India Lockdown

এরা কী ভাবে দেখবে ভারতকে

আজ অগণিত স্তব্ধ ইটভাটায়, বন্ধ কারখানা চত্বরে, গাছতলায়, জাতীয় সড়কের ধারে একফালি রুক্ষ জমিতে জন্ম নিচ্ছে কত গল্প।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২০ ০০:৫৫
Share:

বাবা নাম রেখেছেন আলাউদ্দিন। ভারতে এক সুলতান ছিলেন ওই নামে। প্রতিটি নবজাতকই অবশ্য সুলতান, গোটা বিশ্ব তার উত্তরাধিকার। এই আলাউদ্দিন যখন সরেজমিনে তার দুনিয়াজোড়া জায়গির দেখতে এল, তখন পুলিশ ট্রাক থামিয়ে নামাচ্ছে যাত্রীদের। এক এক করে একশো পঁচিশ জনকে। হ্যাঁ, একটা ট্রাকেই ঢুকেছিল এতগুলো মানুষ। লকডাউনে নিশ্চল শিলিগুড়ি থেকে কোকড়াঝাড়ে পৌঁছতে পরিযায়ী মজুরদের মরিয়া যাত্রা মাত্র আধ ঘণ্টার দূরত্বে, বীরপাড়ার নাকায় শেষ হল। ট্রাক থামল, কিন্তু আকলিমা বিবির সন্তান গর্ভমুক্তির যে যাত্রা শুরু করেছে, তা থামার নয়। অতঃপর অ্যাম্বুল্যান্স, হাসপাতাল। কয়েক ঘণ্টা পার না হতে দেখা গেল, মেয়ে-পুলিশদের চাঁদায় কিনে আনা নতুন জামা-তোয়ালেতে সেজে দিব্যি ঘুমোচ্ছে আলাউদ্দিন। যেন এমনই হওয়ার কথা ছিল। যেন ওই সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুই রাষ্ট্রের উর্দি-পরা রক্ষককে নির্দেশ দিয়েছিল, আমি এসেছি, আমার প্রতি কর্তব্য করো।

Advertisement

কী হত যদি প্রসব হয়ে যেত অমন ভিড়ে-ঠাসা ট্রাকের মধ্যে, প্রবল ঝাঁকুনির মাঝে? কিংবা ভাগলপুরের নগাছিয়া থেকে শিলিগুড়ি অবধি ২৩২ কিলোমিটার, যা আকলিমা হেঁটেছেন চার দিন ধরে, তার মাঝামাঝি রাস্তায় যদি কিছু হত? ‘‘আমরা তো ভেবেছিলাম বিহারেই ছেলেটা হবে,’’ বললেন আতোয়ার রহমান। ইটভাটায় শ্রমিকরা ছয়-সাত মাস থেকে কাজ করেন। লকডাউন ঘোষণা হতে ভাটামালিকরা কাউকে থাকতে দিতে চাইল না। অগত্যা পূর্ণগর্ভা আকলিমা, আর কাঁধে চার বছরের ছেলেকে নিয়ে বাকি মজুরদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করেন আতোয়ার। রিকশা কি ভ্যান রাস্তায় পেলে একটু এগিয়ে দেয়, তিন কি পাঁচ কিলোমিটার যেতে দুশো থেকে পাঁচশো টাকা নিয়ে নেয়। ‘‘দলের অন্যরা এগিয়ে যেত। যখন ওরা বসে খাওয়াদাওয়া করত, তখন আমরা গিয়ে ওদের ধরতাম’’ তা হলে আপনারা খেতেন কখন? ‘‘ওই চিঁড়া-মুড়ি খেতাম।’’

এমন হাঁটতে হাঁটতে কত মা জন্ম দিচ্ছেন আজ, হয়তো এই মুহূর্তেই। আগ্রা-মুম্বই জাতীয় সড়কের উপর ৫ মে যেমন দিয়েছেন শকুন্তলা কৌল। মহারাষ্ট্রের নাসিকে কারখানা বন্ধ হতে যাচ্ছিলেন বাড়ি মধ্যপ্রদেশের সাতনা। সত্তর কিলোমিটার হাঁটার পর প্রসব, ঘন্টাখানেক জিরিয়ে, তার পর ১৬০ কিলোমিটার হাঁটেন। মহারাষ্ট্র-মধ্যপ্রদেশ সীমান্তের নাকাবন্দিতে সদ্যোজাতকে দেখে হতবাক হয়ে যায় পুলিশ। ১২ মে উমা দেবী উত্তরপ্রদেশের ললিতপুরে রাস্তার পাশে জন্ম দিয়েছেন এক কন্যার। মধ্যপ্রদেশের ধর থেকে পাঁচশো কিলোমিটার হেঁটে এসে। তেলঙ্গনা থেকে ছত্তীসগঢ়ের পথে জাতীয় সড়কের উপর সন্তান প্রসব করেন অনিতা বাই।

Advertisement

ভারতে প্রতি দিন সাতষট্টি হাজারেরও বেশি শিশুর জন্ম হয়। লকডাউনের প্রথম দেড় মাসে জন্মেছে অন্তত তিরিশ লক্ষ শিশু। অবাক পৃথিবীতে জন্ম এদের, যেখানে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেই। রাজধানীতে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থ আদালতের কাছে আবেদন করেছে, যেন প্রসূতির গাড়িকে ছাড় দেয় পুলিশ, ওই মেয়েরাও যেন আপৎকালীন হেল্পলাইন ব্যবহার করতে পারে।

এ নেহাত বাড়াবাড়ি নয়, এ রাজ্যে বোঝা গিয়েছে। হাওড়ার রেড জ়োন এলাকা থেকে আসা এক প্রসূতিকে ফিরিয়ে দিয়েছিল নীলরতন সরকার হাসপাতাল, বাড়ি গিয়ে শৌচাগারে প্রসব হয়ে নবজাতক মারা যায়। ব্যারাকপুরের বিএন বসু হাসপাতালেও ‘‘এখানে করোনা পেশেন্ট আছে, রাখবে কি না দেখো’’ এমন ভয় দেখালে উনিশ বছরের এক প্রসূতিকে পরিবার নিয়ে চলে আসে। সারা রাত যন্ত্রণার পর আশাকর্মীর পরামর্শে কল্যাণী হাসপাতালে ভর্তির আধ ঘণ্টার মধ্যে তার সন্তান জন্মায়। অথচ এই মেয়েটি ছিল প্রথম প্রসূতি, রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, প্রত্যাশিত সময়ের আগে ব্যথা উঠেছিল তার। তার উপর অ্যাম্বুল্যান্স আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না, ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে আসন্নপ্রসবাকে, বলছেন আশাদিদিরা। ভাইরাসের ভয় এ ভাবে মা-শিশুর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

২৪ মার্চ থেকে ১২ মে, এই সময়ের মধ্যে প্রসূতিকে টিটেনাস ইঞ্জেকশন দেওয়া, প্রেশার মাপা, ওজন মাপা সবই স্থগিত ছিল। তাই ঝুঁকিপূর্ণ প্রসব বাড়ার ভয় থেকে যায়। এই সময়ে শিশুদের টিকাকরণ সবই বন্ধ ছিল। বকেয়া টিকা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত শিশুরাও ঝুঁকিতে।

এখনই উদ্যোগী না হলে কী ঘটতে পারে, সে সম্পর্কে সতর্ক করতে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষজ্ঞরা মনে করাচ্ছেন আফ্রিকায় ইবোলা মহামারির কথা। সেখানে ইবোলা ভাইরাসে ১১ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন, কিন্তু বাড়িতে প্রসব এবং অন্যান্য কারণে এক লক্ষ কুড়ি হাজার প্রসূতিমৃত্যু ঘটেছিল। টিকাকরণ ব্যাহত হওয়ায় বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল মাম্পস, হাম, রুবেলা। সে দিন আফ্রিকার আক্রান্ত দেশগুলোতে মা ও শিশুর জীবনে এই বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী ছিল না, তা ঘটেছে কারণ তা আটকানো হয়নি। এখন ভারতে যেমন ঘটছে শকুন্তলা, অনিতার রাস্তার ধারে প্রসব। ওদের কী হবে, তা কেউ ভাবেনি, তাই ওদের এমন হল।

আজ অগণিত স্তব্ধ ইটভাটায়, বন্ধ কারখানা চত্বরে, গাছতলায়, জাতীয় সড়কের ধারে একফালি রুক্ষ জমিতে জন্ম নিচ্ছে কত গল্প। কত ভাষায়, কত উচ্চারণে, কত না আধা-অন্ধকার ঘরে সে গল্পেরা গুনগুন করবে, ‘‘তার পর তো আমি গাছটা ধরে বসে পড়লাম, তুই এলি, তোকে সবে দুধ দিচ্ছি আর কে যেন বলল, চল চল, পুলিশের গাড়ি এসে যাবে, আমি তোকে কোলে নিয়েই হাঁটা দিলাম ..।’’ সেই গল্প দিয়ে এই শিশুরা চিনবে তাদের উত্তরাধিকার, এই ভারতবর্ষকে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement