আমাদের সমাজটা আরও বেশি কথোপকথনের সমাজ হয়ে উঠুক।
বছরের শেষে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হল। দিল্লির সিরিফোর্ট অডিটোরিয়ামে বাংলা ছবির উত্সবের শুরুতেই দেখলাম গৌতম ঘোষের তথ্যচিত্র বিসমিল্লা খান। ১৯৮৯ সালে নির্মিত ছবি। কিন্তু আমার আগে দেখা হয়নি। বিসমিল্লা খান বারাণসীর মানুষ। সকালে রোজ গঙ্গাস্নান করতেন। দিনে পাঁচ বার নমাজ পড়তেন। তার পর সন্ধ্যায় রোজ বালাজি মন্দিরের চাতালে তিন ঘণ্টা রেওয়াজ করতেন।
১৯৮৯ সালে ছবিটি যখন প্রদর্শিত হয় তখন রাজীব গাঁধী প্রধানমন্ত্রী। সে বছরেরই ডিসেম্বরে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ প্রধানমন্ত্রী হন। ছবিটি যখন মুক্তি পায় তখন গোটা দেশজুড়ে রাম মন্দির আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছে। আর তিন বছর পর, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। বিসমিল্লা ছবিতে সুর করে নমাজ শুনিয়ে বলছেন এ তো সঙ্গীত। আবার প্রতি অনুষ্ঠান শেষে তাঁকে বাজাতে হত রঘুপতি রাঘব রাজা রাম। কখনও তিনি দাঁড়িয়ে সানাই বাজাতেন না। শুধু মহরমের দিন বারাণসীতে মসজিদের সামনে তিনি দাঁড়িয়ে সানাই বাজাতেন। নেহরু এক বার প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। কুচকাওয়াজে অংশ নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে সানাই বাজান দেশের প্রজাতন্ত্র দিবসের জন্য। বিসমিল্লা বলেছেন, নমাজই বলো আর ভজন, সবই তো আসলে সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা এই সুরে বাঁধা।
অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি দেখতে দেখতে শুধু মনে হচ্ছে ২০১৮-কে স্বাগত জানানোর জন্য এর চেয়ে ভাল বার্তা আর কী হতে পারে? বারণসী আমার প্রিয় শহর। আমি তো সুযোগ পেলেই এ শহরে যাই। বারাণসী ভারতীয় সভ্যতার আদি শহর। শুধুমাত্র হিন্দু সভ্যতার প্রাচীন শহর বললে ভুল হবে। বিসমিল্লার জীবনকে কেন্দ্র করে গৌতম কিন্তু বারাণসীর মুসলিম সমাজ জীবনেরও সময়-স্মৃতি ও মায়াবাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। আবার সারনাথ তো এখানেই। ব্রিটিশ আমলের বিখ্যাত গির্জা তো গোদোলিয়াতেই। আবার জৈন ধর্মের তিন জন তীর্থঙ্করের জন্মস্থান এখানেই। ঠিক এই কারণেই হিন্দু জাতীয়তাবাদ শব্দটি নিয়ে সমস্যা হয়। নরেন্দ্র মোদীর মনে আছে কি না জানি না, অটলবিহারী বাজপেয়ী একদা বলেছিলেন শুধু এই কারণে হিন্দু জাতীয়তাবাদ শব্দটির চেয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ শব্দটিতে আমার স্বাচ্ছন্দ বেশি। কারণ হিন্দু শব্দটির ব্যবহারে দেশের অন্য সংখ্যালঘু ধর্মীয়গোষ্ঠীদের মধ্যে যদি মনস্তাত্ত্বিক বিচ্ছিন্নতা আসে তবে গায়ের জোরে ওই শব্দটির ব্যবহার করে লাভ কী?
আরও পড়ুন:
‘পপুলিজম’ ও হিন্দুত্বের মোকাবিলা করে নতুন মডেল তুলে ধরতে হবে রাহুলকে
বিসমিল্লা বলেছেন, নমাজই বলো আর ভজন, সবই তো আসলে সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা এই সুরে বাঁধা।
বর্ষশেষে তিন দিন ধরে বাংলা ছবির এহেন উত্সব অনেক দিন পর হল। প্রথমত, ছবি প্রদর্শনীর স্থান হিসাবে সিরি ফোর্ট অডিটোরিয়াম খুবই উপযুক্ত। কারণ বাজপেয়ী জমানাতেই যখন কিছু দিনের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র উত্সবের জন্য দিল্লিকেই স্থায়ী শহর করা হয় তখন এখানেই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব পালিত হত। কলকাতা থেকে নায়ক-নায়িকারা আসতেন। এই সিরি ফোর্টের সবুজ লনে খোলামেলা আড্ডা হত। এ বার পার্পল টাচ ক্রিয়েটিভ ও গ্রিন রুম থিয়েটার, এই দুই সংস্থার উদ্যোগে বাংলা ছবির এহেন প্রদর্শনী এই প্রথম। গৌতম ঘোষ এই মুহূর্তে বাংলার এক শক্তিশালী চলচ্চিত্র পরিচালক। তিনি এই তিন দিনের বাংলার ছায়াছবি উত্সবের উদ্বোধনই শুধু করলেন এমন নয়। সস্ত্রীক তিন দিন এই উত্সবে হাজির ছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী নীলাঞ্জনা নিজে গুণী মানুষ। তিনি আড্ডায় হাজির হন। মেঘনাদবধ রহস্য থেকে বারান্দা। অরণ্যদেব (ছবিটি এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে মুক্তি পায়নি), চিত্রকর, তানজিল, মেঘে ঢাকা তারা, মেঘনাদবধ রহস্য, ৬১ গরপার লেন প্রভৃতি নানা ছবির সমাবেশ। মহুয়া চক্রবর্তীর মতো নবীন পরিচালক ছিলেন, আবার গৌতম ঘোষের মতো প্রবীণ পরিচালকও। অঞ্জনা কাঞ্জিলাল এবং আশিস দাসের উত্সাহ ও পরিশ্রমে বর্ষশেষে এই বাংলা ছবির উত্সবে প্রেক্ষাগৃহ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।
গৌতম ঘোষকে প্রশ্ন করলাম, আজ গোটা দেশের যে রাজনৈতিক আবহ তাতে আপনার মনে হচ্ছে না যে বিসমিল্লার মতো ছবি আজ আরও প্রাসঙ্গিক? কোনও দলের কথা না বলেও গৌতমবাবু জানালেন, এহেন পরিস্থিতিতে বিসমিল্লার মতো মানুষের দৃষ্টান্ত আরও বেশি করে তুলে ধরা প্রয়োজন।
আসলে ২০১৮ সালের প্রত্যাশা, আমাদের সমাজটা আরও বেশি করে কথোপকথনের সমাজ হয়ে উঠুক। সেই কোন যুগে সক্রেটিস বলেছিলেন কথা হোক। আলোচনা হোক। আমরা বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে কথা তো বলেই চলেছি গত সত্তর বছর ধরে। অমর্ত্য সেন সেই argumentative Indian গ্রন্থে রাষ্ট্রপুঞ্জে কৃষ্ণ মেননের দীর্ঘ বক্তৃতার কথা বলেছিলেন। কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে সেই কথা বলার, তর্ক করার, আড্ডা মারার ভারতীয়ত্ব?