অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
মানুষ তো সমাজবদ্ধ জীব। সম্পর্ক, আরও সম্পর্ক আমাদের বেঁচে থাকার বড় রসদ। দূরে চলে যাওয়া বন্ধু বা ভাই-বোন-পিসি-জ্যাঠার সঙ্গে এক কালে যোগাযোগের সুতো ছিল চিঠি। কখনও তা নিয়ে যেত পায়রায়, কখনও মানুষে। পরে ডাক ব্যবস্থা আধুনিক হল। হরকরা হল পোস্টম্যান। পোস্টাপিসের চিঠি, মেল ট্রেনে দৌড় ছেড়ে এক সময় এয়ারমেলে উড়ে গেল। সেই চিঠিতে যেমন চেনা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ চলত, তেমনই অপরিচয়ের বা অল্প পরিচয়ের গণ্ডি ভেঙে তৈরি হয়ে যেত কত পত্রমিতালির সম্পর্কও। অচেনাও, হয়ে উঠত বন্ধু। এ সব আমাদের আগের জেনারেশনের অনেককেই, এখনও স্মৃতিমেদুর করে তোলে।
এর মাঝে এসে গিয়েছিল টেলিফোন। এতে, হাতে লেখা মনের কথা অনেক দূর পথ পেরিয়ে পৌঁছনোর অপেক্ষা করতে হয় না। সরাসরি এ পারে ও পারে কথোপকথন। এ ভাবেই প্রযুক্তির হাত ধরে এই সামাজিক বন্ধন বা নির্ভরতার সেতু দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে সময়ের সাথে সাথে। এ অগ্রগতির পথেই, এ যাবত্ সর্বোত্তম উদ্ভাবনটি হল ইন্টারনেট।
ইন্টারনেট আসার আগে, সব যোগাযোগ মাধ্যমই ছিল মূলত একরৈখিক। একের সঙ্গে একের যোগাযোগ। কিন্তু নতুন বিপ্লব— একই সময়ে, দূরে দূরে থাকা অনেক মানুষকে, একই প্ল্যাটফর্মে, একসঙ্গে অ্যাকটিভ হয়ে থাকার অভূতপূর্ব সুযোগটা এনে দিল। এমনটা আর কখনও হয়নি।
এ ভাবেই আমরা আজ হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাট করছি। ফেসবুক তো আছেই। আমার কথা এই ফেসবুকের মতো সামাজিক প্ল্যাটফর্ম নিয়েই। এটা ঘরে বসেই বিশ্বের যে কোনও জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বন্ধুদের কাছে টেনে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সহজে বন্ধুত্ব করতে পারছি আমরা, জানতে পারছি অচেনা মানুষদের আদব কায়দা বা জীবনযাত্রা, যা বাড়িয়ে তুলছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সখ্য। এর ব্যবহার মানুষের যোগাযোগকে যেমন সহজ করেছে, তেমনই অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে সাহিত্য চর্চা থেকে শুরু করে নানান সামাজিক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করার অন্যতম প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে ফেসবুক।
ফেসবুকে আমার প্রবেশ মাত্র তিন বছর৷ তার আগে কিছুটা নেতিবাচক ধারণাই ছিল ফেসবুক সম্পর্কে। কিন্তু আজ এই ফেসবুকটাই নিজেকে মানুষের মধ্যে মেলে ধরা এবং মানুষের সঙ্গে আমার পরিচিতির অন্যতম প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আমার মত এক সাধারণ গৃহবধূ, যাদের কাছে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই থাকে পুরো দুনিয়া, যাদের পরিচয় বলতে শুধু বোঝায় ভোটার কার্ড বা আধার কার্ড, তারাও আজ বহু মানুষের কাছে পরিচিত। হ্যাঁ,আমার মতো একজন অতি সাধারণ গৃহবধূকে আজ পাঁচশোর উপর অচেনা মানুষ চিনেছেন৷ সত্যি তাই, ফেসবুকের একটা গ্রুপের ক্রিয়েটার হিসেবে সেই সঙ্গে দীর্ঘ দিন পুষে রাখা দু’কলম লেখালেখি করার অদম্য ইচ্ছেটা আজ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং পৌঁছে গিয়েছে অসংখ্য মানুষের কাছে এই ফেসবুকের হাত ধরেই। এই এক বছরে, আমাদের ফেসবুক সাহিত্য গ্রুপ ‘সোনারতরী’র পরিচালনায়, ছাপা মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে ‘স্বপ্নের ক্যানভাস’ পত্রিকার দু’দুটো সংখ্যা৷ এটা জীবনের একটা বড় পাওনা নয় কি? আজ ফেসবুকে অনেক গ্রুপ আছে। সাহিত্য-বিনোদন থেকে শুরু করে রান্নাবান্না, পোশাক-পরিচ্ছদ এমনকি রক্তদান থেকে দুঃস্থ ও অনাথ শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর মত গ্রুপও আছে এই ফেসবুকে এবং যারা কাজ করে চলেছেন নিরন্তর৷ বহু মানুষ উপকৃত হচ্ছেন এবং সেটা আমরা নিজেদের চোখেই দেখতে পাচ্ছি৷ যেমন Quest for life— ফেসবুকে তৈরি হওয়া গ্রুপ, যারা দু’বছর ধরে পরিচালনা করে চলেছে সরাসরি রক্তদাতাদের সংগঠিত করার কাজ। বর্তমানে সাতজন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর সারা বছরের রক্তের জোগান দেন তাঁরা। সঙ্গে অনাথ শিশুদের সরাসরি চিকিৎসা দেওয়ার মতো কঠিন কাজটাও তাঁরা করে চলেছেন নিয়মিত, নিজেদের সাধ্য মতো।
এ ছাড়াও আছে ‘লিভ টুগেদার ওয়েলফেয়ার গ্রুপ’— যেটা সমাজের দুঃস্থ, গরিব মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। ঐ গ্রুপের কর্ণধার থেকে শুরু করে সাধারণ সদস্যরা সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাহায্য করে ২০১১ থেকে আজ পর্যন্ত উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে চলেছেন। ‘লিভ টুগেদার ওয়েলফেয়ার গ্রুপ’ বছরে এক বার রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে। দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের খাতা, কলম, বই, জামাকাপড় দেওয়া ছাড়াও, পথশিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া তাদের এই কর্মকাণ্ড বহু অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলছে। এই ফেসবুক মাধ্যমটা আছে বলেই, ওঁরা এই সব কল্যাণমূলক কাজ দ্রুতগতিতে করতে পারছেন।
মানুষের অসামাজিক আচরণের অনেক ছবি আজ খবরের কাগজে, টেলিভিশনে বা নিউজ ওয়েবসাইটগুলোয় প্রকাশ পাওয়ার আগেই ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুকে, বা অন্য কোনও সোশ্যাল মিডিয়ায়৷ পুলিশ পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ কারও অর্থ সাহায্যের প্রয়োজন পড়লেও এগিয়ে যাচ্ছে বেশ কিছু ফেসবুক গ্রুপ, সহজেই যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে অনাথ আশ্রম বা বৃদ্ধাশ্রমের সাথে, সরাসরি খুঁজে নেওয়া যাচ্ছে সঠিক রক্তদাতাদের।
অনেক মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপডেট দেন, নিন্দুকেরা বলেন এ সব লোক দেখানো কাজ৷ ব্যক্তিগত ভাবে এটা আমার মতো আরও অনেকেরই অপছন্দের। সে তো ব্যাক্তিগত পছন্দ-অপন্দের ফারাক থাকেই। আবার কেউ কেউ মনে করেন, একজনের ছবি দেখে আরও একজন তাকে টক্কর দিতেই হয়ত অন্য দু’জনের দিকে বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত৷ হয়ত লোক দেখানো, কিন্তু দুটো মানুষ যখন উপকৃত হয়, তখন মনে হয় তুলুক না কটা ছবি!
আজ আমার মতই বেশ কয়েক জন গৃহিণী, যারা এত দিন সংসার আর বাচ্চা মানুষ করার তাগিদে নিজেদের অস্তিত্বকেই হারিয়ে ফেলেছিল, তাদের উৎসাহিত করে, তাদের দিয়ে ‘সোনারতরী’র মত আরও কিছু সাহিত্য গ্রুপ নানা রকম ইভেন্টের মাধ্যমে দু’কলম লেখাতে পারছে, সেটাই বা কম কি! এই ফেসবুককে কেন্দ্র করে যে সব গ্রুপ পত্রিকা প্রকাশ করছে, তাতে কত অনামী লেখক-লেখিকার নিজস্ব ভাবনা নতুন নতুন লেখার রূপ পেয়ে উঠে আসছে পাঠকদের চোখের সামনে৷ এটা কি ভাল সংকেত নয়!
জানি এই রকম উদ্যোগ অনেক আগেও হয়েছে, ফেসবুক আসার আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু এই কাজগুলোর পিছনের একটা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফেসবুকের বড় ভূমিকাকে আমরা এখন সত্যিই আর অস্বীকার করতে পারি না।
ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের সাথে চট জলদি বন্ধুত্ব হচ্ছে, অজানা অচেনা মানুষগুলোর সবাই যে ভাল হয় তাও নয়। সমাজের অন্যান্য অংশের মতো এখানেও অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু মানুষ আসেন বন্ধুর বেশে৷ অনেক ক্ষেত্রে আমরা সহজেই প্রতারিত হই৷ ভালবাসার হাতছানি বা কল্পিত এক সুন্দর জীবনের প্রলোভনের শিকার হন কত যুবক যুবতী থেকে শুরু করে একাকিত্বে গুমরে থাকা সাধারণ বধূ৷ কিন্তু এই ঘটনা কি শুধু সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই হয়? এমন প্রতারণা তো আগে থেকেই চলে আসছে সমাজের প্রতিটা স্তরে৷ সোশ্যাল মিডিয়ার অনেক খবর মিথ্যেও হয়, এমনও দেখা গেছে৷ ফেসবুকের মতো এক অতিদ্রুত সামাজিক মাধ্যমে মোহের বশে মানুষ খুব সহজে ক্ষতির কবলে পড়ছে ঠিকই, কিন্তু সাবধানতা তো সর্বক্ষেত্রেই প্রয়োজন।
ভাল মন্দ সব মানুষগুলোর সাথে মিশে আমাদের অভিজ্ঞতা যে সত্যি বৃদ্ধি পায়, সেটা আমি জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছি৷ যত মানুষের সাথে মিশেছি নিজেকে আপডেট করতে পেরেছি,অভিজ্ঞ হয়েছি ক্রমশ৷ আমার মত ভিতু, নিজেকে সবার পিছনে লুকিয়ে রাখা মহিলাও আজ নিজের কথা নিজের ভাষায় লিখে পোস্ট করে পৌঁছে যেতে পারে বহু মানুষের সামনে৷ এটা কম নয়৷ কত অবসর প্রাপ্ত মানুষের আজ একাকিত্বের সাথী হয়ে দাঁড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া বা ফেসবুক৷ আমার নিজের এক চেনা মানুষ, যে আজ চার বছর ধরে শয্যাশায়ী, জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়েছেন ভেবে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল যে মানুষ, সেই মানুষই আজ বিছানায় শুয়ে শুয়ে মানুষকে জীবনের পাঠ পড়িয়ে তাঁদের কষ্টের মলম হয়ে উঠেছে। তাঁদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। ফেসবুকের মাধ্যমে।
কে বলে স্যোসাল মিডিয়া থেকে ভাল বন্ধুত্ব হয় না? আজ সোনারতরীর পরিচালনায় যে মানুষগুলো আমার পাশে আছেন, তাঁরা প্রত্যেকে আমার ফেসবুক থেকে পরিচিত৷ কিন্তু আজ তাঁদের ছাড়া আমার জীবনটাও কল্পনা করতে পারি না আর৷ এই দাদা, দিদি, ভাই, বোন এবং বন্ধুরা যদি না থাকত, আমার মত মেয়ে হয়ত কুয়োর ব্যাঙ হয়েই কাটিয়ে যেত গতে বাঁধা চার দেওয়ালের মাঝখানে৷ যেখানে মেকি সুখের পরশ হয়ত লেগে থাকতো, কিন্তু স্বাধীনতার এই অবকাশ তো থাকতো না৷ ‘স্বপ্নের ক্যানভাস’ এ আমার মত অতি তুচ্ছ সাধারণ গৃহবধূরা নিজের কল্পনার রামধনু রঙে সৃষ্টি করছে নিজেদের লেখনী৷ এটা তো এই ফেসবুক থেকে পরম প্রাপ্তি৷ ভাল মন্দ সব মিলেই তো জীবন, ভালটাকে বেছে নেব নাকি মন্দের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাব সবটাই তো নির্ভর করে আছে আমাদের নিজেদের উপর৷ তাই অকপটে স্বীকার করছি, নেতিবাচক দিক থাকলেও, ইতিবাচক এটাই যে— আমাকে বা আমার মতো অসংখ্য মানুষের স্বপ্ন পূরণের মাধ্যম আজ ফেসবুক।