গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ
ছোটবেলার এক ডিবেটে সম্ভাবনায় উল্টোদিকের বন্ধু যা বলেছিল ঠিক সেই কথাগুলোই বলে, ভয়ানক বকা খেয়েছিলাম শিক্ষিকার। ‘বন্ধুর কথাগুলো আমারও কথা’ বলে রেহাই পাইনি। ডিবেটে ‘কিন্তু আমার বন্ধু যা বলল’ বলে বিপরীত কথা বলাই যে দস্তুর।কিন্তু সেই বিপরীত কথা বলতে বলতেও সবসময় মনে রাখত হত যে, যার বিরুদ্ধে বলছি, সে আমার বন্ধু এবং বন্ধুই। স্কুল থেকে আমি আর জয়দীপ ডিবেট করতে গিয়েছি, দু’জন দু’দিকে, ফেরার পথে আমার বলা বেশি ভাল হয়েছে বলে জয়দীপের বাবা আমায় কোলে তুলে নিয়েছেন, জয়দীপ হেঁটে হেঁটে গাড়ি অবধি এসেছে। এ আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা, এনসাইক্লোপিডিয়া ঘাঁটার দরকার নেই।
আমি তাই সত্যিই খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যখন গতবছর আমার কোনও লেখা পছন্দ না হওয়ায় নিজেকে কবি হিসেবে দাবি করা জনৈক, আমার বাবা তুলে গালাগালি দিয়েছিল ফেসবুকে এবং আমার দুই বন্ধু তাতে ‘লাইক’ এবং ‘কমেন্ট’ করে সমর্থন দিয়েছিল। পরে সেই দু’জনেই আমার কাছে দুঃখপ্রকাশ করে। কিন্তু আমার মনে যে হেতু বন্ধুদের বাবা’দের নিয়েও একটা ভূস্বর্গ আছে তাই এই প্রশ্ন থেকেই গেছে যে কারও উপর যত রাগই হোক, তার মৃত বা জীবিত বাবাকে নিয়ে খারাপ কথা কেউ কী ভাবে বলতে পারে?
শুধু তো বাবা নয়, বাবা’র চেয়ে অনেক বেশি আক্রমণ বরাদ্দ থাকে মায়েদের জন্য। জীবনে যাকে দেখেনি, তেমন কাউকেও, স্রেফ মতের অমিল হচ্ছে বলে, ‘আমি তোর মাকে...’ বলে অমানুষিক গালাগালি দেওয়ার পরম্পরা তৈরি হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। “কী আর করা যাবে এখন দুনিয়াটাই এরকম,” বলে কেউ কেউ লঘু করার চেষ্টা করেন ব্যাপারটাকে, কেউ আবার ওইসব অবিমিশ্র পাঁক যাদের আঙুল দিয়ে বেরোচ্ছে তাদের, ‘ওরা কিন্তু সামনে থেকে এরকম নয়’ বলে আড়াল দেওয়ার চেষ্টা করেন। এতে কু-কথার তোড় থামে না বরং নতুন চেহারায় নতুন পাড়ায় মাথা তোলে। আর সেইসব পাড়ার অধিকাংশ বাসিন্দাই শিক্ষক-অধ্যাপক-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-সফ্টওয়্যার প্রফেশনাল-সাংবাদিক-কর্পোরেট হঞ্চো, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আচ্ছা, কোনওদিন কোনও প্লাম্বার কিংবা রাজমিস্ত্রিকে দেখেছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় এ-ওকে বাপ-মা তুলে অশ্রাব্য খিস্তিখেউর করতে? সহজ উত্তর হল গিয়ে যে ওঁরা তো অশিক্ষিত, তাই সোশ্যাল মিডিয়াতেই নেই। ওঁদের কথা উঠছে কেন? উঠছে, তার কারণ সোশ্যালি-ও ওঁরা ওই ভাষা ব্যবহার করেন না যা আমার-আপনার চারপাশে মিথেন গ্যাসের মতো ঘুরে বেড়ায়, অহরহ। দায়িত্ব নিয়েই বলছি কথাটা, কারণ আমি নিজে বছর চারেক একটি রিকশাস্ট্যান্ডের সেক্রেটারি ছিলাম। ইচ্ছে করে নয়, অনুরোধ ফেলতে না পেরে, কিন্তু ছিলাম। সেই সময় কত কত সন্ধ্যা, কখনও দুপুরও রিকশাচালকদের সঙ্গে আড্ডায় কেটেছে, বহুবার এর ছেলে, তার মেয়ের হসপিটাল কেস নিয়ে এদিক-ওদিক গিয়েছি, অনেক ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটেরও সাক্ষী, কিন্তু অনেক ভেবেও মনে করতে পারি না, একজন রিকশাওয়ালা আর একজনকে মা-বাবা তুলে গালাগালি দিচ্ছেন। বরং নিজেদের পুত্র-সন্তানেরা খিস্তি করেছে শুনলেই প্রায় প্রত্যেক বাবা মেরে হাড়গোড় তুবড়ে দিতেন নিজের-নিজের ছেলের আর বারবার বলতেন, “ছোটলোক হবি, বড় হয়ে বাপের মতোই ছোটলোক হবি?”
সেই প্রশ্নের বেদনা জল এনে দিত আমার চোখে, কিন্তু সে তো প্রায় বারো-চোদ্দো বছর আগেকার ঘটনা। এখন হলে হয়তো রিকশাচালকদের মুখে ওই প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলতাম কারণ সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এখন ভদ্রলোকেরা যে স্তরের খিস্তি করতে পারেন, তথাকথিত ‘ছোটলোক’রা তার দশ মাইলের মধ্যে আসতে পারবে না।
কিন্তু এমনটাই কি হওয়ার ছিল? নাকি, হতেই হবে? বামপন্থী আর দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে, সৌমিত্র আর উত্তমের মধ্যে, সিদ্ধার্থ রায় আর জ্যোতিবাবুর মধ্যে, এমনটা হয়নি তো কই! যে সোশ্যাল মিডিয়া কারও ও’নেগেটিভ রক্ত প্রয়োজন হলে একঘণ্টার মধ্যে সেই দুর্লভ রক্ত দিতে সক্ষম এমন পাঁচজন ডোনারকে হাজির করতে পারে, সেই সোশ্যাল মিডিয়াকেও কিন্তু এতটা নেগেটিভিটি শোভা দেয় না।
পাল্টালে ভাল বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে না থেকে আমরা নিজেরাই যদি একটা-দুটো পা ফেলি? যদি নিমাই পণ্ডিতের ভাবধারায় তর্ক করি, আরও তর্ক করি, কিন্তু ‘ট্রোল’ না করি কখনও? যদি রামকৃষ্ণ মিশন নিয়েও ‘ফেক নিউজ’ করা অসাংবাদিককে শেয়ারের যোগ্যই না মনে করি? যদি মতামতের ভিন্নতাকে আর একটু শ্রদ্ধা করতে পারি?
সামান্য কুণ্ঠার সঙ্গেই একটা ব্যক্তিগত কথা বলে শেষ করি। এবছর শারদীয়া আনন্দবাজারে প্রকাশিত আমার উপন্যাস ‘মন্ত্র’ একজন মানুষের ‘স্পিরিচুয়াল কোয়েস্ট’ নিয়ে লেখা। উপন্যাসটি আমি দু’বার লিখেছি। প্রথমবার লেখার পরে একজনকে পড়াই। একজনকেই। তিনি চরম নাস্তিক, একসময় সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাস করা একজন মানুষ। তাঁকে পড়ানোর পিছনে আমার উদ্দেশ্য ছিল, সোনা আদৌ সোনা কি না সেটা বোঝার জন্য সোনাকে কষ্টিপাথরে ঘষতে হবে, অন্য কোনও ধাতুতে নয়। আমি ভেবেছিলাম, ওঁর খুব খারাপ লাগবে কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে তিনি জানান যে উপন্যাসটি তাঁকে আপ্লুত করেছে। এরপর তিনি আমাকে উপন্যাসটি প্রথম পুরুষের বদলে তৃতীয় পুরুষে ফিরে লিখতে বলেন, নির্দিষ্ট কয়েকটি কারণ দর্শিয়ে। আমি তাঁর কথা শিরোধার্য করি।
আজ যখন কেউ উপন্যাসটির ভিতরকার ‘আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান’ ভাল লাগার কথা বলেন আমায়, সেই ‘নাস্তিক’ ভদ্রলোকের মুখ মনে পড়ে সর্বপ্রথমে।হাম আগর হাম হ্যায়, তো কেয়া হাম হ্যায়?
তুমি যদি তুমিই শুধু, তাহলে কেমন তুমি?