সার্জিকাল স্ট্রাইক বিষয়ে আমরা কী জানি? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ভারতীয় বোমারু বিমান বালাকোটে প্রচুর সন্ত্রাসবাদী এবং তাদের অনুশীলন কেন্দ্র ধ্বংস করা হয়েছে। পাকিস্তান বলেছে, কই, কিছুই তো হয়নি। বিরোধীরা বলছে, প্রমাণ কই? কংগ্রেস বলছে, এ কোনও কাজই নয়, আমাদের হাতে যখন ক্ষমতা ছিল আমরাও বহু বার করেছি সার্জিকাল স্ট্রাইক।
কোনটা বিশ্বাস করবেন? কিসের ভিত্তিতে, কোন যুক্তিতে? প্রশ্নটা উঠছে নানা প্রসঙ্গে। আবহাওয়ার পরিবর্তন সত্য না ভুয়ো, বেকারের সংখ্যা বাড়ল না কমল, রামায়ণ ইতিহাস না গল্প, এ ধরনের প্রশ্নের বিচার করার জন্য যে তথ্য এবং প্রশিক্ষণ লাগে, অধিকাংশ মানুষের সেটা নেই। তাই বলে কি তাঁদের মত নেই? বিশ্বাস আটকে আছে? জ্ঞান থাক না থাক, অভিমত ঠিকই আছে। বিশেষজ্ঞেরা প্রমাণ-যুক্তি-তর্কের মধ্যে ঘুরপাক খান। অনেক সহজে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান আমজনতা।
কী করে? এই বিবেচনার মূলে রয়েছে আমাদের চিন্তার এক বৈশিষ্ট্য, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘কনফার্মেশন বায়াস’। এক ধরনের পক্ষপাত, যার দ্বারা নতুন তথ্য এমন ভাবে মানুষ গ্রহণ করেন, যা তাঁর পূর্বের ধারণাকে আরও গভীর, গাঢ় করে। জমির এক দিকে ঢালু থাকলে যেমন জল সে দিকেই গড়ায়, তেমনই যে বিশ্বাসগুলো চিন্তার খাত তৈরি করেছে, নতুন তথ্য সেই খাতেই গিয়ে জমা হয় মনে। যা মনে ধরে না, মন তা ভুলে যায়। যেটা বুঝলে লাভ হয় না বলে মনে করে, সেটা বোঝে না। অযৌক্তিক মনে হলেও, এর পিছনে একটা গূঢ় যুক্তি আছে।
ড্যানিয়েল কানমান অর্থনীতিতে নোবেলবিজয়ী মনোবিজ্ঞানী। তাঁর গবেষণা দেখিয়েছে, মানুষের মস্তিষ্ক কাজ করে দুই গতিতে, সবেগে বা ধীরে। বেশির ভাগ সময় মানুষ চিন্তা করতে চান না, করেনও না। কারণ চিন্তা দাবি করে মনের পরিশ্রম। মানুষ চায় মানসিক আয়েশ। ভাবতে না হলেই খুশি আমাদের আলস্যপ্রিয় মন। এই চিন্তাহীন বিচারের কিন্তু অনেক সুবিধা আছে। জরুরি অনেক প্রশ্নের (খাদ্য না বিষ, আমার দলে না অন্য দলে, পালাব না লড়ব) জবাব মুহূর্তে মাথায় আসে। কাউকে বলে দিতে হয় না, সময় বাঁচে, জীবন সহজ হয়।
প্রতিটি জাগ্রত মুহূর্তে আমাদের যাবতীয় ইন্দ্রিয় অভিভূত হয় নতুন তথ্যে। আওয়াজ আর সুর, চিৎকার আর ফিসফিস, কথা আর সংখ্যা, খবর আর গুজব। এ সবই তথ্য। সব তথ্যের সরলীকরণ দরকার। আমাদের মাথার ভেতর সেই সরলীকরণ হয়ে যায় ভাবনাচিন্তার আগেই। এটা আওয়াজ, ওটা সুর। এটা খবর, ওটা গুজব। এই কথাটা আগে শুনিনি, শুনতে চাই না, কারণ মানে বুঝি না। বা বুঝে লাভ নেই। যদি লাভ থাকত, নিশ্চয়ই বুঝতাম। যে হেতু আমি জানি না, সে হেতু আমি মানি না।
