ভারত নামক সভ্যতা এই পরিণতির জন্য প্রস্তুত নয়

প্রধানমন্ত্রী সরকারি আধিকারিকদের নিয়োগের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল, তিনি খুব ভালই জানেন, কূটনীতিক বা আমলারা কোথায় কোন পদে নিযুক্ত হবেন সেটা তাঁরা নিজেরা ঠিক করেন না।

Advertisement

জহর সরকার

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০
Share:

পোশাকি: সদ্য-প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির সঙ্গে স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নয়াদিল্লি, ১৫ অগস্ট।ছবি: পিটিআই

নরেন্দ্র মোদীর বাগ্মিতা নিয়ে প্রশ্ন নেই, তবে এটাও ভুললে চলবে না যে, তিনি খুব ভেবেচিন্তে তাঁর কথাগুলোকে বেছে নেন। গুজরাতে ২০০২ সালে মুসলিম নিধনের প্রসঙ্গে তিনি যখন ‘গাড়ির সামনে চলে আসা কুকুরছানা’র কথা বলেছিলেন, তার গূঢ় উদ্দেশ্যটা তখন আমরা অনেকেই হয়তো ধরতে পারিনি। ঠিক তেমনই, সদ্য-প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে গিয়ে তিনি যে তীব্র বচনগুলি উচ্চারণ করেছেন, তার মর্মার্থ বোঝা দরকার। হামিদ আনসারি অভিজ্ঞ কূটনীতিক, কথার মর্ম তিনিও ভাল বোঝেন। তিনি যখন নিজের বিদায়-ভাষণে বললেন, আইন বলবৎ করার ব্যাপারে ‘প্রশাসনের অক্ষমতা’র কারণে দেশের মুসলমানদের মধ্যে একটা নিরাপত্তার অভাববোধ কাজ করছে, তখন তাঁর কথাগুলোর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তিনি আক্ষেপ করেছেন, ভারতের সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য কোথায় হারিয়ে গেল যে, গোমাংসে নিষেধাজ্ঞার প্রশ্নে মুসলমানদের গণপ্রহারে প্রাণ দিতে হয়! এই উক্তিতে প্রধানমন্ত্রী এতটা চটে গেলেন যে, এক জন অত্যন্ত সম্মানিত মানুষকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসলেন? বললেন যে, হামিদ আনসারি নিছক এক জন পশ্চিম-এশিয়া-বিশেষজ্ঞ?

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী সরকারি আধিকারিকদের নিয়োগের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল, তিনি খুব ভালই জানেন, কূটনীতিক বা আমলারা কোথায় কোন পদে নিযুক্ত হবেন সেটা তাঁরা নিজেরা ঠিক করেন না। বস্তুত, তিনি নিজে ইজরায়েল সফরের আগে আরব দুনিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে দেখা করতে ভোলেননি। এখন, হামিদ আনসারি সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যে পশ্চিম এশিয়ার প্রতি ভারতের মনোভাবের যে পরিবর্তনের সংকেত আছে, আরব দেশগুলির রাষ্ট্রদূতরা সকলেই নিজ নিজ দেশের সরকারকে সেটা জানাবেন, তার ফলে এত দিন ধরে আরব দুনিয়া বিষয়ে অনেক যত্নে গড়ে তোলা ভারতীয় কূটনীতির ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে সেটা দুঃখের হবে। মনে রাখতে হবে, ভারতের এই পশ্চিম এশিয়া নীতি কেবল দেশে পেট্রোলিয়মের জোগান মসৃণ রাখতে সাহায্য করেনি, পাকিস্তানকেও সেই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলির কাছে বাড়তি সুবিধা পেতে দেয়নি।

আনসারির বিদায়-সভায় প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই আসনে বসার আগে তিনি কূটনীতির সূক্ষ্ম গতিপ্রকৃতি বুঝতেন না। এই স্বীকারোক্তি প্রশংসনীয়, তবে প্রধানমন্ত্রী হয়ে দুনিয়ার তাবৎ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে আলিঙ্গন করতে তিনি পিছপা হননি, তাঁকে পছন্দ করুন বা না-ই করুন। এবং, এত কিছু করেও জগৎসভায় ভারতের বিশেষ সুবিধা হয়নি, সে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ অর্জনের অভিযানেই হোক, নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপে প্রবেশাধিকারের প্রশ্নেই হোক। বস্তুত, দক্ষিণ এশিয়াতেও বাংলাদেশ ছাড়া আমাদের কোনও বন্ধু নেই, বাংলাদেশও ভারতকে নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নয়। আসলে আন্তর্জাতিক কূটনীতি তো জেলা পরিষদের রাজনীতি নয় যে, ব্যক্তিগত সম্পর্ক দিয়ে কেল্লা ফতে করা যাবে, হঠাৎ নওয়াজ শরিফের বাড়ি গিয়ে ‘হ্যাপি বার্থডে’ বললেই পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্যা মিটে যাবে! কূটনীতি অতি বিষম বস্তু বলে কটাক্ষ না করে তিনি বরং বোঝার চেষ্টা করতে পারতেন, আনসারির মতো প্রবীণ কূটনীতিকরা কী ভাবে আরব দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছেন ও লালন করেছেন।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে ফিরে আসা যাক। তিনি বা তাঁর দল কি সত্যিই ভেবেছিলেন, বিদায়ী উপরাষ্ট্রপতি বলবেন যে, গোমাংসের ওপর নিষেধাজ্ঞা বা সেই কারণে মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের ঘটনাগুলিতে মুসলমানরা খুব খুশি? না কি তিনি বলবেন, ও রকম কিছু ঘটেইনি? সাংবিধানিক পদের অধিকারীদের কি এটাই দায়িত্ব নয় যে, ক্রমাগত এবং স্পষ্টতই একটা ছক অনুসারে অনাচার বা অন্যায় ঘটলে, সে বিষয়ে তাঁরা সরকারকে সতর্ক করবেন? বিশেষত যদি সেই আধিকারিক দেশের সবচেয়ে বরিষ্ঠ মুসলিম আধিকারিক হন? আসলে, ঠিক এই কারণেই মোদী তাঁর আক্রমণের জন্য অ-রাজনৈতিক আনসারিকে বেছে নিয়েছেন এবং বেছে নিয়েছেন রাষ্ট্রপতি পদ থেকে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বিদায়ের ঠিক পরে, যে প্রণববাবুকে তিনি সবচেয়ে সমঝে চলতেন। মোদী মোক্ষম সময়ে আনসারিকে আক্রমণ করেছেন এবং সেই আক্রমণকে একটা ‘রাজনৈতিক’ চেহারা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর পূর্বপুরুষরা কংগ্রেসের জন্য কী করেছেন, সেই প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। প্রকৃতপক্ষে আনসারি পরিবারের প্রধান অবদান ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে, কোনও দলের প্রতি নয়। আরএসএস যে সেই সংগ্রামে কোনও অংশ নেয়নি বা সাভারকর যে প্রথমে অংশ নিলেও এবং ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার সহ্য করলেও পরে একাধিক বার মার্জনাভিক্ষা করেছিলেন, সে সব অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু গাঁধীজির আইন অমান্য, ভারত ছাড়ো বা অন্যান্য যে সব আন্দোলন থেকে আরএসএস তথা বিজেপির পূর্বসূরিরা দূরে ছিল, সেগুলি সম্পর্কে দলের অভিমত ঠিক কী, সেটা পরিষ্কার করে বলা তাদের দায়িত্ব বইকি! কংগ্রেসের সদস্য বা অনুগামী হিসেবে যাঁরা এই সব আন্দোলনে যোগ দিয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে কটাক্ষ না করে মোদী ও তাঁর সহকর্মীরা বরং সে দিকে মন দিতে পারেন।

অবসর গ্রহণের পরে আনসারির আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি বা সংখ্যালঘু কমিশনে কাজ করা নিয়েও মোদী মন্তব্য করেছেন, বলতে চেয়েছেন যে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ‘শুধুমাত্র মুসলিম পরিসরে’ কাজ করার ফলে সীমাবদ্ধ। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহ কখনও তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং ধর্মের পরিমণ্ডলের বাইরে কাজ করেছেন কি না, সে প্রশ্নও তো তা হলে করা দরকার। বস্তুত, হিন্দি বলয়ের যে নেতারা অন্যের খাদ্যাভ্যাস ঠিক করে দিতে এত ব্যগ্র, তাঁরা কি গো-ক্ষেত্রের বাইরে অবশিষ্ট ভারতের অন্য একটি ভাষা বা সংস্কৃতি সম্বন্ধে কিছুমাত্র জানেন? তামিল না-হয় খুব কঠিন ভাষা, কিন্তু এই হিন্দি-সর্বস্ব সৈনিকরা যদি, ধরা যাক, ওড়িয়া শেখার কিংবা কোঙ্কনি সংস্কৃতি একটু জানার চেষ্টা করতেন, তা হলে জানতে পারতেন এই বিচিত্র ভারতের কী সৌন্দর্য আছে, যে সৌন্দর্যের খবর তাঁরা কোনও দিন রাখেননি। হামিদ আনসারি অত্যন্ত সংস্কৃতিমান এক ভারতীয়, সাংস্কৃতিক বহুত্বের বিচারে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বা জাকির হোসেনের যথার্থ উত্তরসূরি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যের কথা যে, তাঁকে আক্রমণ করার জন্য মোদী ও তাঁর দল এমন সব লোককে এগিয়ে দিচ্ছেন, যাঁরা শিক্ষাদীক্ষায় বা রুচিশীলতায় তাঁর ধারেকাছেও আসতে পারবেন না।

একটা কথা স্পষ্ট করে বলে নেওয়া ভাল। মোদীর আক্রমণের জন্য হামিদ আনসারিকে সুপরিকল্পিত ভাবেই বেছে নেওয়া হয়েছে। এতে সেই একই মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে, যা বিজেপির হাতে উত্তরপ্রদেশকে তুলে দিয়েছিল। এই মানসিকতার সার কথা হল, ‘মুসলমানদের নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও দরকার আমাদের নেই।’ এই নির্মম এবং নির্বাচনী পাটিগণিত-সর্বস্ব মানসিকতা নিয়ে ওঁরা কত দিন পার পেয়ে যাবেন, সেটা দেখার। তবে একটা কথা মনে রাখা ভাল। সব শিবিরেই চরমপন্থীরা হয়তো অচিরেই ছোরাছুরি হাতে প্রস্তুত হবে, কিন্তু ভারত নামক মহান সভ্যতা এই পরিণতির জন্য প্রস্তুত নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement