মধুচন্দ্রিমার দিন শেষ। মেহবুবা মুফতি ও অমিত শাহ। ফাইল চিত্র।
মেহবুবা মুফতি জানিয়ে দিয়েছেন, আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাঁর দল পিডিপি লড়বে না । মানে ভোট বয়কট করবে| নবনিযুক্ত রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক প্রথা ভেঙে মেহবুবার কাছে পৌঁছে গেলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। বার বার অনুরোধ করলেন। কিন্তু মেহবুবা বিনীত ভাবে জানালেন, না! মেহবুবার এই ঘোষণার এক দিন আগে ফারুক আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্স ঘোষণা করে, তারাও পঞ্চায়েত নির্বাচন বয়কট করবে। বস্তুত, কাশ্মীরের এই মূল দু’টি রাজনৈতিক দলই এখন প্রতিগ্বন্গ্বিতায় নেমেছে, কে কত বেশি দিল্লি-বিরোধী।
কাশ্মীর রাজ্যপাল এত দিন পরিবর্তন হয়নি। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব এন এন ভোরার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে, এ বার পরিবর্তন করতে হবে বলতে বলতে পাঁচ বছর হয়ে গেল। এ বার লোকসভা নির্বাচন যখন দরজায় কড়া নাড়ছে তখন নতুন রাজ্যপালকে পাঠানো হল। পাঠানো হল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে। সেনা বা পুলিশের লোক নয়|
ষাটের দশকে শেষ রাজনৈতিক রাজ্যপাল নিয়োগ করা হয়। তার পর আর কেউ রাজনৈতিক রাজ্যপাল ছিলেন না। এ বার সৎপাল নিজে গিয়ে মেহবুবাকে অনুরোধ করলেন সেটা ভাল। জানি না, শেষমেশ মেহবুবা মন বদলে ভোটে সামিল হবেন কি না। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি তাতে মেহবুবার ভোট বয়কট দেখে আমার কাশ্মীর নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে!
মেহবুবা যে ভোট বয়কট করছেন আমি তা সমর্থন করছি না। সংসদীয় প্রক্রিয়াকে কাশ্মীরে শক্তিশালী করলে লাভ ভারতীয় গণতন্ত্রের। কাশ্মীরে প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল হল ফারুক আবদুল্লা ও ওমর ফারুকের ন্যাশনাল কনফারেন্স, আর একটি হল মুফতি মহম্মদ সইদের তৈরি, এখন তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা মেহবুবা মুফতির পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। হুরিয়ত চিরকাল ভোটের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে। সে বয়কটেরও অনেক আর্থ-রাজনৈতিক কারণ আছে। কাশ্মীরি মানুষের বিচ্ছিন্নতার সঙ্গেও হুরিয়ত রাজনীতির সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ।
প্রতিবাদী। ছবি এপি।
আবার মেহবুবা কেন এমন এক পরিস্থিতির শিকার হলেন সেটাও তো বুঝতে হবে! বিজেপি মেহবুবার সঙ্গে সমঝোতা করে একটা পরীক্ষার কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু সে পরীক্ষাটি ব্যর্থ হল। আমার মত হল, এই জোট নিয়ে বিজেপি ঠিকমতো কাজ করেনি। যাকে বলে ‘মিসহ্যান্ডল’, সেটাই করল বিজেপি। এক দিকে মেহবুবার সঙ্গে জোট, অন্য দিকে আরএসএস-সঙ্ঘ পরিবারকে দিয়ে জম্মুতে হিন্দু ভোটকে আরও জঙ্গি, আরও সুসংহত করে তোলা! একটা সময় তো পিডিপি ভেঙে বিজেপির সরকার গড়ার চেষ্টা হয়েছিল!
মাঝখান থেকে মেহবুবা বিপদে পড়ে গেলেন। মেহবুবা জনসমর্থন হারাতে লাগলেন। দেখুন, হুরিয়ত নেতাদেরও আস্থা ছিল মেহবুবার প্রতি। এটা ঠিক, জোট রাখায় ৩৭০ ধারা খতম করতে মোদী সরকার সক্রিয় হয়নি। কিন্তু আরএসএস এবং বিজেপি নেতারা উঠতে বসতে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তির দাবিতে বিবৃতি দিয়েই গিয়েছেন|
তা হলে বিগত পাঁচ বছরে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে মোদী সরকার কী করল?
মেহবুবা বিজেপির সঙ্গে থাকার ফলে রাজ্যেই তাঁর জনসমর্থনে যে অবক্ষয়, সেটা পুনরুদ্ধার করতে মেহবুবা এখন ক্রমশ আরও জঙ্গি হয়ে উঠছেন। এখন বলতে পারেন, মেহবুবা দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করছেন। কিন্তু কেন তিনি এটা করছেন এটা আমরা ভাববো না?
আমি এক বার হুরিয়ত নেতা গিলানির সাক্ষাৎকার নিতে শ্রীনগর গিয়েছিলাম। মনে আছে, প্রবীণ এই নেতা আগাম বলেছিলেন, ‘‘মেহবুবা-বিজেপি সমঝোতা টিকতে পারে না। উল্টে মেহবুবার জন্য কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আন্দোলন দুর্বল হয়ে যাবে। রাজনৈতিক আপস কাশ্মীরিরা পছন্দ করবে কী করে? এটা অনেকটা তোমাদের রাজ্যে সিপিএমের মতো। সিপিএম ক্ষমতায় থেকে আসলে রাজ্যে বাম আন্দোলনকেই দুর্বল করে দিয়েছে|’’
কাশ্মীর নীতি কী নেবে তাতে প্রথম থেকেই মোদী সরকারের ধারাবাহিকতার অভাব ছিল। এর সঙ্গে পাকিস্তান সমস্যা তো আছেই। ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করব’ নীতি দিয়ে ভাবা হয়েছিল সমস্যা সমাধান হবে । হল কী?
এখন আবার সরকার আলাপ-আলোচনা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কথা বলছে। এখন ভোট আসছে! সমাধান খোঁজার সময় ও ইচ্ছা কই?
সম্রাট আকবর যখন কাশ্মীরে যান তখন তাঁকে পড়তে দেওয়া হয় কালহান-এর ‘রাজতরঙ্গিনী’। ফারসি ভাষায় অনুবাদ। সেটা পড়ে তিনি মুগ্ধ হন। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর আইন-ই-আকবরিতে রাজতরঙ্গিনী-কে যুক্ত করেন। তিনি মানুষকে বলেছিলেন, কাশ্মীরের আত্মাটা বুঝে নিতে হবে!
আজকের প্রভুরা যা ভাবেন তাই করেন! বুঝতে চেষ্টা করেন না!