আগে খবর আসত পড়শির মুখে, কাগজে আর চিঠিতে। নতুন খবর ছিল কম, আসত ধীরে। লোকের বোঝার ক্ষমতা বাঁধা ছিল আচারে, সংস্কারে, নিয়মে। তাঁদের মতামতের দামও ছিল কম। না ছিল গণতন্ত্র, না ছিল ভোট। আর এখন? সাধারণ মানুষের অভিমত জানতে এবং বদলাতে চায় সবাই, বাণিজ্য সংস্থা থেকে রাজনৈতিক দল। তথ্যের বন্যা বইছে, টিভি, কাগজ তো আছেই, তার ওপর সমাজমাধ্যম। কেউ বলেন টুপি-পরা লোক দেখলে পুলিশে খবর দিন, কেউ বলেন পুলিশ দেখলে টুপি-পরা লোকদের খবর দিন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বীরপুরুষ। বিরোধীরা বলেন, আপনি মিথ্যেবাদী। খবর, গুজব, কুৎসা, মিথ্যে মিলেমিশে বিদ্যুৎগতিতে ছড়াচ্ছে। চোখের দেখাকেও বিশ্বাস নেই। আসল ভিডিয়ো, নকল ভিডিয়ো, অস্ত্রোপচার করা ভিডিয়ো, সব চলছে। এই সময়টাকে বলা হচ্ছে ফেক নিউজ় এবং অসত্যের যুগ। স্টিভেন কোলবার্ট নামে এক মার্কিন কৌতুকশিল্পী নতুন একটি শব্দ বানিয়েছেন: ‘ট্রুথিনেস’। মানে এমন এক দশা যখন যা-ই পছন্দসই শোনায়, মনে হয় সত্যি হলেও হতে পারে, তার আর প্রমাণ লাগে না। সত্যি হলে যাঁর সুবিধা, তিনি ধরে নেন এটাই সত্যি।
তবে কি বলব এটা অসত্যের যুগ? তা হলে তো ধরে নিতে হয় যে এর আগে ছিল সত্যের যুগ। রাজা, নেতা আর মুনি সবাই সত্য বই মিথ্যা বলতেন না। তাঁরা তর্ক করতেন আবেগহীন বিশেষজ্ঞদের মতো আর ঝগড়া করতেন যুধিষ্ঠিরের মানদণ্ডে। এমন চিন্তা অবাস্তব। সত্যি আর মিথ্যে, আসল খবর আর নকল খবর চির কালই পাশাপাশি।
তা হলে এ যুগের বৈশিষ্ট্য কী? তা এই যে, তথ্যের এত দোকানদার, খবরের ব্যবসায়ী আগে কখনও ছিল না। এত সহজে খবর বিক্রি করা যেত না। ত্রিশ বছর আগে ছিল সংবাদপত্র, আকাশবাণী আর দূরদর্শন। এখন দেশে শুধু খবরের চ্যানেলই চারশো। সম্ভ্রান্ত সংবাদপত্রেও মিলছে ‘কেনা খবর’ (পেড নিউজ়), মতামতের মোড়কে বিজ্ঞাপন। নেতারাও যাতে লাভ, তা-ই বলেন। যিনি বিশ্বাস করতে চান তিনি করেন। যিনি চান না, তিনি করেন না। এই রকমারি তথ্যের বাজারে সব তথ্যের খরিদ্দার আছেন। যাঁর যে দোকানদারকে পছন্দ, যাঁর ওপর বিশ্বাস, তিনি তাঁর থেকেই খবর কেনেন। খবরটা সত্যি কি না সেটা বড় কথা না। কে বিক্রি করছেন, সেটাই আসল কথা। মোদীভক্ত আর দিদিভক্তদের জন্য মোদী আর দিদির কথাই যথেষ্ট। ধ্রুবসত্য না হলেও, যথেষ্ট ঠিক। মোদী যদি বলেন সার্জিকাল স্ট্রাইক হয়েছে, তা হলে নিশ্চয়ই হয়েছে। ভক্তদের প্রমাণের প্রয়োজন নেই। আর যাঁরা ভক্ত নন, অবিশ্বাসী, তাঁরা অন্য দোকানে যান। অন্য দোকানদার খুঁজুন। দেখুন কাউকে বিশ্বাস করা যায় কি না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টেম্পল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক