নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
নরেন্দ্র মোদী সপ্তম বারের জন্য স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দিতেছেন। তাঁহার আগে অনেক প্রধানমন্ত্রীই একাধিক বার এই ভাষণ দিয়াছেন, আশা করা যায় ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রীরাও দিবেন। তবে কিনা, আজও এই দিনটিতে কেবল ভারতে নহে, বিশ্বের অন্যত্রও ইতিহাসমনস্ক অনেক মানুষই ৭৩ বছর আগে জওহরলাল নেহরুর সেই মধ্যরাত্রের ভাষণটিকে বিশেষ ভাবে স্মরণ করেন। মোদী সম্ভবত সেই দলে পড়েন না। কিন্তু ১৫ অগস্টের রকমারি আচার-অনুষ্ঠানের অবকাশে ‘নিয়তির সহিত অভিসার’ নামক ভাষণটি এক বার পাঠ করিলে তিনি দেখিবেন— তাঁহার সেই আদি পূর্বসূরি কতটা গভীর ভাবে ভাবিতে জানিতেন। সেই বক্তৃতার এক বিশেষ অংশ মোদীর ভারতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। পণ্ডিত নেহরু সেখানে বলিতেছেন, ‘স্বাধীনতা এবং ক্ষমতা দায়িত্ব অর্পণ করে।’ এবং, ‘সেই দায়িত্ব এই সভার উপর বর্তাইয়াছে, যে সভা সার্বভৌম, (কারণ) তাহা সার্বভৌম জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করিতেছে।’ নেহরু অবশ্যই এই বিষয়ে সচেতন যে, স্বাধীন দেশের নির্বাচন তখন ভবিষ্যতের গর্ভে, জনপ্রতিনিধিত্বের মাপকাঠিতে গণপরিষদের ভূমিকা সীমিত ও সাময়িক। কিন্তু তিনি ওই উক্তিতে নির্বাচনসর্বস্বতাকে অতিক্রম করিয়া একটি দর্শনের অবতারণা করিয়াছেন। সার্বভৌমত্বের ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠা করিতে চাহিয়াছেন গণতন্ত্রের মর্মস্থলে— জাতিরাষ্ট্রের পরিচালনায় নাগরিকদের যে ‘এজেন্সি’ অর্থাৎ সক্রিয় ভূমিকা প্রকৃত গণতন্ত্রের ধর্ম, ‘সার্বভৌম জনসাধারণ’ শব্দবন্ধে তাহারই স্বীকৃতি। এই দর্শনটিই আজ বিশেষ ভাবে স্মরণীয়।
তাহার কারণ, ভারতরাষ্ট্রের যন্ত্রীরা সার্বভৌমত্বকে আজ আর জনসাধারণের সক্রিয় ভূমিকার নিরিখে দেখেন না, তাঁহাদের নিকট সার্বভৌমত্বের ধারণাটি রাষ্ট্রক্ষমতার নিরিখেই বুঝিবার এবং মাপিবার। সেই হিসাবে রাষ্ট্রশক্তি তখনই সার্বভৌম, যখন তাহার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ। এক অর্থে এই ক্ষমতাতন্ত্র বিশ্ব জুড়িয়াই সার্বভৌমত্বের প্রধান নির্ণায়ক। কিন্তু তাহার প্রাসঙ্গিকতা এক রাষ্ট্রের সহিত রাষ্ট্রের সম্পর্কের পরিসরে, সেখানে জাতিরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সমার্থক হইয়া দাঁড়ায়। প্রচলিত অর্থের এই সার্বভৌমত্ব অবশ্যই মূল্যবান। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণের অধিকার না থাকিলে স্বাধীনতা অর্থহীন। এ-কথাও মনে রাখা দরকার যে, আন্তর্জাতিক ক্ষমতা-কাঠামোয় সব দেশের স্বাধীনতার মাত্রা এক নহে, এক দিকে দুর্বল রাষ্ট্রের উপর প্রবল রাষ্ট্রের আধিপত্য, অন্য দিকে সাধারণ ভাবে জাতি-রাষ্ট্রের উপর বিশ্ব বাজারের, বিশেষত লগ্নি-পুঁজির বিশ্বায়িত কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞাকে অনেকখানি খর্ব করিয়াছে। নরেন্দ্র মোদীও সেই সমস্যা এড়াইতে পারেন নাই। তাঁহার সরকার আপন শক্তির যত আস্ফালনই করিয়া চলুক, বিশ্ব বাজার এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির চাপে তাহাকে, পূর্বসূরিদের মতোই, পদে পদে নানা আপস করিতে হইতেছে— কি রাষ্ট্রীয় সীমান্তে, কি আর্থিক নীতিতে।
কিন্তু বর্তমান জমানায় দেশে রাষ্ট্রশক্তির নিরঙ্কুশ আধিপত্যের তাড়না এক অস্বাভাবিক মাত্রায় পৌঁছাইয়াছে। জনসাধারণের স্বাধীনতা ভয়ানক ভাবে খর্বিত। রাষ্ট্রযন্ত্রকে নাগরিকের ‘এজেন্সি’ হরণ করিবার এমন সর্বব্যাপী আয়োজনে ব্যবহার করিবার নিদর্শন স্বাধীন ভারত দেখে নাই বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। জরুরি অবস্থার তমসাপর্বে নেহরু-কন্যার নেতৃত্বে নাগরিকের অধিকার নিশ্চয়ই অপহৃত হইয়াছিল, কিন্তু তাহা ছিল গণতন্ত্রের ঘোষিত বাতিল-পর্ব। গত কয়েক বছরে ‘স্বাভাবিক’ অবস্থাই অনেক দিক দিয়া জরুরি অবস্থার চরিত্র ধারণ করিয়াছে, এবং বলি হইয়াছে জনসাধারণের সার্বভৌমত্ব। প্রতিবাদ বা প্রতিস্পর্ধা তো অনেক পরের কথা, রাষ্ট্রশক্তির অন্যায় লইয়া প্রশ্ন তুলিলেও নাগরিককে রাজরোষে পড়িতে হইতেছে। নরেন্দ্র মোদীর ভারতে স্বাধীনতার অর্থ কি তবে অনুগত এবং ভক্ত প্রজার স্বাধীনতা?