আজ হোক বা কাল, ধীরে ধীরে আমাদের সব স্কুল খুলবে, খুলবেই। সংক্রমণের ভয় এবং আগেকার প্রাত্যহিক রুটিনে ফেরা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা থাকলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং পরিবারবর্গ মিলে তাঁদের গ্রাম বা গোষ্ঠীর স্কুলগুলিকে কী ভাবে সুষ্ঠু এবং নিরাপদ উপায়ে প্রাত্যহিক ছন্দে ফেরানো যায়, সেই ব্যবস্থা অবশ্যই করবেন। সরকারের নির্দেশাবলি কার্যকর হলেও কী ভাবে একের পর এক পদক্ষেপ করা যায়, সে ব্যাপারে স্থানীয় লোকেদের উপর নির্ভর করাই সমীচীন, কারণ স্থানীয় সমস্যাগুলি সম্পর্কে তাঁরাই বেশি অবহিত। এই পর্যায় অনেকটাই নির্ভর করবে স্থানীয় লোকজনের পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের উপর। অর্থাৎ, তাঁরাই যে তাঁদের ছেলেমেয়েদের ভালমন্দ বিচার করার পক্ষে শ্রেষ্ঠ, এই বোধ থাকা দরকার।
সামগ্রিক ভাবে স্কুলে ফেরার উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট। সকলেই চায় পুরো ঘটনাটা যেন হয় সম্পূর্ণ ভাবে নিরাপদ। স্কুল পুরো চালু হয়ে গেলে আমাদের জীবনে যে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে, সেটা আর কোনও ভাবে সম্ভব নয়। এই স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার সুযোগ হল স্কুল খোলার প্রক্রিয়া শুরু করা ধীরে ধীরে। সরকারি স্কুলগুলি প্রায়শই কেন্দ্রীভূত বা ‘সেন্ট্রালাইজ়ড’ পদ্ধতিতে কাজ করে। প্রাইভেট স্কুলগুলির পদ্ধতি অন্য রকম। দুই ক্ষেত্রেই স্থানীয় পর্যায়ে দায়িত্বপূর্ণ এবং সমবেত সিদ্ধান্ত নেওয়ার গুরুত্ব খুবই বড় হয়ে দেখা দেবে। যদি ছাত্রছাত্রী, তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকশিক্ষিকারা নিরাপদ বোধ না করেন, তা হলে কেউই স্কুলে আসবে না। স্কুলগুলির নিরাপত্তা রক্ষার জন্য গ্রাম পঞ্চায়েত বা মিউনিসিপ্যালিটি— সব রকম স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। সচরাচর যাঁরা পঠনপাঠন প্রক্রিয়ার বাইরে থাকেন, যেমন অভিভাবকরা, তাঁদের মতামতও নিতে হবে। ঠিক ভাবে করা হলে স্কুল খোলার ফলে গোষ্ঠী, সমাজ বা পাড়ার সকলে কাছাকাছি আসবেন। আর যদি যথেচ্ছ ভাবে তা করা হয়, তবে মানুষ হতাশ হবেন। তাঁদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি হবে এবং তাঁরা অসহায় হয়ে পড়বেন।
ধীরে ধীরে স্কুল খোলার প্রক্রিয়ার আরও একটা সুবিধা আছে। স্বাভাবিক সময়ে সব স্কুল একই সঙ্গে খোলে। যেমন পুজোর ছুটি বা গরমের ছুটির পর যে দিন স্কুল খোলে, সে দিন রাজ্য জুড়ে সমস্ত ছেলেমেয়ে তাদের স্কুলের পোশাক পরে স্কুল ব্যাগ নিয়ে স্কুলে রওনা দেয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা না করে যদি ধাপে ধাপে করা যায়, যাকে বলা যেতে পারে প্রস্তুতি পর্ব, সেটা এক মাস বা তার বেশি পর্যন্ত টানা যেতে পারে, যখন ছেলেমেয়েরা এবং বাড়ির লোকেরা প্রস্তুত হওয়ার সময় পাবেন, যাকে বলা যেতে পারে ওয়ার্ম-আপ পিরিয়ড।
স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতির এই প্রক্রিয়া এই রকম ভাবে প্ল্যান করা যেতে পারে— যাতে এত দিন পরে শিক্ষকরা প্রত্যেকটি ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে আবার যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন। যদি সকলে একই সঙ্গে না এসে ছাত্রছাত্রীরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আসে, ক্লাস অনুযায়ী অথবা একই ক্লাসের মধ্যে ভাগ ভাগ করে, তা হলে যে কোনও সময়ে স্কুলে উপস্থিত ছাত্রছাত্রী-সংখ্যা হবে কম। অর্থাৎ, শিক্ষকরা তাদের প্রতি ব্যক্তিগত ভাবে মনোনিবেশ করার সুযোগ পাবেন। এই পরিস্থিতিতে পড়াশোনায় কতটা ক্ষতি হয়েছে, তার মতোই জরুরি এই বিষয়টি জানা যে, এই সময়ে সে কেমন ছিল এবং তার বাড়ির লোকরা এই পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা কী ভাবে করেছেন।
বেশ কয়েক বছরের এএসইআর (অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট)-এর তথ্য থেকে জানা যায় যে, অন্তত গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে পড়া এবং প্রাথমিক অঙ্ক করার ব্যাপারে নিম্নতম দক্ষতাও তাদের নেই। এটা খুবই চিন্তার বিষয়। ২০১৮ সালের এএসইআর রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে সমস্ত পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীর মধ্যে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ একটি সহজ ছোটগল্পও পড়তে পারে না (অসুবিধের স্তর দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রের মতো)। ওই একই সংখ্যার ছেলেমেয়েরা দুই সংখ্যার বিয়োগ করতেও অক্ষম (যেটা দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আশা করা হয়)। সুতরাং ছয় মাস বা তারও বেশি সময় স্কুল বন্ধ থাকলে, তারা যতটুকু বা শিখেছিল, তাও ভুলে যাবে। তার বর্তমান অবস্থাটা বুঝে নিয়ে শিক্ষককে সেইখান থেকে আরম্ভ করতে হবে। এই সুযোগে তাঁরা প্রতি ছাত্রের বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাদা ভাবে দেখা করে তাঁদের বুঝিয়ে বলতে পারেন যে, বাড়িতে কী ভাবে তাদের সাহায্য করা যেতে পারে।
পাঠ্যক্রম অনুসারে তারা যে ক্লাসে পড়ছে, তারা যে তার অনুপযুক্ত, এই দোষ কিন্তু প্রায়ই ছাত্রের বা শিক্ষকের নয়। পাঠ্যক্রম শুরু হয় প্রথম শ্রেণি থেকে। তার চাহিদা দ্রুত বাড়তে থাকে। সেই ক্লাসের জন্য নির্দিষ্ট পাঠ্যবই থেকে শিক্ষকদের পড়ানোর কথা। সুতরাং, যে ছাত্র ক্লাসের পাঠ্যবই বুঝতে সক্ষম না হয়, সে পিছনে পড়ে থাকে। এএসইআর রিপোর্টে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, পঞ্চম শ্রেণিতে মাত্র ২০-৩০ শতাংশ ছাত্র ক্লাসের জন্য নির্দিষ্ট পাঠ্য থেকে জ্ঞান আহরণের সুফল পাওয়ার যোগ্য। বাকিরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে। বাকিরা যাতে অন্যদের ধরে ফেলার উপযুক্ত হয়ে ওঠে, তার জন্য স্পষ্টতই কিছু করা প্রয়োজন। এই ধরে ফেলার সমস্যা কিন্তু কোভিড-সঙ্কটের আগেও ছিল। এখন যখন ধীরে ধীরে স্কুলগুলি খুলছে, তখনই এই অত্যন্ত জরুরি ‘ধরে ফেলা’র কাজটি করার উপযুক্ত সময়।
এ কথা সকলেই জানেন যে, শক্ত ভিত্তি ছাড়া বহুতল অট্টালিকা বানানো যায় না। যে কোনও শিশুর পড়তে পারা এবং প্রাথমিক অঙ্ক কষতে পারাকে বলা যায় ভিত্তিপ্রস্তর। গত ১৫ বছর ধরে ‘প্রথম’ সংস্থার এএসইআর রিপোর্টে এই কথাই বলা হয়েছে, সমস্ত দেশ জুড়ে শিক্ষার এই প্রাথমিক স্তর দক্ষতা অর্জনের কথা। ২০২০ সালে নতুন শিক্ষানীতিতেও এই ভিত শক্ত করার কথা বলা হয়েছে এবং তা হতে হবে প্রাথমিক স্কুলেই।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার দুফলো গত দুই দশক ধরে এই পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে আসছেন, যাকে বলা হয়েছে, ‘টিচিং অ্যাট দ্য রাইট লেভেল’, অর্থাৎ উপযুক্ত স্তরে শিক্ষা। এই পদ্ধতি ‘প্রথম’ সংস্থারই সৃষ্ট। এই মডেলে যে সব ছেলেমেয়ে তৃতীয় শ্রেণি বা তার উপরের ক্লাসে পৌঁছেছে, অথচ পড়তে বা অঙ্ক কষতে শেখেনি, তাদের সাহায্য করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অল্প সময়ে এবং বাড়তি কোনও উপকরণ ছাড়াই, গত ২-৩ বছরে ‘প্রথম’ সংস্থা পশ্চিমবঙ্গের ৫০০টি গ্রামে পরীক্ষামূলক ভাবে এই মডেলে কাজ করে সুফল পেয়েছে। এই সব গ্রামে ৫০ দিনের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ছেলেমেয়ে পড়তে শিখে গিয়েছে।
এখন স্কুল খুলবে। শিক্ষক-শিক্ষিকা দেখুন কোন শিশুর অবস্থান কোথায়, পড়াশোনার দিক দিয়ে এবং সার্বিক ভাবে। স্কুলের সঙ্গে আবার যুক্ত হওয়া এবং নতুন করে প্রাথমিক শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করার গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁদের ঠিক ভাবে বুঝিয়ে দিলে এই পর্যায়ে বাবা-মায়েরাও সাহায্য করতে পারেন। এক বার স্কুল চালু এবং উপস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে সরকার থেকেও একটি ১০০ দিনের কর্মসূচি নেওয়া উচিত। স্কুল খোলার পর, অন্তত গ্রামের স্কুলগুলিতে এই প্রথম ১০০ দিনে নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম সরিয়ে রেখে, কেবল প্রাথমিক ভিত্তি গঠন করার দিকে নজর দেওয়া দরকার। উদ্দেশ্য হবে, যাতে তৃতীয় শ্রেণির ও তার উপরের ছাত্রছাত্রীরা বই থেকে পড়ে যেতে পারে এবং নির্ভয়ে অঙ্ক কষতে পারে। এটা যদি আমরা করতে পারি, তাদের ভিত্তি মজবুত হবে। শিক্ষক এবং অভিভাবকেরাও নিশ্চিন্ত মনে তাদের উচ্চশিক্ষার পথে পাঠাতে পারবেন।
স্কুল খোলার পর আমরা ঠিকঠাক পদক্ষেপ করতে পারলে দেখা যাবে অভিশাপের বদলে কোভিড আসলে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে।
সিইও, প্রথম এডুকেশন ফাউন্ডেশন