উইনস্টন চার্চিল মনে করতেন, শ্বেতাঙ্গরাই শ্রেষ্ঠ। এ জন্য তাঁর কোনও লজ্জা ছিল না। তিনি বার বার উপনিবেশের মানুষের উপর নৃশংসতা সমর্থন করেছেন, যে কোনও ভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে চেয়েছেন। তা বলে তাঁর জন্যই বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, এমন নয়।
বাংলার দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্রে চার্চিলের মূল ভূমিকা ছিল ভারতে চাল আমদানি বন্ধ করা। চালের দাম গরিবের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল। চাল আমদানি হলে মূল্যস্ফীতি কমবে ভাবা হলেও চার্চিল আমদানি আটকে দেন। দুর্ভোগ তীব্র করেছিল এই নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু দুর্ভিক্ষের মূল কারণগুলো আলাদা।
সম্প্রতি কিছু বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার ফলাফল অমর্ত্য সেনের ‘পভার্টি অ্যান্ড ফেমিন’ (১৯৮০) বইয়ের দাবি সমর্থন করেছে। তা এই যে, দুর্ভিক্ষের সময় বাংলায় চালের অভাব ছিল না। উৎপাদনে ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও চালের দাম নাগালের বাইরে চলে গেল, কারণ খোলা বাজারে চাল আসতে দেওয়া হয়নি। কেন বিপুল পরিমাণ চাল খোলা বাজার থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল? আর কে-ই বা তার জন্য দায়ী— এগুলোই হচ্ছে ইতিহাসের কঠিন প্রশ্ন।
বাংলার বাজারে প্রথম ত্রাসের সঞ্চার হয় ১৯৪২-এর গোড়ায়। ব্রিটিশ সরকার ভয় পায়, জলপথে বাংলার উপকূলে এসে জাপানি সৈন্য স্থলপথে কলকাতা আক্রমণ করবে। তাদের হাতে যাতে চাল না পড়ে, সে জন্য ‘অতিরিক্ত চাল’ সরানো শুরু হল, পুড়িয়ে দেওয়া হল খেত। সরকারি আমলা, সেনাবাহিনী ও চাল-ব্যবসায়ী মিলে চাল মজুত করা শুরু হল। জাপানি আক্রমণ আটকাতে বাংলার পরিবহণ-কাঠামোকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেওয়া হল। এক দিকে বাজার থেকে চাল তুলে নেওয়ার তৎপরতা, অন্য দিকে মানুষের আতঙ্ক, দুইয়ে মিলে শুরু হয় ভাতের জন্য হাহাকার।
১৯৪২ সালের অগস্টে বাংলার প্রধানমন্ত্রী গভর্নরকে লেখেন, চালের অভাবে রাজ্যে অনাহার-পরিস্থিতি শুরু হয়েছে। মূল্যস্ফীতির চক্রটা ঘোরাতে শুরু করেছিল সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধের নীতি। পূর্ব ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষ নিশ্চিহ্ন হওয়ার মূলে ছিল যুদ্ধের হিসেব। এই সবের একমাত্র হেতু চার্চিল নন।
যখন বাজার থেকে চাল উধাও হয়ে যাচ্ছিল, সেই সময়েই কিন্তু যুদ্ধের উপাদান জোগান দিয়ে কলকাতায় বিপুল মুনাফা করছিল কিছু শিল্প। এদের কল-কারখানার শ্রমিক সংখ্যাও বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। চালের দাম দ্রুত বাড়লে এই শ্রমিকদের কী করে ধরে রাখা যাবে, তাই নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছিল মালিকদের। তাঁদের মধ্যে ব্রিটিশ ও ভারতীয়, দু’রকম শিল্পপতিই ছিলেন, অনেকেরই যথেষ্ট প্রভাব ছিল দিল্লির দরবারে। প্রাদেশিক সরকার এবং দিল্লির সরকারের সঙ্গে জোট বেঁধে এই স্বার্থগোষ্ঠী এমন এক নীতি তৈরি করে, যাতে বাংলার চালের ভাণ্ডার প্রায় নিঃশর্তে তাদের দখলে আসে। ১৯৪২-৪৩, এই দুই বছর সেনা-পাহারায় বারবার বাংলার গ্রামে গ্রামে গিয়ে চাল সংগ্রহ করা হয়। হয় চাল কিনে সেখানেই জমিয়ে রাখা হত, কিংবা কলকাতায় মজুত করা হত। বিপুল পরিমাণ চাল মজুত করা হল, যাতে চালের দাম বাড়লেও যুদ্ধকালীন উৎপাদন চালু থাকে, নজিরবিহীন হারে মুনাফা চালিয়ে যাওয়া যায়। চাল-সংগ্রহ অভিযানে গ্রামের মানুষের শঙ্কা বাড়ত, চালের দামও লাফিয়ে বেড়ে যেত। অনাহারে মৃত্যুর বৃদ্ধির সঙ্গে এর একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে।
যে কোনও মূল্যে কলকাতায় চাল মজুত রাখতে হবে, এই ধারণায় বিশ্বাস ছিল জে পি শ্রীবাস্তব, জি ডি বিড়লা, নলিনী সরকার, সেই সঙ্গে এডওয়ার্ড বেন্থাল প্রমুখ শিল্পপতিদের। প্রত্যেকেরই কলকাতার শিল্প উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল। সেই সঙ্গে ছিল বাংলার সমাজে শ্রেণি বিভাজন। দুর্ভিক্ষের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী চিত্তপ্রসাদ এক বার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পৈতৃক বাড়িতে যান। মন্বন্তর তখন চরমে। শ্যামাপ্রসাদ মস্ত বাড়ি বানাচ্ছিলেন, তাতে ছিল ধানপূর্ণ দুটি গোলা। মার্কিন সরকারও ব্রিটেনকে চাপ দিচ্ছিল, যাতে কলকাতায় পূর্ণশক্তিতে উৎপাদনের কাজ চালু থাকে, যে কোনও মূল্যে।
সেই মূল্য চোকাতে গিয়ে বাংলার অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ল, জিনিসের দাম হল আকাশছোঁয়া আর গ্রামের অসংখ্য গরিব মানুষ অনাহারে মরতে থাকল। যুদ্ধজয় আর মুনাফা, এই দুটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে দরিদ্র মানুষের চরম দুর্দশাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হল। এ কিন্তু কোনও এক জনের তৈরি নীতি নয়। যদিও এই নীতিকে চিনতে সাহায্য করে কিছু মুখ, আর সেই মুখগুলোও সব শ্বেতাঙ্গদের নয়।
এই জন্যই শুধুমাত্র চালের আমদানি, আর চার্চিলের ভূমিকায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলে ভুল হয়ে যায়। যে সব আগ্রাসী কৌশল চালের দাম মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে গিয়েছিল, তার প্রবক্তাদের কার্যত বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়। হ্যাঁ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসত আমদানি হলে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা নয়।
বিষয়টার প্রতি আজ মনোযোগী হওয়া ভাল, কারণ আজকের ভারতেও কিছু শিল্পপতি পরিবার সরকারের উপর অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এমন অনেকেই ফুলেফেঁপে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, যুদ্ধের সুযোগে শিল্পের বাড়বাড়ন্ত হয়। তাদের সে দিনের আকাশছোঁয়া লাভের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এই মন্বন্তর। চার্চিলের নিশ্চয়ই দায় ছিল, কিন্তু তা গোটা ছবির একটি অংশ-মাত্র।
আবেগপ্রসূত ‘সরল ইতিহাস’ ভুলে যায়, সংগঠিত হিংসা কত জটিল, দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। তাতে সেই হিংসার প্রবক্তাদের সুবিধে করে দেওয়া হয় না কি?
কানাডার রায়ার্সন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক