ডাকের বাক্স খালিই, আর আসে না চিঠি

আবেগ, কষ্ট, আহ্লাদ— দূর থেকে আরও দূরে বয়ে নিয়ে যেত যে পত্রাবলি, দিন তার ফুরিয়ে এসেছে। এখন মেল-এর অনুশাসনে সেই সব অনুভূতি হারিয়ে গিয়েছে কোথায়! সেই সব হারানো চিঠির কথা লিখছেন বিশ্বজিৎ মহন্ত ভাবেই পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসাবে প্রেম-ভালবাসা, বিরহ-বেদনা, দুঃখ-সান্ত্বনা, মানব জীবনের সমস্ত হৃদয়ানুভূতি ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হতো চিঠিতে। আবার কোনও চিঠি সুন্দর হস্তাক্ষরের মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিত প্রাপকের মনকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৮ ০৩:২২
Share:

প্রতীকী ছবি।

চিঠি, এক সময় হয়ে উঠত সমকালের নিরিখে এক উৎকৃষ্টতম সাহিত্য, দুই পরিবারের মধ্যে খবর আদান-প্রদানের একমাত্র মাধ্যম। পত্রের ভাষায় বর্ণিত হতো নানা চিত্ররেখা, সুখ-দুঃখ, আবেগ-ভালবাসার নানা টুকরো কথা। জানা যেত, পরিবেশকে, পরিস্থিতিকে, মানুষের অন্তরের ভাবাবেগকে। একটি চিঠির জন্য তখন সকলেই দীর্ঘ সময় চেয়ে থাকত। চিঠি তখন ছিল ভাবনা, উপলব্ধি ও যোগাযোগের পারস্পরিক সেতুবন্ধন। যা কথায় বলা যেত না, তা প্রকাশিত হতো অক্ষরে, শব্দমালায়। একই ভাবে যা ছিল প্রেমিকের কাছে প্রেমিকার হৃদয়ানুভূতির স্পন্দন। অপেক্ষার পরে একটি চিঠির প্রাপ্তি স্বস্তির প্রলেপ দিত। এ ভাবেই পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসাবে প্রেম-ভালবাসা, বিরহ-বেদনা, দুঃখ-সান্ত্বনা, মানব জীবনের সমস্ত হৃদয়ানুভূতি ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হতো চিঠিতে। আবার কোনও চিঠি সুন্দর হস্তাক্ষরের মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিত প্রাপকের মনকে।

Advertisement

রাজনৈতিক উত্থান-পতন, ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনার স্বাক্ষর বহু প্রাচীন চিঠিপত্রে আজও রয়ে গিয়েছে। কিন্তু চিঠি লেখার সেই রেওয়াজ আজ আর নেই। ইন্টারনেট তাকে হার মানিয়েছে। চলে এসেছে ই-মেল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সোস্যাল মাধ্যম। যাতে নামমাত্র খরচে দ্রুতগতিতে একই কাজ সম্পন্ন হয়। তবে এতে কোথাও যেন প্রাণের স্পর্শের বড়সড় অভাব অনুভূত হয়। তা সত্বেও চিঠি বিষয়টি আজকের প্রজন্মের কাছে সম্পূর্ণ ভাবেই অস্পৃশ্য।

