প্রদ্যুম্নের শেষকৃত্যে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তার পরিবারের সদস্যেরা। ছবি: পিটিআই।
গুরুগ্রামের রায়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের এই ভয়াবহ ঘটনা গোটা দেশকে চমকে দিল। স্কুলের শৌচালয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া গেল প্রদ্যুম্নকে। ক্লাস টু-য়ের ছাত্র, মাত্র সাত বছর বয়স। এই রক্ত, এই হত্যা, এই বীভৎসতায় আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আরও এক বার। এ রকমও হয়?
বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল, সেটা জানা গেল, রহস্য যখন পরতে পরতে খুলল। প্রকাশ পেল, মৃত্যুর আগে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল ওই শিশু। শিকার হয়েছিল বিকৃতরুচি এক ব্যক্তির যৌন লালসার। বিস্ময়ের এখানেও শেষ হয়নি। কারণ, ওই ব্যক্তি ছিল প্রায় অভিভাবক, প্রাত্যহিক যাতায়াতের সঙ্গী, স্কুলবাসের হেল্পার। নিত্যনৈমিত্তিক যাত্রায় যার দুটো হাত প্রতি দিনই বাচ্চাদের তুলে নেয় বাসে অথবা নামিয়ে দেয় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। অভিজ্ঞেরা জানেন, ওই হাত কতটা নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের হয়।
সেই নিশ্চিন্ত আশ্রয়, নিশ্চিন্ত বিশ্বাসের, নিশ্চিন্ত আস্থার লোক এমনটা করতে পারে এ কথা ভেবে শিউরে উঠছি আমরা এখন। শিউরে উঠছি কারণ, বাস্তবের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকছি আমরা বহু দিন। অবিশ্বাস করেছি আমারই শিশুর কণ্ঠকে। কার্পেটের তলায় লুকোতে চেয়েছি ক্রমাগত ঘটে যাওয়া এক আশ্চর্য বিকৃতিকে। ২০০৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের মহিলা ও শিশুবিকাশ মন্ত্রকের উদ্যোগে একটা সমীক্ষা চালানো হয়েছিল গোটা দেশ জুড়ে। চমকে দেওয়া তথ্য উঠে এসেছিল সেই সমীক্ষায়। দেশের ৫৩ শতাংশ শিশু, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে, যৌন নিপীড়নের শিকার এবং কিমাশ্চর্যমতঃপরম, জানা গেল, নিপীড়কদের অধিকাংশই কাকা-পিসে-জ্যাঠা-মামা অথবা আত্মীয়বৎই। অর্থাৎ যার কোলে নিশ্চিত আশ্রয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিল ওই শিশু, নিপীড়ন হয়েছে তারই হাতে এবং হয়ত বা অতি ঘনিষ্ঠ বৃত্তে গুরুজনদের কাছে বলারও চেষ্টা করেছে সে। প্রাচীন সভ্যতার স্বপ্নে বিভোর, অধুনালুপ্ত যৌথ পরিবারের ইতিহাস বর্ণনায় বুঁদ আধুনিক এই বাবা অথবা মা উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করে এসেছেন শিশুর এই আধো উচ্চারণকে।
আমরা সবাই দায়ী আজ এই মুহূর্তে রায়ান ইন্টারন্যাশনালের প্রদ্যুম্নের মৃত্যুর জন্য। বিপদঘণ্টা যখন বেজেছে তখনও আমরা সতর্ক হইনি। বিশ্বস্ত হাতে এক শিশুর যৌন নিপীড়নের ঘটনা যখন ঘটছে, তখন তার শরীর এবং তার চেয়েও বেশি তার মনের উপর কী বিপুল অভিঘাত চলেছে সে কথা আমরা বুঝিনি অথবা বুঝতে চাইনি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই পৃথিবীকে জঞ্জালমুক্ত করার কাব্যিক অঙ্গীকার নিয়ে চলেছি আমরা দীর্ঘ দিন। কিন্তু সেই প্রজন্মের মূলগত বেদনা কোথায় সেটা না বুঝেই।
রায়ান ইন্টারন্যাশনালের ঘটনা হিমশৈলের একটি চূড়ামাত্র। যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সর্বগ্রাসী এক সমস্যার। আসলে এটা বিপদঘণ্টি। শিশু এবং যৌন নিপীড়ন গোটা বিশ্ব তথা ভারত জুড়ে এক জ্বলন্ত সমস্যা। আমরা নজর দেবো এ বার?