International Women's Day

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও ভারতীয় প্রেক্ষিত

গোটা বিশ্বে মহিলাদের অধিকারের প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জ ১৯৭৫ সালকে ‘আন্তর্জাতিক মহিলা বর্ষ’ হিসেবে পালন করে। ১৯৭৭ সালের রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ ৮ মার্চ দিনটিকে ‘নারী দিবস’ হিসেবে পালন করার কথা ঘোষণা করে। সে থেকেই গোটা বিশ্বে এই দিনটি পালিত হয়ে আসছেই। ইতিহাস বলে, ‘সময় লাগবে’ বলতে বলতে কয়েক শতাব্দী কেটেছে।

Advertisement

দেবাশিস নাগ

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২০ ০২:০০
Share:

এক মহিলা স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর কিছু সদস্য গত বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস আলোচনার জন্য সমবেত হয়েছিলেন। আমন্ত্রিত হয়েছিলেন সেই দলের সদস্যদের স্বামীরাও। অনুষ্ঠান সম্পর্কিত নানা আলোচনার মাঝে এক জন সদস্য কিছু বক্তব্য রাখার সময়ে হঠাৎ তাঁর স্বামী বলে উঠলেন ‘‘তুমি থামো তো। ওরা যা বলছে শোনো। বেশি বকবক কোরো না।’’ সঙ্গে সঙ্গে মহিলাটি গর্জে উঠে বলেন। ‘‘তোমরা দেখো। এরা আবার নারী স্বাধীনতার কথা বলে। যারা তাঁর স্ত্রীকে এক মিনিটের জন্য বাক্ স্বাধীনতা দেয় না তারা সারা দেশের মেয়েদের উদ্ধার করতে নেমেছেন। সবার সামনে যদি এই কথাটা তোমাকে বলতাম তা হলে তোমার সম্মান কোথায় থাকত?’’ এই প্রতিবাদ শুনে স্বামী খুব লজ্জা পেয়ে বলেন, ‘‘আপনারা ক্ষমা করবেন। আসলে বংশানুক্রমিক অভ্যাস তো। বদলাতে একটু সময় লাগবে। তবে আপনাদের প্রতিবাদেই নারী-পুরুষ এক দিন সমান-সমান হয়ে যাবে।’’

Advertisement

ইতিহাস বলে, ‘সময় লাগবে’ বলতে বলতে কয়েক শতাব্দী কেটেছে। প্রায় দু’শো বছর আগে মেরি ওলস্টোনক্রাফটের লেখা ‘ভিন্ডিকেশন অব দ্য রাইটস অব উওম্যান’ গ্রন্থে নারী স্বাধীনতার কথা প্রকাশিত হওয়ার পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরতা মহিলাদের মধ্যে নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রয়োজন অনুভূত হয়। সেই সময় সংসার চালানোর তাগিদে ইউরোপ, আমেরিকার মেয়েরা বিভিন্ন কল-কারখানায় কাজ করতেন। নিউইয়র্কের পোশাক তৈরির কারখানাগুলিতে অধিক সংখ্যক মহিলা শ্রমিক নিযুক্ত ছিলেন। কাজের কোনও সময়সীমা ছিল না, সেই সঙ্গে ছিল নানা বিপদের ঝুঁকিও। কাজ চলাকালীন মালিকরা বাইরে থেকে কারখানা তালাবন্ধ করে রাখতেন। সামান্য মজুরির বিনিময়ে তাঁরা কাজ করতেন। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য ১৮৫৬ সালের মার্চ মাসে সেখানকার মহিলা শ্রমিকেরা সমবেত হয়ে দশ ঘণ্টা কাজের দাবিতে এক প্রতিবাদ মিছিল বার করেন। সংগঠিত ছিলেন না বলে সে দিন পুলিশি দমনে আন্দোলনকারীদের পিছু হঠতে হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলন থামেনি।

১৯১১ সালে মার্চ মাসে নিউইয়র্কের একটি পোশাক কারখানায় আগুন লাগে। বন্ধ কারখানায় সে দিন দেড়শো মহিলা কর্মরত অবস্থায় প্রাণ হারান। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পাশ্চাত্য দেশগুলিতে নারীমুক্তি আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে। এর পর ১৯১২ সালে ম্যাসাচুসেটস রাজ্যে প্রথম ‘ন্যূনতম বেতন আইন’ চালু হয়। সেই সময়ে আমেরিকার মেয়েদের ভোটাধিকার ছিল না। বরং, তাঁদের বহু কষ্টে উপার্জিত অর্থও স্বামীরা আত্মসাৎ করতেন। এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হন মহিলারা। তাঁদের আন্দোলনের ফলে, ১৯২০ সালে আমেরিকায় নারীদের নাগরিক ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়।

Advertisement

অন্য দিকে, ডেনমার্কের কোপেনহাগেন শহরে ১৯১০ সালে আয়োজিত হয় একটি আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী মহিলা সংগঠনের সভা। সতেরোটি দেশের একশো জন মহিলা সেই সম্মেলনে যোগ দেন। নারীমুক্তি আন্দোলনের নেত্রী জার্মানির ক্লারা জেটলিন ৮ মার্চ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব দেন। তাঁর প্রস্তাবের সমর্থনে ১৯১৪ সাল থেকে কয়েকটি দেশে নারীদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই দিনটি পালিত হতে থাকে।

তার পরে সামাজিক প্রেক্ষিত অনেকটা বদলেছে। দেশে-দেশে নারীমুক্তি আন্দোলন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহিলা সমাবেশ ইত্যাদি হচ্ছে। কিন্তু এখনও বিশ্বের নারীসমাজ কতটা স্বাধিকার পেয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে সমালোচদের মতে, নারীবাদী আন্দোলন আর নারীমুক্তি আন্দোলনের মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য রয়েছে। সামাজিক নানা অসাম্য থেকে নারীদের মুক্তির জন্য প্রযুক্ত হয়েছে ‘নারীমুক্তি’ শব্দগুচ্ছ। পক্ষান্তরে নারীবাদী আন্দোলন মেয়েদের একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে দেখতে চায়। সমালোচকদের একাংশ বলেন, যেহেতু পাশ্চাত্য দেশগুলিতে বিবাহ-বিচ্ছেদের হার বেশি, সেহেতু সেখানকার নারীবাদী আন্দোলনে অধিকারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মেয়েদের আর্থ-সামাজিক দিক থেকে স্বনির্ভর হওয়ার প্রসঙ্গ। একটা সময় পর্যন্ত নারীমুক্তি আন্দোলন কর্মরতা মহিলাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৬৪ সালে ব্যেটি ফ্রিডানের লেখা বই ‘ফেমিনিন মিস্টিক’ প্রকাশিত হওয়ার পরে, কালক্রমে এই আল্দোলনে শামিল হন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মহিলারাও।

সমালোচকদের মতে, যেহেতু ভারত-সহ নানা দেশের মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মহিলারা মূলত একটা সময় পর্যন্ত বাড়ির কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন তাই তাঁদের এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতটা পাশাচাত্যের থেকে একটু আলাদা। এখানে নারীশিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের জন্য কাজের সুযোগের দাবি ওঠে। বিবাহ বিচ্ছিন্না বা বিধবা মহিলাদের বেশিরভাগই থাকতেন তাঁদের বাপের বাড়িতে। সেখানে বাবা-দাদাদের কাছে আশ্রিত হয়ে থাকার বদলে, ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে আর্থিক ভাবে সাবলম্বী হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। ফলে, এই দেশে সমাজের বেশিরভাগ মহিলাদের নারীমুক্তি আন্দোলনের ঢেউকে গ্রহণ করতে স্বাধীনতার পরেও কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

তবে গোটা বিশ্বে মহিলাদের অধিকারের প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জ ১৯৭৫ সালকে ‘আন্তর্জাতিক মহিলা বর্ষ’ হিসেবে পালন করে। ১৯৭৭ সালের রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ ৮ মার্চ দিনটিকে ‘নারী দিবস’ হিসেবে পালন করার কথা ঘোষণা করে। সে থেকেই গোটা বিশ্বে এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে।

ভারতীয় সমাজের বিবর্তনের ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মূলত পুরুষতান্ত্রিক ভাবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চালিত হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সমাজে বেশ কিছু নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। মধ্যযুগে সুলতানা রাজিয়া থেকে শুরু করে উনিশ-বিশ শতকে রানি রাসমনি, সারদাদেবী, সাবিত্রী ফুলে, সিস্টার নিবেদিতা, ঠাকুরবাড়ির নানা মহিলা সদস্য— সাহিত্য, ধর্ম, রাজকার্যের মতো ক্ষেত্রে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছিলেন। নারীস্বাধীনতার বিষয়টিকে নিয়ে রাজনীতির ময়দানেও প্রয়াসের খামতি নেই। মহিলাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে, নির্বাচনে তাঁদের জন্য একটা নির্দিষ্ট শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের বহু প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে বসেছেন মহিলারা। চিকিৎসা থেকে শুরু করে সাহিত্য— সর্বত্র মহিলাদের যোগদানের হার বাড়ছে।

কিন্তু এত কিছুর পরেও থেকে যাচ্ছে কিছু প্রশ্ন? প্রথমত, নারীমুক্তির কথা বলা হলেও মহিলারা কি সর্বত্র সমানাধিকার অর্জন করেছেন? দ্বিতীয়ত, সর্বত্র মহিলাদের যোগদানের কথা বলা হলেও নারীর যথাযথ বা প্রকৃত ক্ষমতায়ন হচ্ছে কি? সরাসরি এর উত্তর দেওয়ার বদলে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। পঞ্চায়েত, পুরসভা নির্বাচনে যেহেতু মহিলাদের জন্য প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে, ফলে, বহু গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতির শীর্ষপদে মহিলারা রয়েছেন। কিন্তু বহু জায়গায় দেখা যায়, চেয়ারে এক জন মহিলা বসে রয়েছেন। কিন্তু তাঁর অপর দিকের চেয়ারে বসে কোনও এক পুরুষ যে যে কাগজ মহিলাকে দিচ্ছেন তিনি অন্ধের মতো তাতে সই করে যাচ্ছেন। ওই মহিলাটি হয় তাঁর স্বামী, নয় আত্মীয়, নয়তো দলীয় কোনও নেতা।

ফলে, প্রশ্ন উঠছে, নারীদের স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কোথাও প্রভাবিত হচ্ছে না তো? আবার একই ভাবে কোনও পুরুষ পঞ্চায়েত প্রধানের আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়ে যাওয়ার ফলে ভোটে দাঁড়াচ্ছেন তাঁর স্ত্রী বা কোনও আত্মীয়-পরিচিত। ফলে, ক্ষময়তায়ন কেবল একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে কিনা সে প্রশ্নও উঠছে। একশো দিনের কাজ, কৃষি-সহ নানা ক্ষেত্রে মহিলাদের যোগদানের হার বাড়লেও, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নারী নিগ্রহের ঘটনাও। গত কয়েক বছরে দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে নারী ধর্ষণ ও হত্যার যে নারকীয়তা দেখা গিয়েছে, তাকে পাশবিক বললেও কম বলা হবে। তাই নারী দিবসের প্রাক্কালে সবার আগে দরকার নারীদের স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া এবং তাঁর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা।

শিক্ষক ও গবেষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement