আমপানের মতো একটা দুর্যোগের তুলনা খুঁজতে অতীতের দিকে কি একটু ফিরে তাকাব আমরা? বঙ্গোপসাগরে সাম্প্রতিক ঝঞ্ঝার তালিকা বেশ লম্বা: আয়লা (২০০৯), নার্গিস (২০০৮), সিডার (২০০৭), ১৯৯৯ সালে ওড়িশার সাইক্লোন, তারও আগে ১৯৭০ সালে পূর্ববঙ্গে ভয়াবহ ভোলা সাইক্লোন। এই সব ঘটনা এখনও প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিতে জাগ্রত। কিন্তু বাংলায় সাইক্লোন বিপর্যয়ের কারণ ও প্রভাব বুঝতে হলে বহু অতীতের ঘটনাও আমাদের সাহায্য করতে পারে, যা বেঁচে রয়েছে কেবল ঐতিহাসিক স্মৃতিতে।
উনিশ শতকে গোটা বিশ্বের সব চাইতে ভয়ানক সাইক্লোন বিপর্যয় দেখেছিল বাংলা ১৮৭৬ সালে। এই ঝড় ভয়ঙ্কর ক্ষতি করেছিল পূর্ববঙ্গের উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে, মেঘনা নদীর মোহনার চার পাশের এলাকায়। যে দিন ঝড় হয়, সেই ৩১ অক্টোবর রাতে দশ লক্ষ মানুষের ঘুম ভেঙে যায় প্রবল হাওয়া, বৃষ্টির তোড়ে। ঝড়ের ধাক্কায় পর পর এসে আছড়ে পড়তে থাকে ঢেউ, যার উচ্চতা ছিল ৩০ থেকে ৪০ ফুট। বিশাল ঢেউ পেকে-আসা ফসল, গরু-বাছুর ভাসিয়ে নিয়ে যায়, বসতবাড়ি ও অন্যান্য সম্পত্তি শেষ করে দেয়। প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ জলে ডুবে প্রাণ হারান। তার পর এল কলেরা এবং দুর্ভিক্ষ, আরও এক লক্ষ মানুষ মারা যান তাতে।
সাইক্লোনের প্রবল গতিই কেবল এই বিপর্যয় তৈরি করেছিল, এমন নয়। এর উৎস যেমন ছিল প্রকৃতি, তেমনই সাম্রাজ্যবাদ। ১৮৭৬ সালের বাংলা একশো বছরেরও বেশি ব্রিটিশ শাসন দেখে ফেলেছে। তার মধ্যে পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সমাজে বহু পরিবর্তন এসেছে। জমিও বদলে গিয়েছে। আজ সমুদ্রতল উঁচু হয়ে জমি ডুবিয়ে দিচ্ছে, তখন কিন্তু ছবিটা ছিল উল্টো। নদীবাহিত পলি জমা হয়ে নতুন নতুন ভূখণ্ড তৈরি হচ্ছে। বাংলার উপকূলে নতুন জমি তৈরি হচ্ছে, তাতে যত লাভ তত ঝুঁকি। ব্রিটিশ সরকার চরে নতুন বসতি তৈরিতে উৎসাহ দিচ্ছে, তাতে তাদের কর বাড়বে। সব চাইতে দরিদ্র চাষি আর মজুররা ওই সব চরে বসতি শুরু করছে। ব্রিটিশ সরকার স্থানীয় তাঁতশিল্প আর লবণশিল্প উৎখাত করায় এরা অধিকাংশই কাজ হারিয়েছিল। এ বার সাইক্লোন আর ঝোড়ো-ঢেউয়ে প্রাণ হারানোর ঝুঁকি মাথায় নিল সেই মানুষগুলো।
সরকার সুন্দরবনের অরণ্য কেটে ফেলতেও উৎসাহ দিতে লাগল, সেই একই কারণে। যাতে চাষের জমি বার হয়, আর তা থেকে বেশি কর আসে। সরকারি আধিকারিকরা কিন্তু জানতেন যে ম্যানগ্রোভ গাছ সাইক্লোনের গতি, ঝোড়ো জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধ করে, ভিতরের জনবসতির মানুষদের প্রাণরক্ষা করে। তবু তাঁরা এই নীতি নিলেন। পশ্চিম এবং মধ্য সুন্দরবনে গাছ কেটে পরিষ্কার করে চাষ শুরুর পরিকল্পনা তেমন কাজ করল না, কারণ এই সব এলাকায় মিঠে জল পাওয়া গেল না। তাই এই অঞ্চলের অরণ্য এখনও অধিকাংশই সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু পূর্বে বদ্বীপের মিঠে জলে চাষ করা যায়, তাই অনেক বেশি গাছ কাটা হল। কিছু আধিকারিকের সতর্কবার্তা সত্ত্বেও অবশিষ্ট ম্যানগ্রোভ বাঁচিয়ে রাখার কোনও চেষ্টা হল না— যদিও সেগুলিই ছিল বঙ্গোপসাগরের ঝড় থেকে বাঁচতে চাষিদের একমাত্র আশ্রয়।
তার পর সেই ঐতিহাসিক সাইক্লোন। বিধ্বংসী ঝড়ের পর বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকার যতটা না প্রাণ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে কাজ করল, তার থেকে বেশি করল রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার লক্ষ্যে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল রিচার্ড টেম্পল ত্রাণের প্রতি একটা মুক্ত-বাজার মনোভাব নিলেন। কড়া বিধি জারি করলেন, যাতে সরকারি খরচ যথাসম্ভব কম হয়। ঝড়ের পর যারা বেঁচে রইল, তাদের সমস্যার বহরটা বুঝতেই পারলেন না তিনি। প্রয়োজন মেটার অনেক আগে বন্ধ হয়ে গেল ত্রাণকাজ।
যে সব সংবাদপত্রের মালিক ছিল বাঙালি, সেগুলো ত্রাণের কাজে সরকারের এই কৃপণতার কড়া সমালোচনা করল। বিশেষত এই জন্য যে, সরকার হাত গুটিয়ে নিল এমন এক সময়ে যখন ১৮৭৬ সালে ‘ইম্পিরিয়াল দরবার’-এর আয়োজনে বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করছে ব্রিটিশ সরকার। সেই দরবারে রানি ভিক্টোরিয়া ভারতসম্রাজ্ঞী ঘোষিত হবেন। সংবাদপত্রগুলি ইঙ্গিত দিল যে ত্রাণের অভাবেই সাইক্লোনের পর মারাত্মক কলেরার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। খাবার, জল, বাসস্থানের অভাবে রোগাক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বাংলায়।
১৮৭৬ সালের সাইক্লোনের পর ত্রাণকাজে কিছু সাফল্য এসেছিল অল্প যে ক’টি ক্ষেত্রে— তার একটি করেছিলেন এক বাঙালি সিভিল সার্ভেন্ট, রমেশচন্দ্র দত্ত। তিনি ভোলা দ্বীপে খাদ্যাভাব দুর্ভিক্ষে পরিণত হওয়ার আগেই রুখে দিয়েছিলেন। এই রমেশচন্দ্র পরে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে নাম করবেন, এবং ব্রিটিশ শাসনের ফলে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার সমালোচনা করবেন। সাইক্লোনের পরে বিতর্ক দেখা দিল যে, এমন ভয়ানক বিপর্যয় আটকানোর জন্য ভবিষ্যতে কিছু করা সম্ভব কি না। বাঁধ তৈরি, উঁচু ইটের বাড়ি বা উঁচু ঢিবি তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হল, কিন্তু অতিশয় খরচসাপেক্ষ বলে সব প্রস্তাবই বাতিল হল। ভবিষ্যতে এমন বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে উপকূলবর্তী মানুষদের প্রাণ রক্ষার কথা ভেবে কিছুই করল না ব্রিটিশ শাসকরা।
এ বার আমপানে বিপুল ক্ষতি হলেও, সরকারের প্রতিক্রিয়া বলে দেয়, ঔপনিবেশিক সময়ের তুলনায় অনেক পরিবর্তন এসেছে উপকূলে বসবাসকারী মানুষের পরিস্থিতিতে। অনেক বেশি নিরাপদ আশ্রয় তৈরি হয়েছে, ঝড়ের আগাম বার্তা দেওয়ার আধুনিক প্রযুক্তি তৈরি হয়েছে, মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও প্রস্তুত হয়েছে। গণতান্ত্রিক এক ব্যবস্থা মোটের উপর রয়েছে, যাতে ভোট পাওয়ার তাগিদে বিপর্যয়ের পরে ত্রাণ দিতে প্রণোদিত হয় সরকার। চিকিৎসা পদ্ধতি ও তার সংগঠনও আগের থেকে ভাল হয়েছে, যদিও সাবেক কলেরা আর ডায়রিয়ার পাশাপাশি এখন কোভিড-১৯’এর মতো নতুন নতুন রোগ এসেছে। ভবিষ্যতে আরও বড় বড় চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে, যে হেতু আবহাওয়ার পরিবর্তনের জন্য বাংলায় দক্ষিণাংশে আমপানের মতো ঝড় আরও শক্তিশালী, আরও ঘন ঘন হবে আশঙ্কা। তা থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে জানতে হবে, অতীতে এই সঙ্কটময় উপকূলে কী কী ভুল করা হয়েছে।
গবেষক, টে আরাফিটি, নিউজ়িল্যান্ড