চিঠির বোঝার ভার অনেক কমে গিয়েছে ‘রানার’-এর। চিঠি লেখার প্রবণতা কমে গেলেও মনে রাখতে হবে, চিঠি কিন্তু এক সময় কাব্যরস সৃষ্টিতে অনন্য ভূমিকা নিয়েছে। এই রকমই শেষের কবিতায় চিঠির কাব্যময়তা অপরিহরণীয়। অমিত চিঠি দিয়ে লাবণ্যকে শেষ কথাটি জানিয়েছিল কবিতায়, তার উত্তরে লাবণ্য দীর্ঘ চিঠি লিখে জানায়, ‘‘হে বন্ধু বিদায়।’’ এ ধরনের চিঠির কাব্যময়তা মনকে এক অন্য জগতের মুখোমুখি করে। তবে, রবীন্দ্রনাথ চিঠি লেখার অভ্যাসকে বলেছেন, ‘‘এ হচ্ছে নিজের মনকে স্বাচ্ছন্দ্যে হাওয়া খাওয়ানো। একে চিঠি বলাই ভুল। যাকে লিখি সে লক্ষ্য নয়, সে উপলক্ষ্য মাত্র’’ আবার অন্যত্র বলেছেন, ‘‘স্রোতের জলের যে ধ্বনি সেটা তার চলার ধ্বনি, উড়ে চলা মৌমাছির পাখার যেমন গুঞ্জন। আমরা যেটাকে বকুনি বলি। সেটাও সেই মানসিক চলে যাওয়ারই শব্দ। চিঠি হচ্ছে লেখার অক্ষরে বকে যাওয়া।’’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠিপত্র গুলি ষোলো খণ্ডে মুদ্রিত। তাঁর অনেক চিঠি বহু সুধীজনের কাছে আজও সযত্নে রাখা আছে।আবার অপ্রকাশিত অনেক চিঠি মাঝে মাঝে প্রকাশিতও হয়ে থাকে।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনও সহকারীকে ডিকটেশন দিয়ে নয়, নিজের হস্তলিপির মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিতেন চিঠির প্রাপককে। তাঁর প্রত্যেক চিঠি এবং তার বিষয়বস্তু আমাদের কাছে সত্যিই অমূল্য সম্পদ। চিঠি লেখার শৈলীতে রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছিলেন নিজের একজন আদর্শ শিক্ষক। এক-একটি পত্রে তিনি তাঁর ভাবনাকে উজাড় করে দিয়েছেন অনবদ্য শৈলীতে। কোথাও উপদেশ, কোথাও সমাধানের পথ, কোথাও প্রতিবাদের দৃঢ়তা আবার ভাষার মাধ্যমে কোথাও পৌঁছে গিয়েছেন সীমার মধ্যে অসীমে। তিনি চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়ে ফেলতেন। তারপর কোনোটার উত্তর দিয়ে দিতেন তৎক্ষণাৎ, আবার কোনোটার একটু অবসরে। রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে উত্তর পাননি, এরকম পত্রলেখক নেই বললেই চলে। চিঠি পেয়ে উত্তর না দেওয়াকে তিনি বলতেন ‘অসভ্যতা’। স্বাধীনতার অগেও বহু মনীষী তাঁদের ভাবনা, শিক্ষা ও ধারণাকে চিঠি লেখার মাধ্যমে পৌঁছে দিতেন তাঁদের আপনজনদের কাছে। স্বামী বিবেকানন্দ বিদেশ থেকে তাঁর সতীর্থদের বহু চিঠি লিখে উপদেশ ও নির্দেশ পাঠাতেন। স্বামী বিবেকানন্দের চিঠির ভাষার সরলতা ও প্রাঞ্জলতা আলাপের সরসতায় রীতিমতো আন্তরিক হয়ে উঠতো। গান্ধীও চিঠি লিখতেন ডান-বাঁ দু’হাতেই। ডান হাতে চিঠি লেখা শুরু করে তিনি বাঁ হাত দিয়ে শেষ করতেন। ব্যক্তিগত চিঠিপত্রগুলিতে অনেক সময় শিক্ষামূলক ঐতিহাসিক তথ্যও যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। জওহরলাল নেহরু ১৯২৮ সাল এলাহাবাদ থেকে মহীশূরে তাঁর দশ বছর বয়সি কন্যা ইন্দিরাকে অসংখ্য চিঠি লিখেছিলেন—Letters from a Father to His Daughter। শিরোনামে এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। জওহরলাল বিশ্বের বিভিন্ন বিস্ময়, প্রাকৃতিক ইতিহাস এবং সভ্যতার গল্প শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে চিঠি আকারে লিখেছিলেন। ব্যক্তিগত ভাবে চিঠি লেখা আমারও একটি নিত্য দিনের অভ্যাস। সংবাদপত্রেই লেখালেখির সূত্রে ধরে 2005 সালে চিঠি মারফৎ পরিচিতি ঘটে সৌরীণ মিত্রের সঙ্গে। দীর্ঘ সাত বছর তাঁর সঙ্গে ফোন ছাড়া কেবল চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল। কোনদিন ফোনে কথা হয়নি। তিনি বলতেন, ‘‘এ এক নেশা ও কৌতূহল। প্রতি দিন মর্নিং ওয়াক করে লেটার বক্সে হাত বোলাই তোমার সুন্দর হস্তাক্ষর ও সাহিত্য ভাষা-রস সংবলিত চিঠির উদ্দেশ্যে।’’ তিনি অনেক পুরানো নামী-দামী লেখকের বিভিন্ন ধরণের ভঙ্গিতে লেখা চিঠি ও সাহিত্য-রসে সৃমৃদ্ধ লেখা আমাকে পাঠাতেন। বস্তুত আমিও মুক্ত হৃদয়ে চিঠি লিখে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও ভাব বিনিময় করতাম। এমনকি আমার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সুন্দর হাতের লেখা দিয়ে লেখা একটি চিঠিও আমি তাকে পাঁঠিয়েছিলাম। তিনি যথারীতি আপ্লুত হতেন। অবশেষে বেশ কিছু চিঠির উত্তর আমি আর পেলাম না। দীর্ঘদিন পর ফোন নম্বর সংগ্রহ করে জানতে পারি তিনি আর নেই! নিবিড় বিচ্ছেদ- বেদনার মধ্য দিয়ে একটি আবেগঘন ভাব বিনিময়ে এভাবেই ছেদ পড়েছিল। যাই হোক, সবশেষে বলি, এই আধুনিকতার ঢেউয়ের মধ্যেও বাংলা ও বাঙালির চিরকালীন প্রাণের সংস্কৃতি হিসাবে কি বাঁচিয়ে রাখা যায় না চিঠি লেখার সেই চিরন্তন ঐতিহ্যকে? যন্ত্র সভ্যতার কাছে তার এহেন অসহায় পরাজয়কে আর মুখ বন্ধ করে মেনে নেবেন না। কলম হাতে লেখার অলসতা ত্যাগ করুণ। সবাই আবার চিঠি লেখা ধরুন। চিঠি পড়ুন। অভ্যাস তৈরি করুণ। বিশেষ করে বছরে অন্তত একটি হলেও চিঠি লিখুন। দেখবেন ধীরে ধীরে পুনরায় অভ্যাস তৈরি হয়ে চিঠির ভাব ও সাহিত্যের অমৃতধারায় বাঙালির মনোভূমি আবার হয়ে উঠবে ভাব-সমৃদ্ধ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement