Social Media

ট্রোলের ফাঁদ পাতা ভুবনে কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে?

অপমান করে নিজের মহত্ত্ব ও জ্ঞান শো-অফ করার মতোই। লিখেছেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:৪১
Share:

ছবি: শাটারস্টক।

কবি লিখেছিলেন, ‘‘নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও!’’ এখন তার খানিক বদল হয়ে ট্রোলে ধুইয়ে যাচ্ছে সমাজ।

Advertisement

‘জেরক্স কালচার’ না কি সামাজিক ভালচার? ‘হ্যাশট্যাগ’ না কি একেবারেই ‘ট্যাগ’ বা ‘ত্যাগ’? রিয়্যাল-আনরিয়্যালের দোলায় ভাসছি আমরা। নাহ, ‘আমরা’ (সেলেব) ‘ওরা’ (সাধারণ), এ সবের দিন গিয়েছে। সেলেব তো তৈরি করেছি ‘আমরা’জন এবং গণ। অতএব, যার যেমন খুশি ইটপাটকেল, লাইক, হৃদয়,গালিগালাজে এক্কেবারে ধুইয়ে দেব। বেশ করব।

আগে যা ছিল লেগ পুলিং তাই কি হল ট্রোলিং?

Advertisement

হইহই পড়ে গেছে নেট দুনিয়ায়। সুন্দর পিচাই তো মস্ত প্রশ্নের সামনে খাড়া হয়েছেন। বিশ্বের প্রাণ ধুকুপুকু!

কেন?

গুগলের সার্চ ইঞ্জিনে ‘idiot’ শব্দটি লিখলে চলে আসছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম! এই অতি ভয়ঙ্কর কাণ্ডের জবাবদিহি চাওয়া হয়েছে সুন্দর পিল্লাইয়ের কাছে। তাঁকেও শেষমেশ বোঝাতে হয়েছে, ট্রোলিং-এর জন্য এই শব্দ আর নামের অত্যধিক ব্যবহারের জন্য গুগল তার যান্ত্রিক নিয়মে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে!

হায় হায়! কি বিপদ! ফাঁদের অন্য নাম তবে ট্রোলিং?

কিন্তু কেন এত ট্রোলিং নিয়ে টক্কর?

এক কথায় কারণ খুঁজলে উত্তর একটাই,‘আমি’।

কীসের ‘আমি’?

আমি বলতে পারছি, মতামত দিচ্ছি সব বিষয় নিয়ে। আমি চাইলে সোজা অমিতাভ বচ্চনের সমালোচনা করতে পারছি। কেন তিনি দীপাবলীতে বাজি ফাটান? বাজি তো দূষণ বাড়ায়! ছিঃ অমিতাভ বচ্চন! আপনি না দেবতা?

শক্ত ভাষাতেই ট্রোলিংয়ের জবাব দিতে হয়েছে নুসরতকে।

আরও পড়ুন: পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে, একলা তোমার হাতের মুঠিতে​

দীপিকা পাড়ুকোনের এত এত জৌলুস মাখা বিয়ের ছবি আমার সহ্য হবে কেন? আমি তাই খুঁজে বার করেছি অনুষ্কার বিয়ের ছবি। বলে দিচ্ছি টুকলি হয়েছে! বেচারা ডিজাইনার সব্যসাচী, তিনিও বাদ পড়ছেন না। একেবারে ট্রোল করে জানান দিচ্ছি, ও আবার ফ্যাশন ডিজাইনার নাকি! ছাই। টুকেছে তো। সবজান্তা ‘আমি’। সব বিষয়ে মতামত দেওয়া ‘আমরা’।

এই আমাদের কাজ। আমরা, শত সহস্র ‘আমি’র সম্মিলিত সুর এখন ট্রোলিং-এর হুজুগে মাতোয়ারা!

এই সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারার মধ্যে আমি নিজেকে অনেক আমি-র পাকানো দলের মধ্যে শামিল করে নিতে পারছি।

এই অজস্র আমি যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় শব্দের তুফান তুলছে, তারা সকলেই যে খুব বিশাল কিছু ভাবনা বা যুক্তিকে গভীর ভাবে দেখে নিজেদের বক্তব্য জানাচ্ছে তা একেবারেই নয়। ওই যে, জেরক্স কালচার! রবীন্দ্রনাথকে অমুক ফুলমালা দিয়ে পুজো করছে পঁচিশে বৈশাখ! তো আমিও করব। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা? আদর্শ? ধুর, অত পড়ার সময় কার?

আসলে ব্যাপারটা অন্য কাউকে ব্যঙ্গ-মশকরা, অপমান করে নিজের মহত্ত্ব ও জ্ঞান শো-অফ করার মতোই। আরবান ডিকশনারি বলছে, শুধুমাত্র করতে পারা যায় বলেই, ইন্টারনেটে একজন ‘ইনোসেন্ট’ মানুষের স্ট্যান্ড পয়েন্টে সিনিক্যাল বা সারকাস্টিক্যাল মন্তব্য করাই হল ট্রোল!

বোলারদের পাশাপাশি ট্রোলারদেরও সামলাতে হয় কোহালিকে।

বিরাট কোহালির এক মন্তব্যের জেরে ট্রোল আর মিমের বন্যা বয়ে গিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিরাট নিজের অফিশিয়াল অ্যাপের জন্য একটি প্রমোশনাল ভিডিয়ো বাজারে নিয়ে এসেছিলেন। সেখানে তাঁকে একজন ফ্যান ওভাররেটেড ব্যাটসম্যান বলে আখ্যা দিয়েই জানিয়েছিলেন যে, তিনি কোহালির ব্যাটিং দেখতে পছন্দ করেন না। পাশাপাশি, সেই ভারতীয়ের সংযোজন ছিল যে, ইন্ডিয়ার খেলা দেখার থেকে তিনি অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের খেলা দেখতেই বেশি পছন্দ করেন।

আর এর উত্তরে কোহালি বলেছিলেন যে সেই ফ্যানের এই দেশে থাকার কোনও অধিকারই নেই। ভারতে থেকে অন্য দেশকে ভালবাসার কোনও মানেই হয় না।

ব্যস, যেই না বলা, শত, সহস্র ‘আমি’রা ঝাঁপিয়ে পড়ল!

দেশ জুড়ে কোহালির নিন্দায় মুখ খুললেন নেটিজেনরা। বিষয়টা এখানেই শেষ নয়, সংবাদসংস্থা এএনআই জানাচ্ছে যে, কোহালির এই ভিডিও এ বার খতিয়ে দেখবে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত বোর্ডের কমিটি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটর্স।

কোহালিও কিন্তু চুপ করে থাকার পাত্র নন, জোরালো হল তাঁর কণ্ঠস্বর। ক্ষোভ উগরে দিলেন এ বার টুইটে। লিখলেন, “বন্ধুরা, ট্রোলিং আমার জন্য নয়। আমি ট্রোলড হতেই পছন্দ করব। আমি ‘সে রকম ভারতীয়দের’ নিয়ে কথা বলেছি যারা এ রকম মন্তব্য করে থাকে। ব্যস, এইটুকুই। পুরোটাই ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। বিষয়টাকে হাল্কা ভাবে নিয়ে এই উৎসবের মরসুম উপভোগ করুন। সবার জন্য ভালবাসা আর শান্তি কামনা করি।”

যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁদের ক্রিকেট নিয়ে কিছু প্রশ্ন করলে হয়তো মুখে কুলুপ আঁটবেন। তারা ঝাঁপালেন, কারণ দেখলেন ‘ভারত’ নিয়ে কথা হচ্ছে। ছিঃ, নিজের দেশের অপমান অসহ্য! দেশ থেকে বের করে দেওয়া হোক বিরাটকে। যেন বিরাট ভারতের হয়ে মাঠে নেবে কোনও দিন লড়াই করেননি, আর তাঁরাও ‘বিরাট...বিরাট’ বলে পাড়া মাতাননি!

বোল্ডনেস নিয়ে ট্রোলিংয়ের মুখে পড়েও থেমে যাননি র‌্যাচেল।

আরও পড়ুন: হাজার হাজার ভাসমান দিয়ার মতো আলোয় ভরা সম্ভাবনার নাম ফেসবুক​

আসলে কী কারণে কখন যে কে ট্রোলড হবেন বলা মুশকিল! এই ‘আমি’রা এখনকার স্মাইলিগুলোর চেয়েও ভয়ঙ্কর। স্মাইলিরা সব আবেগের জন্য তৈরি। হ্যাপি, স্যাড, কনফিউজড... কিন্তু এই আমি-র দল সন্ধ্যাদীপের আগায় থেকে গভীর রাতের জাগায় সারাটাক্ষণ চোখ লাগিয়ে আছে।

র‌্যাচেল হোয়াইট একবার স্বাধীনতা দিবসের আগে, স্বাধীনতার ব্যাখ্যায় ‘বোল্ড’ হতে চেয়েছিলেন। তিনি ক্যাপশনে লেখেন, বোল্ড হওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে স্বাধীনতার অর্থ। সেই ছিল শুরু। ওই জুলু জুলু চোখে র‌্যাচেলের অর্ধনগ্ন ছবি ভাল করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে (পড়ুন ভার্চুয়ালি চেখে) তার পর তাঁকে নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু।

থেমে যাননি র‌্যাচেল। ছবির সঙ্গে এ বার জানান, এই বোল্ডনেসের পথ ধরেই এখন চলার সিদ্ধান্ত তাঁর। মানে বুঝতেই পারছেন, দু’টি ছবিতে আটকে থাকছেন না নায়িকা। আর এটা সাইবারবাসীর বিশাল প্রাপ্তি বলা যায়। দিগন্ত উন্মুক্ত তাদের সামনে। তাই খেলা ভাঙার খেলা খেলতে শুরু করলেন তারা। যা নয় তাই বলে চলল...

‘দেবী’, ‘হর হর ব্যোমকেশ’, ‘ওয়ান’-এর মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন র‍্যাচেল। এ ছাড়া একাধিক বাংলা ছবিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। তবে শুধু টলিপাড়ায় আটকে থাকেননি তিনি। নিজ গুণে বলিউডে নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছেন। সে সব চুলোয় যাক! মেয়েদের যৌনচেতনা সমাজের সামনে এ ভাবে এলে সমাজের অবক্ষয় নিশ্চিত! এই গড়পরতা ধারণা নিয়ে র‌্যাচেল ট্রোলিং-এর শিকার হন।

আসলে ট্রোলিং এবং হেনস্থায় যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে, সেটা আন্দাজ করতে পারেন না নেটিজেনদের অধিকাংশ। যার জেরে সোশ্যাল মিডিয়ায় মাঝেমধ্যেই তারকারা আক্রান্ত হন, তবে অনেকেই বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করতে চান না৷ কিন্তু মুখ বুঝে মেনে নেওয়ার পাত্রী নন টলি অভিনেত্রী নুসরত জাহান৷ সম্প্রতি ইনস্টাগ্রামে চরম হেনস্থার শিকার হন এই টলি নায়িকা। ঘটনাচক্রে প্রতিবাদ করতে ময়দানেও নামেন এই অভিনেত্রী৷

আসলে সম্প্রতি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে নিজের কয়েকটি ছবি আপলোড করেন নুসরত৷ কমেন্ট বক্সে প্রতিক্রিয়াও আসতে থাকে৷ সেই সময় হঠাৎই এক ব্যক্তি কমেন্ট করে বলেন, “আপনার মুখটা পারফেক্ট ব্লোজাবের জন্য!” স্বাভাবিকভাবেই তিনি আন্দাজ করেছিলেন হয়তো অভিনেত্রী কমেন্ট পড়ে কোন প্রতিক্রিয়া দেবেন না৷ কিন্তু এখানে ঘটল উলটপুরাণ৷ কিছু ক্ষণ বাদেই নুসরত রিপ্লাই দেন, “আশা করি আপনার ছবি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে আছে এবং আপনি এটাও জানেন যে কলকাতা পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ কতটা সক্রিয়৷ এর পর থেকে এই সব নোংরা কমেন্ট করার আগে দয়া করে দ্বিতীয়বার ভাববেন৷ পরবর্তীকালে মহিলাদের সম্মান করবেন৷ আর পারলে আমায় আনফলো করবেন!”

সম্প্রতি ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ডের অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে নিজের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছিলেন দিশা। সেখানেই তাঁর পোশাক নিয়ে আপত্তিজনক মন্তব্য করেন এক ব্যক্তি। আপাতত তা ওয়েব ওয়ার্ল্ডে ভাইরাল।

এই ঘটনার জবাব দিতে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেই মুখ খুলেছেন দিশা। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘কতটা দেহ ঢাকা পোশাক পরেছে তা দেখে একটি মেয়েকে বিচার করা খুব সহজ। কিন্তু নিজেদের খারাপ মানসিকতার কথা স্বীকার করতে অসুবিধে হয় না? আপনারাই মেয়েটির দেহের সেই সব অংশের দিকে তাকিয়ে থাকেন যা ঢেকে পোশাক পরতে বলেন আপনারাই।’’

আরও পড়ুন: যাঁরা প্রতিবাদের ভাষা শুনতে চান, তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়াকে আঁকড়ে ধরেছেন

কংগ্রেসের টুইটার অ্যাকাউন্টের ফলোয়ার হলেন বলিউড অভিনেত্রী সোনম কপূর। পাল্টা ‘নীরজা’ অভিনেত্রীকে ধন্যবাদ জানায় কংগ্রেস। আর এর পরই সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়ে গেল ট্রোল-পর্ব।

উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্টে লেখা হয়, ‘খুব ভাল কথা। এক রকমের বুদ্ধির লোকেদের একে অপরের ফলো করাই উচিত।’

অন্য এক ইউজার রসিকতার ছলে লিখেছেন, ‘আমিও তো কংগ্রেসকে ফলো করি। কিন্তু দল আমাকে কখনও ধন্যবাদ জানায়নি।’

বিজেপিকে নিশানা করে জুমলা মুক্ত ভারত নামে একটি হ্যান্ডেলে লেখা হয়, ‘সোনম কপূরেরও আর জুমলায় ভরসা নেই।’

আসলে এই ইউজারের ইঙ্গিত, সোনম বিজেপির বিপক্ষ দল কংগ্রেসকে ফলো করেন।

রেহাই আর কোথাও নেই, কিছুতে নেই।

কোনও কোনও সেলিব্রিটি অবশ্য নিজের ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য বুক পেতে ট্রোলড হচ্ছেন। ছবি নেই, অন্য কাজ নেই? করা যাক কোনও রসালো মন্তব্য, দেওয়া যাক এমন সব ছবি। এই শীতেও ঠান্ডা হয়ে যাবে সব্বাই! বাড়বে ফলোয়ার, চর্চা হবে বিশ্বময়! আর কী বা চাই?

প্রধানমন্ত্রী থেকে অভিনেত্রী, সকলকে তুলোধনা করার আশা নিয়ে ফাঁদ পেতে বসে আছে জন-গণ-মন।

ট্রোলের ফাঁদ পাতা ভুবনে। কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement