প্রতিবাদী স্বরকে বিনা বিচারে বন্দি করাই কাশ্মীরে এখন আইন
Mehbooba Mufti

কাকে বলে ‘স্বাভাবিক’

ভূস্বর্গে বাড়ি ওমরের, ভাল থাকারই তো কথা ছিল তাঁর। কারণ, ‘সরকারি আতিথ্যে’ খুঁত থাকার কথা নয়।

Advertisement

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০৩
Share:

অবরুদ্ধ: জম্মু ও কাশ্মীরের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও ওমর আবদুল্লা (ডান দিকে)।

একমুখ সাদা দাড়িতে ঢাকা সেই মুখের ছবি প্রথম দেখে চমকে উঠেছিলাম। চেনা মুখের ওমর আবদুল্লা যেন পাল্টে গিয়েছেন একেবারে, তাঁর একান্ত প্রিয় কাশ্মীরের মতোই! পরে মনে হল, এটাই তো স্বাভাবিক। নিজভূমে পরবাসী মানুষের চেহারা যে এ রকমই হয়!

Advertisement

ভূস্বর্গে বাড়ি ওমরের, ভাল থাকারই তো কথা ছিল তাঁর। কারণ, ‘সরকারি আতিথ্যে’ খুঁত থাকার কথা নয়। বিশেষত ভারত সরকার কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর ও আরও কয়েক জনের জন্য যেখানে বিশেষ ব্যবস্থা করে রেখেছে। এই উপত্যকারই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, ওমরের বাবা ফারুক আবদুল্লা, আর এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি, তাঁর দলের প্রবীণ নেতা, প্রাক্তন মন্ত্রী আলি মহম্মদ সাগর, প্রাক্তন বিধায়ক বশির আহমেদ ভিরি ও সরতাজ মাদানি— সকলেই ওমরের মতো সরকারি ‘অতিথি’। জম্মু-কাশ্মীর জননিরাপত্তা আইনে (পিএসএ) বন্দি। এই তালিকায় আরও আছেন কাশ্মীর থেকে আইএএস-এ প্রথম হওয়া শাহ ফয়জল। জম্মু-কাশ্মীর পিপল’স মুভমেন্ট-এর নেতা। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন তিনি। অতএব, ফয়জলও গণশত্রু।

গত বছরের ৫ অগস্ট থেকেই বন্দি তাঁরা অনেকে। কিন্তু প্রথম দফার বন্দিদশার সঙ্গে এ বারের ফারাকটা হল, এখন তাঁদের আটক করা হয়েছে কুখ্যাত জননিরাপত্তা আইনে। ফৌজদারি আইনের যে সব ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁদের, সে ধারায় বন্দিত্বের মেয়াদ শেষ হয়েছে সদ্য। অতএব, ‘দেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক’ ওমরদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হল পিএসএ! এই আইনের বলে প্রশাসন বিনা বিচারে তাঁদের বন্দি করে রাখতে পারে ছ’মাস থেকে দু’বছর পর্যন্ত। যদি না সুপ্রিম কোর্ট এর মধ্যে অন্য কোনও নির্দেশ দেয়।

Advertisement

পিএসএ প্রয়োগের পরে ওমর আবদুল্লার বিরুদ্ধে কী নথি আদালতে জমা দিয়েছে রাজ্য প্রশাসন? আবদুল্লার বিরুদ্ধে যুক্তি হল, তিনি জনপ্রিয়। এতটাই যে, উপত্যকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভোট বয়কটের ডাকের মধ্যেও তাঁর আহ্বানে মানুষ ভোট দিতে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। সুতরাং তাঁকে বন্দি করা দরকার। আশ্চর্য যুক্তি! গণতান্ত্রিক রাজনীতিকের কাজই তো করেছিলেন ওমর। ভারত সরকার তো চিরকাল এটাই চেয়ে এসেছে যে কাশ্মীরের মানুষ জঙ্গিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নির্ভয়ে ভোট দিন। তা হলে সমস্যা কোথায়?

মুশকিলটা এখানেই। জনপ্রিয়তাই ওমরের মুক্তির পথে প্রধান অন্তরায়। আদালতে যে নথি প্রশাসন পেশ করেছে, সেখানে বলা হয়েছে, মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। নথিতে অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি সন্ত্রাসবাদী চিন্তাধারাকে সমর্থন করেন। কাজেও তা করে দেখিয়েছেন। তার অর্থ, আদালতে প্রমাণ করার চেষ্টা, ওমর অত্যন্ত প্রভাবশালী। ‘গণতন্ত্রের পীঠস্থান’ কাশ্মীরে তাঁর মতো লোকজনের অবাধ বিচরণ কি চাইতে পারেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ-অজিত ডোভালেরা?

আর এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির বিরুদ্ধে সরকারের অভিযোগ, তিনি উগ্রপন্থাকে ‘মহান’ করেছেন এবং উপত্যকায় বিচ্ছিন্নতাবাদকে চারিয়ে দিয়েছেন। কাশ্মীরে ৩৭০ ও ৩৫এ অনুচ্ছেদ বিলোপে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ‘বিরুদ্ধ স্বর’ তিনিও। গত দশ বছরের নানা ঘটনার উল্লেখ করে নথিতে বলা হয়েছে মেহবুবা নাকি বিভিন্ন ভাবে হিংসাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন এবং তা থেকে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে।

ইতিহাসের মহাফেজখানায় এক বার উঁকি মারা যাক। তৎকালীন ভারতীয় জনসঙ্ঘ (অধুনা বিজেপি) সেই ১৯৫৪ সাল থেকে সাধারণ নির্বাচনের আগে যে নির্বাচনী ইস্তাহারগুলি প্রকাশ করে আসছে, সেখানেও দেশের নানা জনবিরোধী ও দমনমূলক আইন বিলোপের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। যেমন, ১৯৫৪-র ইস্তাহারে জনসঙ্ঘ স্পষ্ট ভাবেই জানাচ্ছে, গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিক স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায়, তা রক্ষায় তারা বদ্ধপরিকর। ক্ষমতায় এলে সতর্কতামূলক গ্রেফতারি সমেত এ ধরনের সব আইন তোলায় তারা পদক্ষেপ করবে। ১৯৫৭, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৭— ভারতীয় জনসঙ্ঘের বিভিন্ন বছরের নির্বাচনী ইস্তাহারের পাতায় পাতায় ঘুরেফিরে নাগরিক অধিকার রক্ষা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা, দমনমূলক যাবতীয় আইন বিলোপের প্রতিশ্রুতির ছড়াছড়ি।

অবশ্য বিরোধী পক্ষে থাকলে যে অনেক কিছুই বলা যায় এবং ক্ষমতায় এলেই যে সেগুলি মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যায়, তা তো এই গণতন্ত্রে আমরা বহু বার দেখেছি।

অথচ, এই আইন বিলোপের জন্য কবে থেকেই বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন দাবি জানিয়ে আসছে। এই আইন তোলার পক্ষে সাধারণ মানুষও। কারণ, কাশ্মীরে গত ৪২ বছর ধরে এই আইনের নির্বিচার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগের শিকার হয়েছেন উপত্যকার মানুষই। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত বছর এই আইনের অপপ্রয়োগের উপর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেই রিপোর্ট তারা শ্রীনগরে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রকাশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে রাজ্য প্রশাসন সে অনুমতি দেয়নি। পরে তা অনলাইনে প্রকাশ করা হয়।

সেই রিপোর্টে এই আইনে গ্রেফতার ২১০ জনের বিষয়টির পর্যালোচনা করা হয়। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ২৪০০ জনেরও বেশি লোককে জননিরাপত্তা আইনে ধরা হয়েছিল। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশই আদালতের নির্দেশে ছাড়া পান। ওই ২১০টি ঘটনার মধ্যে ৭১টি ক্ষেত্রে দেখা যায়, বন্দিরা যাতে সহজে বেরোতে না পারেন তার জন্য পুলিশ প্রশাসন নতুন করে এফআইআর করেছে। যখনই জামিনে মুক্তির সময় এগিয়ে এসেছে পুলিশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে একের পর এক মামলায় জড়িয়ে দিয়েছে।

অ্যামনেস্টির ওই রিপোর্ট ছাড়াও কিছু দিন আগে প্রকাশিত হয়েছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট। এটি তৈরি করেছে উপত্যকার দু’টি মানবাধিকার ও নাগরিক সংগঠন, জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর কোয়ালিশন অব সিভিল সোসাইটি (জেঅ্যান্ডকেসিসিএস) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব পেরেন্টস অব ডিজ়অ্যাপিয়ারড পারসনস (এপিডিপি)। রিপোর্টে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র ২০১৯ সালে ৬৬২ জনকে এই জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাও আছেন।

তথ্যের অধিকার আইনের (আরটিআই) সাহায্যে জানা গিয়েছে, ১৯৮৮ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত মোট ১৬,৩২৯ জনকে এই আইনে গ্রেফতার করা হয়। এর পরে ২০১৬-র ৮ জুলাই হিজবুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর প্রতিবাদে দীর্ঘ প্রায় ছ’মাস উত্তাল প্রতিবাদ আন্দোলন চলে। আন্দোলনের প্রথম একশো দিনেই অন্তত ৫০০ জনকে এই আইনে গ্রেফতার করা হয়। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে এই সংশোধিত আইনটি প্রথম আসে ১৯৭৮ সালে শেখ আবদুল্লার মুখ্যমন্ত্রিত্বের কালে। দেশে অন্য রূপে এই আইনটি আগেই ছিল। অথচ প্রথমে ঠিক হয়েছিল, কাশ্মীরে এই আইন কাঠের চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হবে।

দিল্লীশ্বরেরা জোর গলায় বলছেন, কাশ্মীর ‘স্বাভাবিক’। বিদেশি রাষ্ট্রদূতেরা দ্বিতীয় দফার ‘গাইডেড টুর’-এ উপত্যকা ঘুরেও গিয়েছেন। তাঁরা দিল্লিতে ফিরে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে দেখা করেছেন।

ডোভাল তাঁদের ‘ফিল’ জানতে চেয়েছেন। জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের পরে এই ডোভালই রাস্তায় নেমে বিরিয়ানি খেতে খেতে কাশ্মীরের ‘সাধারণ মানুষ’-এর কাছে তাঁদের ‘ফিল’ জানতে চেয়েছিলেন।

ইতিমধ্যেই ওমরের মুক্তি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁর বোন সারা আবদুল্লা পাইলট। সারা অভিযোগ এনেছেন, পিএসএ প্রয়োগ করে তাঁর দাদার বাক্‌স্বাধীনতা ও অন্যান্য সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা হয়েছে।

বসন্ত আসছে। উপত্যকার চিনার আর দেওদার গাছের সঙ্গে বসন্তের হাওয়ার ফিসফিসানি শুরু হবে এ বার। শুরু হয়েছে পাতা ঝরা। পাল্টে যাবে উপত্যকা আর প্রকৃতি। সাদা দাড়ি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে হতে আরও একটু পাল্টাবে ওমরের মুখাবয়ব।

কাশ্মীরের মুখ হয়ে উঠবে ‘স্বাভাবিক’। আরও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement