ইটভাটার মহিলা শ্রমিকেরা। ফাইল চিত্র
‘প্রার্থনার গানের মতন’ জীবন আমাদের সবারই কাম্য। তার জন্য প্রয়োজন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সম বিকাশ। যা মানব কল্যাণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সবই ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু স্থায়ী সম্পদ ডেকে আনল বিপর্যয়। সম্পদ আনল সুখ। সুখ পরিপূর্ণ হলো অধিকারে। অধিকারের উচ্ছেদে। এক অর্থে বলা যায়, ‘মাতৃ অধিকারের উচ্ছেদ স্ত্রীজাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়।’ নারী হল পদানত, অবনত, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। যুগ যুগ ধরে চলল শাসন ও শোষণ। সব কিছুরই যেমন একটা ক্লাইম্যাক্স থাকে, তেমনই এই নিপীড়নও পৌঁছল তার ভবিতব্য ক্লাইম্যাক্সে। শুরু হল উল্টোরথের পালা। ধীরে ধীরে দেখা গেল অরুণোদয়।
ফরাসি বিপ্লবজাত অধিকার আন্দোলন জোগাল মূক মুখে ভাষা। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের লেখা ‘ভিন্ডিকেশন অফ দ্য রাইটস অফ উইমেন’ গ্রন্থে প্রথম উচ্চস্বরে ঘোষিত হল নারীর অধিকারের দাবি। বিশেষ করে শিক্ষার দাবি। টমাস পেন উত্থাপন করলেন শ্রমজীবী নারীর সমস্যা। জার্মান সমাজতন্ত্রবাদের অগ্রগণ্যা নেত্রী ক্লারা জেটকিন (১৮৫৭-১৯৩৩) নারী শ্রমিকদের স্বার্থে গড়ে তুলতে চাইলেন তীব্র আন্দোলন। মায়েদের জন্য আট ঘণ্টা কাজের সময়, শনিবার বিকেলে ছুটি, সন্তান জন্মানোর পর ছয় সপ্তাহের ছুটি প্রভৃতি দাবি আদায়ের জন্য সোচ্চার হলেন তিনি। ক্রমান্বয়ে নারীর অধিকার আন্দোলনের পরিসরে ঢুকে পড়ল ভোটাধিকার থেকে শুরু করে যাবতীয় বৈষম্যমূলক ও অবদমন মূলক সামাজিক নিষ্পেষণের প্রসঙ্গ।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় ঘোষিত হল ‘ইউনিভার্সাল ডিক্ল্যারেশন অফ হিউম্যান রাইটস’। তাতে লিঙ্গ-বৈষম্য ও নারীর অধিকারের বিষয়টি আশ্চর্যজনক ভাবে কোনও গুরুত্বই পেল না। অথচ তখন বিভিন্ন দেশে নারীমুক্তি আন্দোলন ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে চলেছে। প্রায় ২৭ বছর পরে ১৯৭৫ সালকে রাষ্ট্রপুঞ্জ ‘আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। আর ১৯৭৯ সালে ‘কনভেনশন অন এলিমিনেশন অফ ডিসক্রিমিনেশন এগেনস্ট উইমেন’ নামক দলিল গ্রহণ করা হয় এবং ১৯৮১-তে তা গৃহীত হয়। মেয়েদের বিরুদ্ধে যাবতীয় বৈষম্যের অবসান সংক্রান্ত এই দলিল গ্রহণ করতে সময় লেগে গেল ৩৩ বছর। আরও পরে ১৯৯৩ সালে ভিয়েনা সম্মেলনের পরে নারীর অধিকার মানবাধিকারের স্বীকৃতি পায়। এই ঘটনা বিস্ময়কর হলেও সত্যি।
আরও পড়ুন:
ওরা তোমার লোক? অ মা, আমরা কার লোক তবে?
নারী-পুরুষ এবং বিভাজনের বোধ রোজ ভাঙছে-গড়ছে বলিউড
উনবিংশ শতকে বাংলা ও ভারতবর্ষে বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণীজনের হাত ধরে শুরু হয় আমাদের দেশে নারীশিক্ষার। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, দয়ানন্দ সরস্বতী প্রভৃতি প্রাতঃস্মরণীয় মানুষের প্রচেষ্টায় শুরু হয় নারীশিক্ষার। তবে শুধু পুরুষ নন, নারীরাও সে যুগে নারীশিক্ষার প্রচারে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। মহারাষ্ট্রে পণ্ডিত মহিলা রমাবাই, মাদ্রাজে ভগিনী শুভলক্ষ্মী ও বাংলায় বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন উল্লেখযোগ্য। সম্ভ্রান্ত পরিবারের পাশাপাশি সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্গের নারীদের শিক্ষার জন্য শুরু হয় প্রচেষ্টা। মহারাষ্ট্রের জ্যোতিবা ফুলে ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী দেবী দলিত মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে প্রয়াসী হয়েছিলেন।
আন্দোলন শুরু হয় সংস্কার মুক্তির। সতীদাহ প্রথা রদ, বিধবা বিবাহ এ ক্ষেত্রে দুই মাইলফলক। আর আজ নারীর স্বশক্তিকরণ এর দুই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নারীর পৈতৃক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার ও বিবাহ বিচ্ছেদ। তাই আজকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীরাও যোগ্য সঙ্গত করছে দেশ গড়ার কাজে। আর আপন আপন যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা অনুযায়ী সংগ্রহ করে নিচ্ছে রুটি-রুজি। তবুও মাঝে মাঝে ঘটে যায় বিপর্যয়। সংঘটিত হয় নির্ভয়া-কাণ্ড।
নারী অধিকার রক্ষায় আইনি সুরক্ষাও বিস্তর। ৪৯৮এ থেকে ৩৫৪এ, ৩৫৪বি, ৩৫৪সি, ৩৫৪ডি (অশ্লীল ব্যবহারের বিচার হয় এই ধারাগুলিতে) ও আরও অনেক কিছু। কিন্তু কোথায় আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত আলোকিত পৃথিবী? মেয়েদের জন্য বাসে আলাদা সিট, আলাদা ট্রেনের কামরা কিংবা ট্রেন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কোন কিছুতেই কি সুরাহা হল? বিচ্ছিন্নতায় বোধহয় কোনও সমাধান হওয়ার নয়। চাই বন্ধুত্ব। চাই আদর্শ। সমাজের সর্বস্তরে যে অবক্ষয়, সেই অবক্ষয় দেখতে দেখতে , অভ্যস্ত হতে হতে এক পুরুষ কী করেই বা সম্মান জানাতে শিখবে নারীকে? তাই আমাদের নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে মানুষ হওয়ার আর মানুষ গড়ার জন্য। তবেই সার্থক হবে- ‘‘I am Generation Equality: Realizing Women's Rghts.’’
লেখক রঘুনাথপুর কলেজের শিক্ষক