প্রবন্ধ১

সস্তা তেলের সাগর হঠাৎ শুকিয়ে যাবে

অতীতেও তেলের বাজার সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন ছিল। এখন অনিশ্চয়তায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। সস্তা পেট্রোলিয়মের সুখসাগরে ভাসছি বটে, কিন্তু তেলের বাজারে আকস্মিক পরিবর্তন হবেই। এখনই প্রস্তুত হওয়ার সময়।ইয়েমেনে সৌদি বিমান থেকে বোমাবর্ষণ। আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে উদ্ভ্রান্ত লড়াই। আরব বসন্তের স্মৃতি মুছে দিচ্ছে শীতার্ত বাতাস। এবং এখন ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তির রূপরেখা নিয়ে বোঝাপড়া। যে অঞ্চলটি একই সঙ্গে দুনিয়ার অর্থনীতি, রাজনীতি এবং পরিবেশের গতিপ্রকৃতিতে বড় ভূমিকা নিয়ে এসেছে, সেখানে এ-রকম বহুমাত্রিক জটিল সংকট অভূতপূর্ব বললে অত্যুক্তি হয় না।

Advertisement

ভাস্কর চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৫ ০০:২৭
Share:

ইয়েমেনে সৌদি বিমান থেকে বোমাবর্ষণ। আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে উদ্ভ্রান্ত লড়াই। আরব বসন্তের স্মৃতি মুছে দিচ্ছে শীতার্ত বাতাস। এবং এখন ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তির রূপরেখা নিয়ে বোঝাপড়া। যে অঞ্চলটি একই সঙ্গে দুনিয়ার অর্থনীতি, রাজনীতি এবং পরিবেশের গতিপ্রকৃতিতে বড় ভূমিকা নিয়ে এসেছে, সেখানে এ-রকম বহুমাত্রিক জটিল সংকট অভূতপূর্ব বললে অত্যুক্তি হয় না।

Advertisement

ঐতিহাসিক এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ছাড়াও অন্য একটা কারণে পশ্চিম এশিয়া অনন্য। খনিজ তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে এই অঞ্চলটির বিরাট প্রতিপত্তি। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার, এই এলাকায় এতটা সংঘাত ও অস্থিরতা সত্ত্বেও তেলের দর খুবই স্তিমিত। ইয়েমেনে অশান্তির ফলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল যে, বাবেল মান্ডেব প্রণালী দিয়ে পেট্রোলিয়ম চলাচল ব্যাহত হবে, সেই আশঙ্কার তাড়নায় তেলের দাম চড়তে শুরু করেছিল, কিন্তু ঠিক তখনই ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তির অগ্রগতির ফলে দাম আবার কমে গেল। হচ্ছেটা কী? তেলের বাজারে পশ্চিম এশিয়ার অতিরিক্ত গুরুত্ব কি তবে ইতিহাস হয়ে গেল? আমরা কি ধরে নিতে পারি তেলের দাম কমই থাকবে? ইরানের সঙ্গে বোঝাপড়া হলে কি এই অঞ্চলে শত অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও তেলের দাম আরও কমবে? এতটা আশা করার আগে বলি, অবাক হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন।

অন্য নানা বাজারের মতোই তেলের বাজারেও চাহিদা এবং জোগান, দু’দিকেই অনিশ্চয়তা আছে। চাহিদার সমস্যাগুলোর সম্ভাব্য উত্‌স প্রধানত এই অঞ্চলের বাইরে, যেমন চিনা অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া, ডলারের দাম ইত্যাদি। জোগানের ক্ষেত্রে এত দিন পরিস্থিতিটা ছিল এই রকম যে, তেল উত্‌পাদনকারী দেশগুলো পাছে উত্‌পাদন এবং জোগান বাড়িয়ে বেশি আয় করার বেলাগাম প্রতিযোগিতায় নামে এবং তার ফলে তেলের দাম অসম্ভব কমে যায়, সেই সম্ভাবনা আটকানোর জন্য তারা নিজেদের একটা ‘কার্টেল’ বা গোষ্ঠী বানিয়ে রেখেছে, যাতে সবাই একযোগে সিদ্ধান্ত নিয়ে উত্‌পাদনের কোটা ঠিক করতে পারে। এই গোষ্ঠীর বারোটি সদস্য দেশের মধ্যে আটটি পশ্চিম এশিয়ার। এটা একটা জটিল দাবা খেলার মতো, যার পরিণাম অনিশ্চিত। গত এক বছরে এই খেলায় নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। তেলের বিশ্ববাজারে অন্তত তিনটি বোর্ডে খেলা চলছে। প্রত্যেকটা খেলাতেই নিজস্ব অনিশ্চয়তা আছে, আর তার ফলে সামগ্রিক ভাবে তেলের দাম নিয়ে অনিশ্চয়তা বেড়ে গেছে।

Advertisement

এক নম্বর বোর্ড: শেখ বনাম শেল

সৌদি আরবের নিরবচ্ছিন্ন চাপসৃষ্টির ফলে ‘ওপেক’ নামক এই নড়বড়ে জোটটি সম্প্রতি শিরদাঁড়া শক্ত করে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর মোকাবিলায় রুখে দাঁড়িয়েছে। সেই প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে দেশে পাথরের খাঁজে ‘শেল অয়েল’-এর বিরাট ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে, তারা এখন ওপেককে উত্‌পাদন ও জোগান কমানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু ওপেক সেই চাপ মেনে নেয়নি। জোগান বেশি হওয়ায় তেলের দাম অস্বাভাবিক কম এবং তার ফলে শেল অয়েলের কারবারে বিনিয়োগ যথেষ্ট লাভজনক থাকছে না, মার্কিন ব্যবসায়ীদের অসুবিধে হচ্ছে। বস্তুত, ওপেক উত্‌পাদন নিয়ন্ত্রণে রাজি না হওয়ার ফলে গত নভেম্বর থেকে উত্তর আমেরিকায় শেল অয়েল এবং গ্যাস তোলার পারমিট মঞ্জুরি চল্লিশ শতাংশ কমে গেছে।

অবশ্যই এ খেলা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি বিষয়ক সরকারি তথ্য অনুসারে, গত নভেম্বর থেকে সে দেশের অপরিশোধিত পেট্রোলিয়মের উত্‌পাদন দাঁড়িয়েছে গড়পড়তা দৈনিক ৯৪ লক্ষ ২০ হাজার ব্যারেল, ১৯৭৩-এর পরে পরিমাণটা কখনও এত বেশি হয়নি। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক বছর আগে যেখানে ১৪৭৩টি অয়েল রিগ চালু ছিল, এখন সেখানে চালু আছে মাত্র ৮২৫টি। রহস্যটা কী? আসলে মার্কিন অয়েল রিগগুলির উত্‌পাদনশীলতা অনেক বেড়েছে, আর এ ভাবেই আমেরিকা সৌদি তথা ওপেককে জবাব দিচ্ছে। কিন্তু এর পরিণাম হল: তেলের দামের ভবিষ্যত্‌ বিষয়ে অনিশ্চয়তা।

দু’নম্বর বোর্ড: পুতিন বনাম ওবামা

ইতিমধ্যে জ্বালানি উত্‌পাদক আর একটি দেশ একটা সম্পূর্ণ অন্য খেলা খেলছে। তার নাম রাশিয়া। স্বনির্বাচিত মহানায়ক প্রেসিডেন্ট পুতিন ঠিক কী চান, দেবা ন জানন্তি। সাম্রাজ্য বিস্তারের যে অভিযানে তিনি নেমেছেন, তা কত দূর প্রসারিত হবে? তিনি কি কেবল ব্ল্যাক সি অঞ্চলটির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান, যাতে ইউরোপের দেশগুলিতে জ্বালানি সরবরাহের রাস্তাটায় তাঁর প্রতিপত্তি থাকে? না কি, তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরও অনেক দুর বিস্তৃত? তিনি সোভিয়েত আমলের সাম্রাজ্য ফিরে পেতে চান? কিংবা কে জানে, তাঁর মাথায় হয়তো কোনও পূবনির্ধারিত লক্ষ্য নেই, তিনি স্রেফ মর্জিমাফিক চলছেন, হয়তো বিচারবুদ্ধির বিপরীতেই চলছেন?

পুতিনের অভিরুচি বা পরিকল্পনা যা-ই হোক না কেন, আপাতত একটা ব্যাপার পরিষ্কার। খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসকে তিনি রণকৌশলের একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে বিশেষ আগ্রহী। রুশ সরকারের মোট রাজস্বের প্রায় অর্ধেক আসে পেট্রোলিয়ম ও ন্যাচারাল গ্যাস থেকে, ফলে জ্বালানির জোগান নিয়ন্ত্রিত এবং দাম চড়া থাকলে ক্রেমলিনের লাভ। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার যথেচ্ছাচার তেলের বাজারে অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তুলতে বাধ্য। আর এখানেই ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির তাত্‌পর্য।

তিন নম্বর বোর্ড: সুন্নি বনাম শিয়া

এক নম্বর বোর্ডে সৌদি আরব যে খেলা চালাচ্ছে, সেটা ইরানের কোনও দিনই পছন্দ নয়। সে দেশের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা সৈয়দ আল খামেনেই টুইট করেছিলেন, ‘তেলের দাম এতটা কমে যাওয়ার ফলে ইসলামি এবং স্বাধীন দেশগুলির স্বার্থে বড় ধাক্কা লেগেছে।’ এটা কেবল শেল অয়েল উত্‌পাদন সম্পর্কে মতানৈক্যের ব্যাপার নয়, ওপেক-এর অন্দরমহলে গভীর আদর্শগত বিভাজন আছে: ইরান এবং সৌদি আরব দু’দেশই ওপেক-এর সদস্য, এবং সৌদি আরব সুন্নি ইসলামের নেতৃত্ব অধিকার করেছে আর ইরান শিয়া ইসলামের নেতৃত্বের দাবিদার। তা ছাড়া, তেলের দাম কমে যাওয়ার ধাক্কা কে কতটা সামলাতে পারবে, সেই সামর্থ্যেও দু’দেশের মধ্যে অনেক ফারাক। ইরানের রফতানিজাত আয়ের ৬০ শতাংশ এবং, ২০১৩ সালের হিসেবে, জিডিপি বা জাতীয় আয়ের সিকিভাগ আসে হাইড্রোকার্বন থেকে। অন্য দিকে, গত আর্থিক বছরের শেষে সৌদি আরবের হাতে ছিল ৭৪১০০ কোটি ডলারের ভাণ্ডার, ওই বছরে বৈদেশিক লেনদেনে উদ্বৃত্তের অঙ্ক ছিল ১৫০০ কোটি ডলার।

যেখানে যে ভাবে সম্ভব সৌদি আরবকে চ্যালেঞ্জ জানানোয় ইরানের স্বার্থ আছে। পরমাণু চুক্তির ফলে যদি ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়, তা হলে তার এই চ্যালেঞ্জ গড়ে তোলার শক্তি বাড়বে। লেবানন, সিরিয়া, ইরাক এবং এখন ইয়েমেনে ইরানের প্রভাব বেড়েছে। এর ফলে আয়াতোল্লা আল খামেনেইয়ের হাতে এই অঞ্চলে খনিজ তেলের চলাচল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বেড়েছে, সেই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তিনি তেলের বাজারে দাম বাড়িয়ে দিতে পারেন। এটা ঠিকই যে, পরমাণু চুক্তির উদ্যোগ ঠিক ঠিক এগোলে বিশ্ব বাজারে ইরানের তেল সরবরাহের মাত্রা বাড়বে, কিন্তু শিয়া-সুন্নি বিরোধ এবং ওপেক-এর অন্তর্দ্বন্দ্ব এই বাজারকে উল্টো দিকে ঠেলতে পারে, বিশেষ করে যেহেতু সৌদি আরব তেলের দাম কমিয়ে রাখতে চায় এবং ইরান চায় তার বিপরীত।

নেট ফল? অতীতেও তেলের বাজার সম্পর্কে কোনও পূর্বাভাস দেওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল। এখন সেই অনিশ্চয়তায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। আপাতত আমরা সস্তা পেট্রোলিয়মের সুখসাগরে ভাসছি বটে, কিন্তু ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির ফলে তিন নম্বর বোর্ডের খেলাটি জমে উঠছে, যার পরিণাম সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন হতে পারে। তেলের বাজারে আকস্মিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, এখনই তার জন্যে প্রস্তুত হওয়ার সময়। সুখের দিন অচিরেই শেষ হতে পারে। হয়তো একটু বেশি তাড়াতাড়িই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টাফ্ট্স ইউনিভার্সিটিতে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যান্ড ফিনান্স-এর সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট ডিন

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement