ইচ্ছে না হলে আমাকে ভোট দেবেন না, বলেছিলেন ইন্দ্রজিৎ

অনাড়ম্বর জীবনযাপন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও যাপন-চিত্রে কোনও বদল আসেনি। প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং স্পষ্টবক্তা ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের সঙ্গে জড়িয়ে মেদিনীপুরের অনেক স্মৃতি। লিখলেন অতনু মিত্রসেদিন সারা শহরে ভাষণ নিয়ে গুঞ্জন ছিল। কেউ বলেছিলেন, এটা ঔদ্ধত্য। কেউ বলেন, এটাই স্পষ্টবাদী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৯ ০০:২৩
Share:

মেদিনীপুর লজে ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত। —নিজস্ব চিত্র।

একাদশ সাধারণ নির্বাচন। ১৯৯৬ সাল। মেদিনীপুর শহরের কালেক্টারেটের সামনে বামফ্রন্টের নির্বাচনী সভা। বক্তার কথা শোনা যাচ্ছে, ‘‘আপনাদের পাড়ার রাস্তাঘাট নালা তৈরি করা আমার কাজ নয়। তার জন্য পঞ্চায়েত আছে, পৌরসভা আছে। দেশের অনেক বড় বড় বিষয় নিয়ে সংসদে আমাদের ব্যস্ত থাকতে হয়। তার জন্য আমাকে দিল্লিতেই থাকতে হয়। এখানে আমার বসে থাকলে চলবে না। তাতে আপনাদের ইচ্ছে হয় আমাকে ভোট দেবেন, না ইচ্ছে হয় ভোট দেবেন না।’’ বক্তব্যের সুর শুনে দোকানদারদের কেউ কেউ বেরিয়ে এসেছেন। বক্তা সাংসদ ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত।

Advertisement

সেদিন সারা শহরে ভাষণ নিয়ে গুঞ্জন ছিল। কেউ বলেছিলেন, এটা ঔদ্ধত্য। কেউ বলেন, এটাই স্পষ্টবাদী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত। সেবার মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়ে তিনিই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন।

১৯১৯ সালের ১৮ মার্চ কলকাতায় ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের। ডাকনাম ছিল সানি। বাবা সতীশচন্দ্র গুপ্ত আইসিএস। ছিলেন ভারতের অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল এবং রাজ্যসভার প্রথম সচিব। আইসিএস দাদা রণজিৎ গুপ্ত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব। ঠাকুরদা বিহারীলাল গুপ্তও আইসিএস। তিনিই প্রথম ভারতীয় যাঁকে ১৮৭২ সালে ব্রিটিশ সরকার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের মতো উচ্চপদে নিয়োগ করে সরকারি বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। অর্থনীতি ও ইতিহাস নিয়ে পড়তে যান কেমব্রিজের কিংস কলেজে। তিনি কেমব্রিজের ট্রাইপস। বিলেতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রজনীপাম দত্তের কাছে জ্যোতি বসু, ভূপেশ গুপ্ত, রেণু চক্রবর্তী, নিখিল চক্রবর্তীদের সঙ্গে ইন্দ্রজিৎ গুপ্তও মার্কসবাদের পাঠ নিয়েছিলেন। ১৯৪০ সালে দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান। চাইলেন, ‘দলের ক্ষমতার মধ্যে একটি কাজ’। দল তখন বেআইনি ঘোষিত। কাজ করতে হবে আত্মগোপন করে। দলের নির্দেশে ‘ক্যুরিয়ার বয়’ হিসেবে কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি, লাহৌরে চিঠি ও প্রচারপত্র পৌঁছতেন।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

মোট ১১ বারের সাংসদ। লোকসভার ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে বেশিবারের সাংসদ। মেদিনীপুরের সাংসদ ১৯৮৯-২০০১ সাল পর্যন্ত। তিনবার প্রোটেম স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে মেদিনীপুর থেকে জয়ী হয়েই এইচ ডি দেবগৌড়া ও ইন্দ্রকুমার গুজরাল সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন। ১৯৯২ সালে শ্রেষ্ঠ সাংসদ হিসেবে সম্মানীত হন। পুরস্কারের অর্থ দলের তহবিলে দান করেন। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে উপরাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন বলেছিলেন, ‘গাঁধীর বিভিন্ন সভায় তখন এক কমিউনিস্ট যুবক বার বার বাধা দিচ্ছেন। জাতির জনক গাঁধী তাঁকে ডেকে বলেছিলেন, কমিউনিজম কখনও সৌজন্যবোধ হারায় না। সেই যুবক আজকের ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত’। ১৯৬০ সালে সংসদে তাঁর প্রথম ভাষণে ধর্মঘটী শ্রমিকদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নজরে পড়েছিলেন। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করার দাবি তিনিই প্রথম তোলেন।

স্বরাস্ট্রমন্ত্রী হলেও আজীবন সাধারণ জীবনযাপন করেছেন ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত। সাংসদ হিসাবে দিল্লির ওয়েস্টার্ন কোর্টে দু’কামরার কোয়ার্টার পেয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েও মন্ত্রীদের জন্য বরাদ্দ বাংলোয় যাননি। হেঁটেই সংসদে যেতেন। মন্ত্রী হয়েও সরকারি গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরের টারম্যাকে যাননি। এয়ারপোর্টের বাসেই যাতায়াত। সাধারণ মানুষের অসুবিধার জন্য তাঁর কনভয়ে হুটার বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। ছোট বড় সবাইকে ‘আপনি’ বলতেন।

সাংসদ বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মেদিনীপুর এলে কখনই সরকারি অতিথিশালায় থাকতেন না। নিরাপত্তারক্ষীর বিশাল বহর নিয়ে তিনি উঠতেন বটতলার মেদিনীপুর লজে। এখানেই তাঁকে গার্ড অব অনার নিতে দেখেছেন লজের মালিক বিজয়গোপাল মল্লিক। তাঁর সঙ্গে বাড়ির খাবার খেতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্মৃতিচারণ করছিলেন বিজয়বাবু। বললেন, ‘‘১৯৯৬ সালে ভোট শেষ হওয়ার পর সস্ত্রীক ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত দিঘা যেতে চাইলেন। বাসে যেতেও আপত্তি নেই।’’ বিজয়বাবু নিজের গাড়ি চালিয়ে দিঘায় নিয়ে গেলেন। উঠলেন একটি সাধারণ হোটেলে। তখন ভোট গণনা চলছে। হোটেলের কর্মীরা তাঁকে চিনতে পেরে এলাহি খাবারের আয়োজন করেছেন। পরদিন টিভিতে দেখেন, মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রে তিনি জয়ী। ফিরে সোজা মেদিনীপুরে কলেজের গণনা কেন্দ্রে। ততক্ষণে দিল্লি থেকে লজে এন চন্দ্রবাবু নায়ডুর ফোন এসেছে। যুক্তফ্রন্ট সরকার হবে, ইন্দ্রজিৎ গুপ্তকে দ্রুত দিল্লি আসতে হবে। রাতেই জেলার নির্বাচন আধিকারিক হেম পাণ্ডের হাত থেকে বিজয়ীর শংসাপত্র নিয়ে উড়ে গেলেন দিল্লি। ৮০ বছর বয়সেও গাড়ি নিয়ে ঘুরতেন। ১৯৯৭ সালে নন্দীগ্রামে এক সভায় যাওয়ার জন্য কলাইকুণ্ডায় আসেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও মেদিনীপুরে এসে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতেন না।

১৯৯৮ সালে মেদিনীপুরে ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের নির্বাচনী প্রচার ছিল ঘটনাবহুল। ২ ফেব্রুয়ারি মনোনয়ন জমা দেন। একদিন সোনাকোনিয়া ও মোহনপুরে প্রচার শেষে ফিরছেন। কনভয়ের পুলিশের অয়্যারলেসে খবর এল, স্বরাষ্ট্রসচিব পদ্মনাভাইয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে জরুরি পরামর্শ করতে চান। রাস্তার মাঝে খাকুড়দায় জোড়াগেড়িয়ায় পুলিশের ফাঁড়ি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কনভয় নিয়ে ফাঁড়িতে ঢুকলে ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তাঁর চেয়ারে বসার অনুরোধ করেন। তিনি প্রত্যাখান করে বলেন, ‘আপনি থানার বড়বাবু, এটা আপনার চেয়ার, আমার নয়’। সোনাকোনিয়া, মোহনপুরে নির্বাচনী বক্তৃতায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ‘প্রধানমন্ত্রিত্বের সুযোগ প্রত্যাখান’ নিয়ে সিপিএমের সমালোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘বামপন্থীদের কাছে সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল। দিল্লিতে যুক্তফ্রন্টের সমস্ত নেতা জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী করতে চাইলেন। তাঁর দল হতে দিল না। পরে বলা হল এটা ঐতিহাসিক ভুল। কমরেডস, যে ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে যায়, পিছনে হাত দেখালে সেই ট্রেন কি আর থামবে?’ সেই বক্তব্য সিপিএমের অস্বস্তি বাড়িয়েছিল। কিন্তু কেউ তাঁকে এই ধরনের বক্তব্য থেকে বিরত থাকার কথা বলতে পারেননি। বক্তার প্রবল ব্যক্তিত্বই ছিল বাধা। সফরসঙ্গী এক তরুণ সাংবাদিকের মাধ্যমে সিপিএমের আপত্তির কথা জানানো হয়। ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘এখন ওদের খুব অস্বস্তি হচ্ছে মনে হচ্ছে’। নির্বাচনী সভা করে জাহালদায় হাইস্কুলে দলীয় কর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে বেঞ্চে বসে কলাপাতায় খেয়েছিলেন। সাংসদ হিসেবে খড়্গপুর আইআইটি-র সামনে উড়ালপুল, পাঁশকুড়া-খড়্গপুর তৃতীয় লাইন চালু, মেদিনীপুর- খড়্গপুর মধ্যে ডবল লাইন চালু ও কাঁসাই নদীর উপর দ্বিতীয় রেল সেতু নির্মাণ, ধেড়ুয়া সেতু তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান।

স্পষ্টবাদী ছিলেন। দিল্লিতে ব্যস্ত থাকলেও এলাকার কাজ করার জন্য জেলার নেতাদের কথা শুনতেন। প্রাক্তন বিধায়ক এবং সিপিআইয়ের প্রাক্তন জেলা সম্পাদক সন্তোষ রাণা এখনও মনে করতে পারেন সে কথা।

ক্যানসার হয়েছিল শেষ বয়সে। ২০০১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় প্রয়াত হন ‘ফাদার অব দ্য পার্লামেন্ট’ ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত।

লেখক শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement