাবে? ভগৎ সিংহও তো মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন, তদুপরি তিনি ছিলেন ঘোরতর নাস্তিক।
সুমিত: আমার মনে হয় মৌলানাকে নিয়ে বড় কোনও সমস্যা হবে না, কিন্তু ভগৎ সিংহকে মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। ভগৎ সিংহ তাঁর সংগঠনের নাম দিয়েছিলেন হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি। তাঁকে ফেলাও যাবে না, গেলাও যাবে না। তাই তাঁর ক্ষেত্রে সঙ্ঘ একটা দায়সারা ভাব নেবে।
তনিকা: ১৯৯৮ সালে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সম্মেলনে ভগৎ সিংহ নামাঙ্কিত শিবির খোলা হয়েছিল। তখনও এই গৈরিক তরুণ ছাত্ররা জানত না যে, ভগৎ সিংহের একটি রচনার শিরোনাম Why I am an atheist। সত্যি, এরা এত কম জানে!
গাঁধীকে কী চোখে দেখা হবে? আমরা একটা অদ্ভুত অধ্যায়ে বাস করছি। এক দিকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে দরদি ভাষায় গাঁধীকে প্রণাম জানাচ্ছেন, অন্য দিকে তাঁরই গোষ্ঠীর কিছু উগ্রপন্থী নাথুরাম গডসের সশ্রদ্ধ স্মরণে মূর্তি নির্মাণ করছেন! এই দু’টি কাজ আদ্যন্ত পরস্পরবিরোধী। পটেল-ভক্ত ইতিহাসবিদদের বেছে নিতে হবে— হয় গাঁধী, না হয়তো গডসে।
সুমিত: এ নিয়ে একেবারে চিন্তা করবেন না। সঙ্ঘ-পরিবার, বিশেষ করে আর এস এস পরস্পরবিরোধী কাজে ও কথায় সিদ্ধহস্ত। তাঁরা শ্যামও রাখবেন আবার কুলও রাখবেন।
তনিকা: সঙ্ঘ-পরিবার কিন্তু খুবই সচেতন ভাবে গডসের নাম বার বার উচ্চারণ করছে। শোভাযাত্রা, মূর্তি নির্মাণ, সবই চলছে। সত্যি বলতে কি, গডসের বেশ কিছু ভক্ত এখনও আছে। আমার ধারণা, যত দিন যাবে ততই গডসেকে প্রসারিত করা হবে। পক্ষান্তরে অন্তত চেষ্টা করা হবে গাঁধী-ভজনা কমিয়ে আনতে। অতএব, বি জে পি-র দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হল— কম গাঁধী, বেশি গডসে।
আর এস এস কি ভুলে গেছে যে, গাঁধী হত্যার পর পটেলই তাদের আক্রমণ করেছিলেন? আর এস এস-কে নিষিদ্ধ করার পিছনেও তাঁর সন্দেহাতীত অবদান ছিল?
সুমিত: অপ্রিয় সত্য ভুলে যেতে আর এস এস ওস্তাদ। বর্তমানে ও ভবিষ্যতে সঙ্ঘ-পরিবার এই কথাটা জনসমক্ষে আনবেই না, স্রেফ চেপে দেবে। এরা সচেতন স্মৃতিভ্রান্তির উপর নির্ভর করেই ইতিহাসকে কল্পকাহিনির স্তরে বা পুরাণের স্তরে নিয়ে যাবে। এরা তথ্যনিষ্ঠার প্রতি বিন্দুমাত্র অনুগত নয়। এরা কিন্তু ভিতর-বাহিরেও একই বিভেদনীতি অনুসরণ করবে। অর্থাৎ, ভিতরে ভিতরে গোলওয়ালকরকে অকাতরে সম্মান জ্ঞাপন করা হবে, কিন্তু বহির্বিশ্বে বলবে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নাম।
সুমিতবাবু, আপনি আইসিএইচআর-এর পরিবেশিত ‘টুওয়ার্ডস ফ্রিডম’ সিরিজের ১৯৪৬-এর খণ্ডটি সম্পাদনা করেছিলেন, কিন্তু তৎকালীন বি জে পি সরকার বইটির প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেয়। কেন?
সুমিত: সেই উত্তাল পর্বের ইতিহাসে সঙ্ঘ পরিবারে কোনও উল্লেখ নেই, এমনকী পুলিশের রেকর্ডেও। সঙ্ঘ এই অধ্যায়ে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় ছিল, কিছুই করেনি।
তনিকা: শুধু ১৯৪৬-এ নয়, সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসেই আর এস এস অনুপস্থিত। কারণ, তারা কিছুই করেনি।
এই নিষ্ক্রিয়তার ইতিহাস কি গৈরিক রচিত ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাবে?
সুমিত-তনিকা: খুব সম্ভবত, না। আর একটা কথা, সেই সময়ে আর এস এস-এর প্রতিটি শাখায় সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। কিন্তু সে জন্য তাদের উপর কোনও নিষেধাজ্ঞা নেমে আসেনি। পক্ষান্তরে কংগ্রেস ও ক্ষুদ্র কমিউনিস্ট পার্টির তুলনীয় কাজ বন্ধ করতে শাসকেরা ছিল সদা সক্রিয়। আসলে ব্রিটিশ শাসকেরা জানত যে, এরা আদৌ শত্রু নয়, এরা শুধু হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণে নিবেদিত।
এই পরিকল্পিত নির্মাণে বর্তমানে বাদ সাধছে দলিতরা। উত্তরপ্রদেশে, গুজরাতে দলিতরা বি জে পি-কে প্রায় বর্জন করেছে। তাদের কী ভাবে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে, সে চিন্তায় সঙ্ঘ-পরিবার আজ নিয়োজিত। মসৃণ, সমস্যাহীন ইতিহাস রচনার কাজে এখন বাদ সাধছে দলিতরা।
সাক্ষাৎকার: শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত