প্রতিবাদ। জমি বিলের বিরুদ্ধে কৃষকরা। যন্তর মন্তর, দিল্লি। মার্চ ২০১৫। ছবি: পিটিআই।
খনি সংক্রান্ত আইন সংশোধন বা বিমা ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের অনুপাত ২৬ থেকে ৪৯ শতাংশ অবধি বাড়ানোর আইন-প্রস্তাব অনুমোদন করিয়ে নেওয়া নরেন্দ্র মোদীর সরকারের পক্ষে তুলনায় সহজ ছিল। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন এবং পুনর্বসতির ক্ষেত্রে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও স্বচ্ছতা বিষয়ক আইন (২০১৩) বা সংক্ষেপে জমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধনের কাজটি দুঃসাধ্য প্রমাণিত হয়েছে। এখন এটা পরিষ্কার যে, সরকার যে ভাবে জমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধন করতে চেয়েছিল, সেটা রাজনৈতিক ভাবে সম্ভব নয়। তাই শেষ পর্যন্ত তারা আপস করতে বাধ্য হয়েছে। এর পর কি বিভিন্ন প্রশ্নে দুর্বল এবং বহুধাবিভক্ত বিরোধী শিবিরকে তুচ্ছ না করে সরকার জনমতের হাওয়া বুঝে আপস করবে? কর্পোরেট ভারত যা চায় সেটাই করে ফেলতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে দু’বার ভাববে? এখনই এতটা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
জমি বিল নিয়ে সরকারের আপসের পিছনে সনিয়া গাঁধীর আকস্মিক রুদ্রমূর্তির বিশেষ কোনও ভূমিকা আছে বলে মনে হয় না। আসলে এই প্রশ্নে বিরোধীদের মধ্যে অস্বাভাবিক সংহতি দেখা গেছে। তৃণমূল কংগ্রেস এবং সিপিআইএম কিংবা সমাজবাদী পার্টি এবং বিএসপি’র মতো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলি জমি বিলের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে। এই বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে বিজেপি বুঝেছে, রাজ্যসভায় এ বিল পাশ করানো সম্ভব নয়। বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি তথা এনডিএ যদি ভাল ফল করে, তা হলেও আগামী চার বছর তারা রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে বলে মনে হয় না। এই কথাটি টের পেয়েছে বলেই শাসক দল নমনীয় হয়েছে।
আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের প্রয়োজন সম্পর্কে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সম্মতি আদায় করতে না পারলে সরকার পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) চালু করতে পারবে না। আগামী বছর মার্চ মাসে জিএসটি চালু হওয়ার কথা। সারা দেশের জন্য অভিন্ন কর ব্যবস্থা সম্ভবত আর্থিক সংস্কারের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ। কিন্তু রাজ্য সরকারগুলির সমর্থন ছাড়া এই ব্যবস্থা চালু করা যাবে না। অনেক রাজ্যই ভয় পাচ্ছে যে, জিএসটি মেনে নিলে তাদের রাজস্ব কমে যাবে, বিশেষত যদি পেট্রোলিয়মজাত পণ্যগুলিকে এর আওতায় আনা হয়। জিএসটি চালু হলে অনেক দুর্নীতির সুযোগ কমে যাবে, ফলে এর বিরুদ্ধে নানা কায়েমি স্বার্থও কাজ করছে। রাজ্য সরকারগুলিকে গোটা পরিস্থিতিটা বোঝানো এবং তাদের রাজস্বহানির ভয় দূর করা কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ। কাজটা কঠিন।
অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি খুব হাঁকডাক করে বলেছেন, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুসারে তাঁরা রাজ্যগুলিকে অনেক বেশি অর্থ হস্তান্তর করছেন। কিন্তু যে ভাবে এই পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে, তাতে ত্রিপুরার মতো কিছু রাজ্য আপাতত সমস্যায় পড়বে। তা ছাড়া, এক দিকে স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণে রাজ্য সরকারগুলির দায়িত্ব বাড়ানো হয়েছে, অন্য দিকে এই ধরনের জনকল্যাণ খাতে খরচ কমানো হয়েছে। এর পরিণাম ভাল হবে বলে মনে হয় না, কারণ অনেক রাজ্য সরকারেরই এই সব প্রকল্প পুরোপুরি নিজের উদ্যোগে রূপায়ণের সামর্থ্য নেই এবং কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের ফলে তাদের সমস্যা হবে।
ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে বিজেপি’র একটা অভিযোগ ছিল এই যে, তারা ‘খিড়কির দরজা দিয়ে আর্থিক সংস্কার’ করছে। কিন্তু ৩০ ডিসেম্বর জমি অধিগ্রহণ আইনের সংশোধনী অডির্নান্স জারি করে এনডিএ সরকারও ঠিক সেটাই করেছে। সরকারের যুক্তি, বছর শেষ হওয়ার আগে সংশোধন জরুরি ছিল, তা না হলে হাইওয়ে, মেট্রো রেল, পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ প্রকল্প ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রের সংশ্লিষ্ট আইনগুলিকে জমি অধিগ্রহণ আইনের আওতায় আনা যেত না। কিন্তু আসলে এই অর্ডিনান্সটির সাহায্যে আরও অনেক কিছু করা হয়েছে, বিশেষত ২০১৩’র জমি অধিগ্রহণ আইনের দুটি রক্ষাকবচ এর ফলে অনেক শিথিল হয়ে গেছে: এক, যাঁদের জমি নেওয়া হবে তাঁদের সম্মতির শর্ত শিথিল করা হয়েছে এবং দুই, অধিগ্রহণের সামাজিক পরিণাম মূল্যায়নের প্রয়োজনও আর আগের মতো থাকছে না।
শুধু বিরোধী রাজনৈতিক শিবির নয়, সঙ্ঘ পরিবারের অন্দরমহলের রকমারি ‘বিরোধী’ সংগঠনও জমি অধিগ্রহণ অর্ডিনান্সের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠার পরে অর্থমন্ত্রী জেটলি স্থির করেন, ‘আক্রমণ’ই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। তখন তিনি এই বলে প্রচার শুরু করেন যে, যাঁরা এই উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা আসলে শিল্পায়নের বিরোধী। তিনি এই প্রচারের কৌশল হিসেবে কয়েক জন মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি বার করে দেখান, তাঁরা ২০১৩ সালের আইনটির কিছু নির্দিষ্ট ধারার বিরোধিতা করেছিলেন, এমনকী ইউপিএ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মার মতো কংগ্রেস নেতারা কী ভাবে ওই আইনের সমালোচনা করেছিলেন, তা বোঝানোর জন্য অর্থমন্ত্রী কিছু ‘গোপন’ চিঠিও ফাঁস করে দিয়েছেন। শিবসেনা বা শিরোমণি অকালি দলের মতো বিজেপি’র জোট-শরিকদের আপত্তি বা অণ্ণা হাজারে এবং পি ভি রাজগোপালের মতো যে জননেতারা এই অর্ডিনান্সের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তাঁদের সমালোচনাকে জেটলি দৃশ্যত কোনও পাত্তাই দেননি।
এই কৌশলে যখন কাজ হল না, তখন মোদী ও জেটলির সমর্থকরা দাবি তুললেন, সংসদের দুই সভার যৌথ অধিবেশন ডেকে বিলটি পাশ করানো হোক, দুই সভা মিলিয়ে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা আদায় করতে পারবে। কিন্তু পরে তাঁরা বুঝতে পারেন, এ ভাবে বিল পাশ করানো কঠিন হবে। লোকসভা ও রাজ্যসভা সমন্বিত ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় কোনও একটি সভায় বিল নাকচ হওয়ার পরে ছ’মাস অতিক্রান্ত হলে তবেই সে বিল পেশ করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে যৌথ অধিবেশন ডাকানো যায়। এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, আজ পর্যন্ত মাত্র তিন বার সংসদের যৌথ অধিবেশনে বিল পাশ করানো হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আমলে পণপ্রথা নিবারণ আইন (১৯৬১), মোরারজি দেশাইয়ের সময় ব্যাঙ্কিং সার্ভিস কমিশন প্রত্যাহার আইন (১৯৭৮) এবং অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় সন্ত্রাস দমন আইন বা ‘পোটা’ (২০০২)।
১০ মার্চ জমি অধিগ্রহণ বিলটিতে ন’টি সংশোধনী যোগ করে লোকসভায় পাশ হয়। বিলটি কৃষকের স্বার্থবিরোধী— এই প্রবল অভিযোগের মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যেই সংশোধনীগুলি আনা হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল, রাজ্যসভার বৈতরণি এ ভাবে পার হওয়া সম্ভব নয়। এখন যদি মোদী এবং জেটলির বোধোদয় হয়ে থাকে, তা হলে তাঁরা হয় সংসদীয় কমিটির কাছে এই বিল বিবেচনার জন্য পাঠিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের সুপারিশ চাইবেন, নয়তো সমালোচকদের দাবি মেনে নিয়ে বিল সংশোধন করবেন। যে পথই তাঁরা নিন না কেন, সেটা হবে ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে বাস্তববোধের জয়।