নোটবন্দি’ থেকে ‘ঘরবন্দি’— সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। দাবাং সরকারের কাজের ধরনটাই হল, একটা অতিনাটকীয় ঘোষণা করে দাও, দেশের মানুষ ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ুক, তার পর না হয় ধীরে ধীরে পরের পদক্ষেপগুলো ভাবা যাবে। তাতে কিছু মানুষ বেঘোরে মারা পড়বে হয়তো, সেটুকু তো হতেই পারে। কিন্তু ঘোষণার আগে মানুষের বিপদ কমাবার কিছু পরিকল্পনা করতে গেলে জানাজানি হয়ে যাবে, তখন তো ধামাকাটাই মাটি।
নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে তিন ঘন্টার নোটিসে যে দেশব্যাপী লকডাউন হয়ে গেল, তাতে দেশ জুড়ে ঘরছাড়া শ্রমিকদের যে ট্র্যাজেডি চলছে তা ভয়াবহ। অন্তত কোটিখানেক মানুষ রাস্তায়, তাঁদের মাথার ওপর ছাদ নেই, কাজ নেই, খাবার নেই, খাবার কেনার পয়সাও নেই। যদি তাঁরা কাজের জায়গায় কোনও মতে থেকে গিয়ে থাকেন, একটা ঘরে কুড়ি-তিরিশ জন মাথা গুঁজে বসে আছেন। আর না হলে লাখে লাখে মানুষ হাঁটছেন নিজেদের বাড়ির দিকে— কেউ একশো কিলোমিটার, কেউ পাঁচশো কিলোমিটার; কেউ একা, কেউ তাঁর ছোট সন্তানকে কাঁধে নিয়ে। রাস্তায় খাবার নেই, জল নেই, প্রাপ্তি বলতে পুলিশের লাঠি। কখনও রাস্তায় মালবাহী গাড়ি থামালে ত্রিপল সরিয়ে দেখা যাচ্ছে আনাজপাতির মতো স্তূপ হয়ে আছে ঘরমুখী অসহায় শ্রমিক।
দেশের ঠিকা শ্রমিক ও অল্পদক্ষ কর্মীদের ছবিটা দেখলে বোঝা যায়, পূর্ব-উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমের একটা স্পষ্ট ভেদরেখা আছে। বিহার, ওড়িশা, বাংলা, ঝাড়খন্ড, উত্তরপ্রদেশ— এই পাঁচটা রাজ্য থেকেই কাজের সন্ধানে দল বেঁধে মানুষ যায় কেরল, তামিলনাডু, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, গুজরাত। এক দিকে কয়েকটি জনবহুল রাজ্য, যেখানে জনসংখ্যার গড় বয়স কম, বিভিন্ন কারণে শিল্পের সীমাবদ্ধতা। অন্য দিকের রাজ্যগুলোতে শিল্পের প্রসার বেশি, কিন্তু গড় বয়স বেশি, ফলে স্থানীয় শ্রমিকের অপ্রতুলতা আছে। তাই এই পরিযায়ী শ্রমিকের একটা ছন্দ তৈরি হয়েছে— এর সংখ্যাটা আড়াই থেকে তিন কোটি। সেই ছন্দে মাঝে মাঝে ব্যাঘাত আসে, যখন কোথাও কোথাও প্রাদেশিকতার ভাইরাস মাথা চাড়া দেয়। নোটবন্দির সময়েও আঘাত এসেছে বিরাট। কিন্তু এই সব সময়েই মানুষ ঘরে ফেরার সময় পেয়েছে— তিন ঘণ্টার নোটিসে এ ভাবে বজ্রাঘাত হয়নি। তাই এখন এক নজিরবিহীন সঙ্কটের মুখোমুখি দেশ।
এখন প্রশ্ন হল, দেশের এই অতি প্রয়োজনীয় লকডাউনের মধ্যেও এই লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিপর্যয় থেকে বাঁচাবার কোনও দায়িত্ব কি দেশের সরকারের নেই? এঁরা সকলেই অসংগঠিত, তাই চট করে আর্থিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়া কঠিন। কিন্তু তিন সপ্তাহের জন্য রিলিফ ক্যাম্প বা খাবারের ব্যবস্থা করা কি নেহাত অসম্ভব? ভূমিকম্প বা ঘুর্ণিঝড়ে সেনা বা আধা-সামরিক বাহিনী নামে মানুষকে ত্রাণ দিতে, এখন সেই উদ্যোগ নেই কেন? তাঁদের দুটো দিন সময় দিলে, বা আপৎকালীন ভিত্তিতে ট্রেন চালিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরিয়ে দিলে এখন তাঁরা যে ভাবে আছেন বা পাগলের মতো ঘরে ফিরতে চাইছেন, তার তুলনায় সংক্রমণের সম্ভাবনা কি বেশি হত? এটা কি পরিকল্পনার অভাব, না সংবেদনশীলতার?
পুরো দায়িত্বটা এসে পড়েছে রাজ্য সরকারগুলোর ওপর, কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও আর্থিক সাহায্য ছাড়াই। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কয়েক লক্ষ মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন, আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ গেছে অন্যান্য রাজ্যে, শোনা গেছে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্যোগ নিয়েছেন আটকে যাওয়া কিছু বাঙালি শ্রমিকের জন্য। কেরলের উদ্যোগ তো চলছেই। এ ছাড়া মানুষ নিজেদের উদ্যোগে আশেপাশের লোককে যেটুকু পারেন সাহায্য করছেন। আরও একটা ট্র্যাজেডির জায়গা হল লক্ষ লক্ষ প্রবীণ নাগরিক, যাঁরা তিন ঘন্টার নোটিসে অকূল পাথারে পড়ে গেলেন— সহায়তা ছাড়া তাঁদের একুশ দিন কাটবে কী করে?
কেন্দ্রের কী উদ্যোগ চোখে পড়ল? শুরু হয়েছে জনতা কার্ফু দিয়ে, তার পর দেশব্যাপী থালাবাসন বাজিয়ে করোনা সঙ্কীর্তন (যদিও তার পরেই স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি থেকে বার করে দেওয়ার হিড়িক উঠেছে দেশের নানা অঞ্চলে)। তার পরে আচমকা সেই ২১ দিনের লকডাউনের ঘোষণা, কোনও আর্থিক সুরাহার আশ্বাস ছাড়াই, ফলে দেশ জুড়ে আতঙ্ক আর খাবারের জন্য হাহাকার। তার দু’দিন পর অর্থমন্ত্রীর প্যাকেজ ঘোষণা। আর দিশাহারা এই শ্রমিকদের হাহাকারের খবরের মাঝে জানা গেল, দেশবাসীর কষ্ট লাঘবের জন্য রামায়ণের পুনঃসম্প্রচার চালু হচ্ছে টেলিভিশনে।
অর্থমন্ত্রীর ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিমা, উজালা পরিবারের জন্য তিন মাস বিনামূল্যে গ্যাস আর রেশনে বরাদ্দ বাড়ানোর মত ভাল উদ্যোগ আছে, কিন্তু কিছু কারসাজিও চোখে পড়ছে। ৯ কোটি কৃষকের জন্য মাথাপিছু যে ২০০০ টাকা, তা ভোটের আগেই ঘোষিত ছিল, নতুন কিছু নয়। নির্মাণ-শ্রমিক তহবিল থেকে ৩১০০০ কোটি টাকা— কিন্তু এ তো নির্মাণ সংস্থার দেওয়া সেস থেকে তৈরি তহবিল, সে টাকা এর জন্যই বরাদ্দ। নারেগা-তে বলা হচ্ছে দৈনিক মজুরি ১৮২ থেকে বেড়ে ২০২ টাকা হল, তাই অনেক মানুষ বছরে একশো দিন খেটে দু’হাজার টাকা বেশি পাবেন— যদিও জঁ দ্রেজ় লিখেছেন যে দেশের গড় মজুরি এখনই ২০২ টাকার বেশি, আর গড়ে দেশে মাথাপিছু ৫০টি শ্রমদিবসও তৈরি হয় না। তাই মোট প্যাকেজের বেশ কিছুটা মায়াঅঞ্জন। তার পর অবশ্যই এসেছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ— শিল্পক্ষেত্র আর চাকুরিজীবী মানুষের সুরাহার জন্য। কিন্তু আমাদের অসংগঠিত অর্থনীতির যাঁরা চালিকাশক্তি, সেই শ্রমিকদের ধ্বংসের গ্রাস থেকে বাঁচাবার জন্য কোনও বরাদ্দ বা চিন্তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য দেশেও এই সমস্যা আছে, কিন্তু আমাদের দেশে মাত্র ২০ শতাংশ শ্রমিকের চাকরি আছে, বাকি সবাই ঠিকা শ্রমিক। সে তুলনায় ইউরোপ বা আমেরিকায় ৬০ থেকে ৭৫ শতাংশ চাকুরিজীবী। তাই আমাদের দেশে সমস্যার তীব্রতা অন্য রকম, তাই সরকার ততটাই গুরুত্ব দেবে, সেটা প্রত্যাশিত ছিল।
উচ্চবিত্তের থেকে ছড়ানো এই সংক্রমণের ভয় যে ভাবে কয়েক কোটি প্রান্তিক মানুষকে দিশেহারা করে দিয়েছে, তার অভিঘাত কিন্তু গভীর। করোনা-উত্তর ভারতে সঙ্কটের মুখ হবে দুটো। এক দিকে শিল্প, যেখানে শ্রমিকের অভাব তীব্র হতে পারে, কারণ এই আতঙ্কের অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ ঘর ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে না চাইতেই পারেন। সরকারের ‘স্কিল ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়তে পারে, কারণ গ্রামের মানুষ তালিম নিলেও অন্য কোথাও কাজ করতে যেতে চাইবেন না। অন্য সঙ্কট আসতে পারে কৃষিক্ষেত্রে। দেশের মোট আর্থিক সম্পদ সৃষ্টির ১৮ শতাংশ আসে কৃষি থেকে, কিন্তু তার থেকেই জীবন নির্বাহ করেন ৫৫ শতাংশ মানুষ। তাই কৃষির উপর চাপ কমাতে ধীরে ধীরে কিছু মানুষের জীবিকা কৃষি থেকে শিল্পে সরানোটা অতি প্রয়োজন। কিন্তু এই সঙ্কটে দেশ যে ভাবে তাঁদের এক রাতের মধ্যে অনাথ করে দিয়েছে, তাতে তাঁরা এ বার হয়তো চেষ্টা করবেন গ্রামেই থেকে গিয়ে কৃষিক্ষেত্রে ফিরে যেতে— তার অনিবার্য ফল হল, কৃষি আরও অলাভজনক হয়ে পড়বে।
কিন্তু তার চেয়েও দুঃখের হল, একটা দীর্ঘ সবেতন ছুটির মেজাজে থাকা উচ্চবিত্ত মানুষ সন্ধ্যায় পানপাত্রে চুমুক দিয়ে রাস্তায় নেমে যাওয়া এই লক্ষ শ্রমিকের হাহাকারকেও ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’ ছাড়া কিছু ভাবতে পারছেন না। সম্ভবত, ভাবতে পারবেনও না।