১৯৩১ সালে ‘আ হ্যাংগিং’ নামে একটি ছোট গদ্যে জর্জ অরওয়েল বর্মার (এখন মায়ানমার) এক ফাঁসির আসামির বর্ণনা দেন। ছোটখাটো রোগা শরীর, মাথা মুড়োনো আর এক জোড়া অবিশ্বাস্য রকমের বড় গোঁফ। ছ’জন লম্বা ভারতীয় সেপাই, এক ইংরেজ সুপারিনটেন্ডেন্ট, এক ছোকরা ‘ইউরেশিয়ান’ এবং আরও কিছু লোক যখন আসামিকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, অরওয়েল হঠাৎ লক্ষ করেন, লোকটি রাস্তায় জমে থাকা জল এড়াতে একটু সরে হাঁটলেন। সেই মুহূর্তে আচমকাই এই মৃত্যুদণ্ডের অন্য একটা দিক ধরা পড়ল অরওয়েল-এর চোখে। মনে হল, এই লোকটি মারা যাচ্ছেন না। এটি নিছকই একটি হত্যা। এর পিছনে আইনের অনুমোদন আছে ঠিকই, কিন্তু এই লোকটি, তাঁর সঙ্গের অন্যদের মতোই, একটি জলজ্যান্ত সুস্থ মানুষ। ওই জল এড়িয়ে হাঁটার মধ্যেই এই ফাঁসির মঞ্চের ‘আয়রনি’টুকু ধরা আছে।
এই ছোট, কিন্তু উজ্জ্বল গদ্যটি মনে পড়ল সাম্প্রতিক কিছু বিতর্কের সূত্রে, বিশেষত আনন্দবাজার পত্রিকায় অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের কিছু লেখা (৯-৫ ও ৬-৬) ঘিরে। দিল্লি গণধর্ষণের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট যে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছেন, সেই সূত্র ধরে তিনি কিছু জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন মৃত্যুদণ্ডের নৈতিকতা নিয়ে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, অরওয়েল-এর সমালোচনাও মূলত নৈতিক, প্রশ্নটা তাঁর কাছেও ফাঁসির যৌক্তিকতা নিয়ে। এর সঙ্গে অরওয়েল আর একটি বিষয়েও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন— খুব উচ্চকিত ভাবে না বললেও, বিভিন্ন খুঁটিনাটির বর্ণনার মাধ্যমে আমরা এই ঘটনার একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের সামনে এসে দাঁড়াই। এই ইতিহাস ফাঁসির এবং ফাঁসির নৈতিকতার, এই ইতিহাস ঔপনিবেশিক শাসনের।
নৈতিকতার এই ইতিহাসটা মৃত্যুদণ্ডের আলোচনায় জরুরি। ঔপনিবেশিক শাসন এবং তার যাথার্থ্য দাঁড়িয়ে আছে অষ্টাদশ শতাব্দীর দার্শনিকতার ভিত্তিতে। একাধিক ইউরোপীয় দার্শনিক উপনিবেশ স্থাপনকে শুধু ভাল মনে করতেন না, তার প্রয়োজনীয়তা নিয়েও খুবই উৎসাহী ছিলেন। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে এই দার্শনিকরাই আবার ফাঁসির সপক্ষেও সওয়াল করেছেন। জন লক এবং ইমানুয়েল কান্ট-এর নাম এ ক্ষেত্রে স্মর্তব্য। ঔপনিবেশিক শাসকরা যখন এ দেশে এলেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে, তাঁরা যে নতুন আইনব্যবস্থার কথা ভাবলেন, তারও মূল ভিত্তি এই দার্শনিক চিন্তা। এর সঙ্গে এই শাসকরা এ দেশের আইনব্যবস্থা নিয়েও খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। এর ফসল প্রথম দিকের কিছু কাজ— হ্যালহেড-এর ‘আ কোড অব জেন্টু ল’জ (১৭৭৬), উইলিয়াম জোন্স-এর ‘ইনস্টিটিউট্স অব হিন্দু ল’ (১৭৯৪) এবং কোলব্রুক-এর ‘আ ডাইজেস্ট অব হিন্দু ল’ (১৭৯৬-৮)। এখানে একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, ঔপনিবেশিক শাসকরা দেওয়ানি আইনের ক্ষেত্রে নানা রকম খোঁজাখুঁজি করেছিলেন, কিন্তু ফৌজদারি আইনের ক্ষেত্রে চলতি আইনকেই মান্য বলে মনে করেছিলেন আর সেটাই কাজেও লাগিয়েছিলেন। সেই আইনে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল, আর তাই নতুন আইনেও তা বহাল রইল।
এর সঙ্গে আর একটি ইতিহাসও মনে রাখা দরকার। ফরাসি তাত্ত্বিক মিশেল ফুকো দেখিয়েছেন যে, ১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে আমরা যাকে আধুনিক আইনব্যবস্থা বলি, তার জন্ম হয় ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায়। এর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে শাস্তিদানের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি। ফুকো-র মতে, এই নতুন শাস্তির সবচেয়ে বড় লক্ষণ হল এর গোপনীয়তা— আগে যেখানে জনসমক্ষে ফাঁসি হত, এ বার সেটাই হতে লাগল লোকচক্ষুর আড়ালে। অপরাধীর কাছে দুটি জিনিস মূলত উঠে এল এই নতুন ব্যবস্থায়— এক, এই গোপন শাস্তি, আর দুই, এক নতুন শাসনব্যবস্থা, যেখানে সবাইকেই সারা ক্ষণ চোখে চোখে রাখা হচ্ছে। ফুকো এই নতুন ব্যবস্থাটির ব্যাখ্যা করেন জেরেমি বেন্থাম-এর বলা ‘প্যানঅপটিকন’ দিয়ে— এমন একটি জেলখানা যেখানে প্রতিটি অপরাধী কী করছে না করছে, তা চাইলেই দেখা যাবে। মজার কথা হল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম প্যানঅপটিকন জেলখানা স্থাপিত হয়েছিল আমাদের দেশের পুণে-তে। অর্থাৎ এই নতুন শাস্তিদানের প্রক্রিয়াতেও ঔপনিবেশিক শাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েই গেল।
আমরা যখন ফাঁসির মাধ্যমে একটি তুলনা টানতে চাই, যখন বার বার বলি জঘন্য অপরাধের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, আমরা এই ইতিহাসের তৈরি করে দেওয়া পথেই হাঁটি। অরওয়েল-এর চরিত্রগুলোর মতোই আমরা একটা অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হই, যেখানে ফাঁসি ন্যায়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, আর আমরা নতুন নতুন যুক্তি খুঁজতে থাকি মৃত্যুকে আইনের শাসন বলে প্রতিপন্ন করতে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতটি মাথায় রাখা ভাল।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক