গ্রাফিক—শৌভিক দেবনাথ।
এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে অভূতপূর্ব অন্যায় আর অবিচার দেখতে হচ্ছে আমাদের। ফলাফলে অসংখ্য অসঙ্গতি। সেই অসঙ্গতি ঘিরে প্রবল বিক্ষোভ, সংসদ অধিকর্তাকে রাজ্যের মুখ্যসচিবের তলব, রাতারাতি অকৃতকার্য অনেক পরীক্ষার্থীকে ‘পাশ’ করিয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা এ রাজ্যে কোনওদিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
অতিমারির কারণে এ বার পরীক্ষা বাতিল হয়েছে। নানা মুনিজনের নানা অভিমত নিয়ে মূল্যায়নের খসড়া তৈরি করেছে সংসদ। তাতে গুরুত্ব পেয়েছে মাধ্যমিক ও একাদশ শ্রেণির নম্বর। সেই একাদশ শ্রেণি, যার ফল কোনও দিন বিবেচ্য হয় না চূড়ান্ত মূল্যায়নে। সেই পরীক্ষা গত বছর শেষ হওয়ার আগেই সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, একাদশ শ্রেণির সকলকেই দ্বাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হল।
সারা বছর বাচ্চারা কাটাল গভীর অনিশ্চয়তার আবহে। এর মধ্যে হয়ে গেল বিধানসভার নির্বাচন। নতুন শিক্ষামন্ত্রী জানালেন— পরীক্ষা হবে! যথেষ্ট ক্লাস পাওয়া যায়নি। তবুও নানা ভাবে ছেলেমেয়েদের বুক বেঁধে তৈরি হওয়ার সঙ্গী হয়েছিলাম আমরা— দিদিমণি আর মাস্টারমশাইরা।
উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পর বিক্ষোভ। ফাইল ছবি।
পরীক্ষাগুলো বাতিল হল শেষ পর্যন্ত। মূল্যায়নের খসড়া প্রকাশিত হওয়ায়, বিশেষত একাদশ শ্রেণির নম্বর অন্যতম মান নির্ধারক হিসেবে স্থির হওয়ায় অনেকেই প্রমাদ গুনেছিলেন। গত বছর হঠাৎ নেমে আসা লকডাউনে পরীক্ষা এবং স্কুল বন্ধ হওয়ায় খাতাগুলি যত্ন করে রাখা হয়েছে সর্বত্র? যে পরীক্ষায় সবাই পাশ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, অসমাপ্ত পরীক্ষার সেই খাতাগুলি কি যথোচিত গুরুত্বের সাথে দেখেছেন পরীক্ষকেরা? যে সব পরীক্ষার্থী পাশ নম্বর পায়নি অথচ দ্বাদশ শ্রেণিতে পৌঁছে গিয়েছে, যাদের কোনও টেস্ট পরীক্ষাও কোনও ভাবেই হয়নি, এই নতুন মানদণ্ডে তারা যে অনেকেই পাশ করতে পারবে না, সেই শঙ্কা অনেকেই প্রকাশ করছিলেন।
শঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। বয়ঃসন্ধির একঝাঁক কিশোর-কিশোরী, যাদের উপর দিয়ে প্রায় দেড় বছরকাল বয়ে গিয়েছে অনেক উৎকণ্ঠার ঝড়, তাদের একটা বড় অংশ দেখতে পেল যে, মাধ্যমিক আর একাদশ শ্রেণি, একটি অর্জিত আর একটি ঘোষিত পাশ। এই ঘোষিত পাশের নিট ফল কী করে ফেল হয়? এরা প্রায় সকলেই স্কুলের হাতের প্রজেক্ট বা প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় পাশ নম্বর পেয়েছে। তাদের এত দিনের অনেক চাপা উদ্বেগ এই অকল্পনীয় ফলের আঘাতে তীব্র ক্ষোভের রূপ নিয়েছে। অথচ, নিরাপদ স্বাচ্ছন্দ্যে থাকা আমরা তাদের কাছে পরিশীলিত সংযম আশা করছি। খবরে প্রকাশ, শতকরা ৯০-এর উপর নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা এই বছরের উচ মাধ্যমিকে গত বারের এক-তৃতীয়াংশেরও কম।
এটাই তো হওয়ার ছিল। তা হলে কি ধরে নিতে হবে যে, এক বছরে সরকারি আর সরকারি অনুদান-পাওয়া বিদ্যালয়গুলিতে মেধার অতর্কিত অবনমন ঘটেছে?
ফলপ্রকাশের পর আইএসই-র পড়ুয়ারা। ফাইল ছবি।
এরই মধ্যে প্রকাশ পেল কেন্দ্রীয় বোর্ড আইএসসি-র ফল। সেই পরীক্ষাটিও বাতিল হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, বিপুল হারে ছেলেমেয়েরা শতকরা ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। নেটমাধ্যমে জ্বলজ্বল করছে তাদের অর্জনের ছবি। অবমাননায় অপমানে মুখ নিচু করে আছে আমাদের রাজ্যের সংসদের রেজাল্ট হাতে একগুচ্ছ ১৮ বছর। সরকার বাতিল করেছেন সব নামী-অনামী কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলি। ছেলেমেয়েরা নিজেদের প্রমাণ করার কোনও রকম সুযোগ পেল না।
আমাদের বাংলার না-হওয়া পরীক্ষায় দিল্লি বোর্ডের তুলনায় কম নম্বর নিয়ে মানহারা মেধাবী মেয়েটি কোন কুণ্ঠায় কলেজগুলির পোর্টালে প্রবেশ করবে? এ যাবত প্রিয় আর প্রয়োজনীয় ‘কন্যাশ্রী’-র ভূষণ আর হাতে মুখ্যমন্ত্রীর উপহার মুঠোফোন বা ট্যাব কেবল মাত্র উচ মাধ্যমিক সংসদের অবিবেচনায় তাকে ব্যর্থ করে তুলবে? এই ব্যবস্থা মেধাকে সম্মান করে না। বিশ্বাস করে না মেধার তুল্যমূল্য বিচারেও। তা করলে এই রাজ্যের নিজস্ব বোর্ডের অনেক স্বপ্ন দেখা কিশোর-কিশোরীকে এই অসহ অবমাননায় পুড়ে যেতে হত না।
অবসাদ থেকে ওরা যদি নষ্ট ছেলে বা মেয়ে হয়, যদি হারিয়ে যায়, তার দায় কে নেবে?
(লেখক প্রাক্তন শিক্ষিকা, মতামত একান্তই ব্যক্তিগত)