—ফাইল চিত্র।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্নটা তুলেছেন গবাদি পশুর নিধন সংক্রান্ত বিতর্কের প্রেক্ষিতে। কিন্তু প্রশ্নটা আসলে একটা মূলগত সাংবিধানিক প্রশ্ন। ভারতের সংবিধান যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে, সে কাঠামো কি আদৌ অক্ষুণ্ণ থাকছে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা প্রশ্নটা অনেকটা এই রকমই।
এই প্রশ্ন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম বার তুললেন, এমন নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের নানা টানাপড়েনের প্রেক্ষিতে এ প্রশ্ন আগেও একাধিক বার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তুলেছেন। শুধু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নন, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে এই প্রশ্ন তুলতে দেখা গিয়েছে। কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলই কোনও এক রাজ্যে ক্ষমতায়, সেই রাজ্যেরই মুখ্যমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাতের অভিযোগ তুলেছেন— এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি, বহু আচার, বহু বিশ্বাস এবং বিবিধ সামাজিক প্রবাহের একটি দেশের জন্য দূরদর্শী সংবিধান প্রণেতারা যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে দিয়েছেন, সেই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত্তিমূলে যখনই আঘাত আসার উপক্রম হয়, এই অভিযোগগুলো কিন্তু তখনই ওঠে।
ভারত কোনও একমাত্রিক দেশ নয়। ভারত অত্যন্ত বর্ণময় একটি অস্তিত্ব। যে পরিমাণ বিভিন্নতা ভারতীয় জনগোষ্ঠীর সহজাত এবং স্থায়ী অংশীদার, এ বিশ্বের অন্য কোনও রাষ্ট্র সেই পরিমাণ বৈচিত্রকে অঙ্গীভূত করে জন্ম নেয়নি। এ দেশের প্রতিটি প্রান্তের মানুষ সব সময় একই ভাবনায় চালিত হন বা একই ভাবাবেগে উদ্বেল হন, এমন ধারণা সর্বৈব ভুল। বিভিন্ন রাজ্যে জনাদেশের বিভিন্ন ধাঁচ থেকেই তা স্পষ্ট হয়। কেন্দ্রে যে দল ক্ষমতায়, প্রতিটি রাজ্য যে সে দলের পক্ষেই মত দেয়, তা একেবারেই নয়। কোনও কোনও রাজ্যে জাতীয় রাজনীতির বৃহত্তম দলগুলো দশকের পর দশক ধরে শাসন ক্ষমতা থেকে বহু দূরে থাকে। সে সব রাজ্যে আঞ্চলিক দল বা রাজ্যদলেই ভরসা রাখেন মানুষ। ভারতীয় জনগোষ্ঠীর এই বিভিন্নতা বা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের ভাবাবেগের এই বিবিধতাকে যাঁরা সম্যক চেনেন, তাঁরা জানেন যে একবগ্গা কোনও জীবনচর্যা ভারতের উপর চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ভারতীয় জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবন বা ব্যবহারিক জীবনের ছাঁচটাকে একমাত্রিক বা সরলরৈখিক করে তোলা কিছুতেই সম্ভব নয়। নাগরিক কোন ভাষায় কথা বলবেন, কোন ধরনের খাদ্যাভাসে অভ্যস্ত হবেন, কোন পোশাকে রুচি বোধ করবেন, তা স্থির করা রাষ্ট্রের কাজও নয়।
গোমাংস ভারতবাসী খাবেন কি না, তা নিয়ে বিতর্ক এখন বিস্তর। আদালত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে লড়াই। কেন্দ্রীয় সরকারের গোমাংস সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞায় বিচারবিভাগীয় স্থগিতাদেশ জারি হয়েছে। গোমাংসের ভবিষ্যত্ কী, লালবাতির-ই বা কী হবে এ দেশে, সে সব উত্তর সময় দেবে। আদালতেই এ সব বিতর্কের নিষ্পত্তি হবে সম্ভবত। কিন্তু এই সব ইস্যু নিমিত্ত মাত্র। আসল ইস্যু হল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। আঘাতটা সত্যিই সেই কাঠামোর ভিতে গিয়ে লাগছে না তো? ভেবে দেখা দরকার অবিলম্বে।