তফসিলি জাতি ও জনজাতি সম্পর্কিত একটি আইন লইয়া সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়টি কিন্তু একেবারেই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নহে। জাতিগত বৈষম্য বা নির্যাতন আটকাইবার জন্য আইনটি তৈরি হইয়াছিল ১৯৮৯ সালে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর উৎসাহে। আইনটির উদ্দেশ্য ছিল, সামাজিক বৈষম্য কমানো। গত তিন দশকে, আরও অনেক আইনের মতোই, এই আইনেরও অনেক অপব্যবহার ঘটিয়াছে, এবং সেই অপব্যবহারের সুযোগে আইনটির একটি উচ্চবর্ণীয় বিরোধিতা তৈরি হইয়াছে। বলা হইতেছে, এই আইন এখন নিম্নবর্ণের হাতেই একটি জাতভিত্তিক অস্ত্র বা উচ্চবর্ণকে ‘মজা বুঝাইবার’ প্রকরণ মাত্র। এমন অভিযোগের ভিত্তিতেই সুপ্রিম কোর্টের নিদান, অপব্যবহার আটকানো ও ব্যক্তি অধিকার বিনাশ আটকানোর জন্য আইনটির মধ্যে অতঃপর এমন রক্ষাকবচ রাখিতে হইবে, যাহাতে শাস্তিদানের পথ সহজ না হয়। সুতরাং সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত, সরকারি কর্মী অভিযুক্ত হইলে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গ্রেফতার করা যাইবে না, এবং গ্রেফতারের অন্তত সাত দিন আগে পুলিশি তদন্ত হইতে হইবে। সংগত ভাবেই, রায়টির বিরুদ্ধে এখন তীব্র সমালোচনা: আইনের মধ্যে এই ধরনের ‘রক্ষাকবচ’ আমদানি করিলে আইনটিই অর্থহীন হইয়া পড়ে, নিম্নবর্ণের মানুষের পক্ষে সামাজিক প্রতিরোধ এড়াইয়া কোনও অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না। কর্তৃপক্ষের অনুমতি কিংবা সাত দিন সময়, ইত্যাদির সুযোগে উচ্চবর্ণ-নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ‘অপরাধ’ ঢাকিবার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা হইবে, এবং সামাজিক ক্ষমতাহীন গোষ্ঠীর পক্ষে সুবিচারের আশা দূর হইতে দূরতর হইবে— ভয় ইহাই।
প্রসঙ্গত, ভারতীয় সমাজে বহু জরুরি আইনেরই অপব্যবহার ঘটিয়া থাকে। বিশেষত দুর্বল শ্রেণি বা গোষ্ঠীর সুরক্ষার আইনের ক্ষেত্রে এমন কাণ্ড হামেশাই দেখা যায়, যেমন শিশুনির্যাতনবিরোধী ‘পকসো’, বা দণ্ডবিধির বধূনির্যাতনবিরোধী ৪৯৮-এ ধারা। কিন্তু সমস্যার নিরাময়ার্থে যদি আইনটিকেই বানচাল করিবার ব্যবস্থা হয়, তাহা দুর্ভাগ্যের কথা। বরং আইনের অপব্যবহার কী ভাবে আটকানো যায়, সে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা প্রাথমিক সূত্রটি ঠিকই দিয়াছিলেন, নিরপরাধ ব্যক্তি উচ্চবর্ণ হইলেও তাঁহার অধিকারের দলনের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হইবে। কিন্তু ইহাও কি মানিতে হইবে না যে, প্রতিকারের সময় দুই তরফের অধিকারের কথাই মাথায় রাখা উচিত? বিশেষত যে সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্য স্পষ্টতই এক দিকে হেলিয়া আছে, সেখানে বিচার বিশেষ ভাবে সংবেদনশীল হওয়া দরকার? হয়তো একটি সাধারণ রক্ষাকবচের বদলে ক্ষেত্রভিত্তিক অধিকারসুরক্ষার ব্যবস্থাই অধিক কার্যকর হইত। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী তাঁহার সমালোচনায় এই কথাটির উপরেই জোর দিয়াছেন।
রাহুল গাঁধীরা এখন সরকারি অবস্থানের বিরুদ্ধেই আক্রমণ শানাইতেছেন, যেহেতু মামলাটি আদালতে আসিয়াছে সরকারি কর্মীর তরফে। এই আইনের পরিবর্তন নিম্নবর্ণের স্বার্থবিরোধী, এই মর্মে শুরু হইয়াছে জোরদার সরকারবিরোধী প্রচার। যেহেতু রাজীব গাঁধী স্বয়ং আইনটির কর্ণধার ছিলেন, কংগ্রেসের পক্ষে দলিত-আদিবাসী স্বার্থসুরক্ষার কথা বলিয়া রাজনৈতিক পয়েন্ট তোলা সহজ হইয়া গিয়াছে। এবং বিপরীতে, বিজেপি পড়িয়াছে মোক্ষম প্যাঁচে। এক দিকে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানাইয়া আইন সংশোধন করিলে দলিত ভোট আরও হাতছাড়া হইবার সম্ভাবনা। অন্য দিকে আইন পরিবর্তন না করিলে উচ্চবর্ণ হিন্দুদের ক্রোধের লক্ষ্য হইবার ভয়। এক ও একক হিন্দু ভারত গড়িবার পথে যে দলিত কাঁটাটিই কঠিনতম প্রতিরোধ, আবারও বিজেপি টের পাইতেছে।