নাচনিদের খবর রাখেন ক’জন

পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতির আঙিনায় এই নাচনিদের অবদান অনস্বীকার্য। ঝুমুর, ছো, নাচনি, টুসু ও ভাদু এ অঞ্চলের লোক সংস্কৃতির অঙ্গ। নাচনির নাচ ও গানই ঝুমুরকে তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে। কিন্তু কেমন থাকেন সেই নাচনিরা। লিখছেন ভাস্কর বাগচীউনিশ শতকের কলকাতায় বাবু বিলাসের মধ্যে দিয়ে বাগানবাড়িতে মনোরঞ্জনের জন্য শুরু হয়েছিল বাইজি প্রথা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৯ ০১:২৭
Share:

রাজা লক্ষ্ণণ সেনের সভাকবি ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ জয়দেব। তাঁরই কলমপ্রসূত ‘গীতগোবিন্দ’। শোনা যায়, কবি জয়দেবের স্ত্রী পদ্মাবতী তাঁর গানের সঙ্গে নাচতেন। মনসামঙ্গলের নায়িকা চরিত্র চাঁদ সওদাগরের পুত্রবধূ বেহুলা ছিলেন নৃত্যগীত পটীয়সী। মনসামঙ্গলে লেখা হয়েছে— ‘দেবতা সভায় গিয়া/ মৃদঙ্গ লইয়া/ নৃত্য করে বেহুলা নাচনি’। চর্যাপদ থেকে জানা যায়, সিদ্ধাচার্যদের সাধনসঙ্গিনী ডোমনী, চৌষট্টি পাপড়ি পদ্মদলমণ্ডলে নেচে উঠতেন। তাঁর সঙ্গে নেচে উঠতেন কাহ্নপাদ, শবরপাদ, ভুসুকপাদ প্রভৃতি পদকারবৃন্দ। এই শতাব্দীর রাঢ়বঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে ঝুমুর গানের মধ্যে দিয়ে প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তবে মধ্যযুগে মানুষের কাছে নৃত্যগীতের কদর ছিল। নৃত্যগীত পটীয়সীরা সমাজে ব্রাত্য ছিলেন না।

Advertisement

উনিশ শতকের কলকাতায় বাবু বিলাসের মধ্যে দিয়ে বাগানবাড়িতে মনোরঞ্জনের জন্য শুরু হয়েছিল বাইজি প্রথা। নৃত্যগীত পটীয়সী সুন্দরী নারীরাই আসরে ‘বাইজি’ নামে পরিচিত ছিলেন। উল্টো দিকে, তৎকালীন বিহারের জমিদার শ্রেণি আশ্রিত তথাকথিত নিম্নশ্রেণির গ্রাম্য নৃত্যগীত পটীয়সী নারীদের পরিচয় ছিল ‘নাচনি’। অনেক সামন্ত রাজা ও জমিদার নাচনি ‘রাখা’ আভিজাত্যের প্রতীক বলে মনে করতেন।

চলতি কথায় বলা হত, নাচনিরা যেন ঝিঙেফুলের মতো। সাঁঝে ফোটে আর সকালে মলিন হয়ে যায়। ‘রসিক নাগর’ এই রাধারানিদের বড় মান্যির লোক। ‘ঝুমুরিয়া’ হওয়ার লক্ষ্যেই রসিকের জীবনে সাধনসঙ্গিনী প্রয়োজন। বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে এই ‘সাধনা’ হয় না। তাই তাঁর স্ত্রী থাকেন বাড়িতে। সন্তানপালন করেন। রসিক বাইরে খুঁজে নেন অকূল পাথারে ভেসে আসা নারীকে। যে নারী তাঁর ঝুমুরের ভাব ও সুরকে নেচে গেয়ে প্রাণবন্ত করে তোলেন ছন্দে, লাস্যে, কটাক্ষে, মুদ্রায়। নাচ আর গলায় ঝুমুর বেঁধে রসিকের ঝুমুরিয়া কল্পনাকে জীবন দেন। রসিকের সঙ্গে রসিকের ঘরেই বাস করেন নাচনিরা। কিন্তু এয়োতির চিহ্ন ধারণ করলেও এ সমাজের একটা বড় অংশ নাচনিদের সামাজিক স্বীকৃতি দেয় না। তবু ওঁরা ঘর বাঁধতে চান। ওঁদের ঘরের উঠোনে থাকে তুলসি-মঞ্চ। আর মনসার থান। মেটে রান্নাঘরের 'চুলহা'-র পাশে বসে রান্না করেন আর পাঁচ জন ঘরনির মতো। কিন্তু সেই মেয়েই যখন আসরে নামেন, তাঁকে চেনে কার সাধ্য!

Advertisement

পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতির আঙিনায় এই নাচনিদের অবদান অনস্বীকার্য। ঝুমুর, ছো, নাচনি, টুসু ও ভাদু এ অঞ্চলের লোক সংস্কৃতির অঙ্গ। নাচনির নাচ ও গানই ঝুমুরকে এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে। কিন্তু পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম কিংবা ছোটনাগপুরের একাধিক অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই নর্তকীরা আজও ভারতীয় নৃত্য পরম্পরার আঙ্গিকে ব্রাত্য।

রাজ দরবারের অভাবে আজ নাচনি নাচের আসর বসে হ্যাজ়াকের আলোয় প্রান্তিক গ্রামগুলোর পাথরের চাটানে কিংবা গ্রাম্য মেলায়। সম্ভ্রান্ত বাড়ির ভদ্র মহিলারাও দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকেন। কিছুদিন আগেও আসরের একপাশে বাঁশ পুঁতে, উপরে খাটিয়া বেঁধে মাচা করা হত। তাতে ওঠার মই থাকত। পর্দার আড়ালে থাকা মহিলাদের পৃথক ভাবে রস আস্বাদনের জন্য মশারি টাঙানো হত অভিনব কায়দায়। আজ আর তার প্রয়োজন হয় না।

সব নাচনি কিন্তু প্রচারের আলো পাননি। যৌবনের দিনগুলো কালের নিয়মে সায়াহ্নে ঢলে পড়ে। নাচনি নাচগানে অক্ষম হলে ভিক্ষাই কার্যত তাঁর বৃত্তি হয়ে দাঁড়ায়। ব্যতিক্রম সিন্ধুবালা দেবী, পুস্তুবালারা। প্রয়াত নাচনি সিন্ধুবালা দেবী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লালন পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০০৩ সালের পুরুলিয়া জেলা বইমেলায় তৎকালীন জেলাশাসক দেবপ্রসাদ জানা শাল, শাড়ি ও অন্য উপহারের ডালি দিয়ে সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন সিন্ধুবালাকে। নব্বই অতিক্রান্ত বৃদ্ধার কণ্ঠে সে দিন শোনা ঝুমুর 'নম নারায়ণ...' এক কথায় ছিল অনবদ্য।

মহেশ্বর মাহাতো ছিলেন সিন্ধুবালার রসিক, মালিক ও স্বামী। এই পুরুলিয়া অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন নাচনি পস্তুবালা, মালাবতী, কলাবতী, পুষ্পা, বিমলা, গীতারানি, রাজবালা ইত্যাদি প্রায় ৫৪ জন নাচনি। পস্তুবালাও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘লালন পুরস্কার’ পেয়েছেন ২০১৮ সালে। পস্তুবালার মুখেই শোনা গিয়েছিল ছোটবেলা থেকে ওঁর জীবন যন্ত্রণার কথা, যা প্রায় প্রতিটি নাচনির জীবনেই প্রতীকী সমস্যা। ওঁর কাছেই শোনা গিয়েছিল, ওঁদের মৃতদেহ সংস্কারের প্রচলিত প্রথার কথা। চিল-শকুন-শেয়াল-কুকুরের হাতে মৃতদেহ ছেড়ে দিলে মৃতার তথাকথিত পাপের নাকি প্রায়শ্চিত্ত হবে!

এ সব জানা সত্ত্বেও লোকসঙ্গীত ভালবেসে আজকের দিনেও প্রান্তিক গ্রামের দুঃস্থ পরিবারের মেয়েদের একাংশ নাচনি বৃত্তি গ্রহণ করেন। মনে পড়ছে অখ্যাত গাঁয়ের নাচনি সুমিত্রার উপলব্ধির কথা— ‘‘সিন্ধুবালা মর‍্যে বাঁচেছে, আর আমরা যারা বাঁচে মর‍্যে আছি তাদের খবর কে রাখ্যে?’’

লেখক পুরুলিয়ার সংস্কৃতিকর্মী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement