Immigration policy

দুয়ার আগলানোর আমেরিকা

ইংল্যান্ড থেকে আসা অভিবাসীদের হাতে আমেরিকার পত্তন: তবু এই দেশে অভিবাসন-বিরোধিতার ইতিহাস বেশ লম্বা।

Advertisement

সারণ ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২০ ০০:০১
Share:

১৮৮০-র দশকে বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে স্ট্যাচু অব লিবার্টি মূর্তিটি আমেরিকাকে উপহার দেয় ফ্রান্স। মূর্তিটির পাদদেশে খোদাই করা আছে এমা ল্যাজারাস নামে এক সমাজসেবীর লেখা কবিতা, যা বিশ্বের দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, হতভাগ্য জনগণকে আহ্বান করে এই ‘স্বর্ণদুয়ার’ দিয়ে প্রবেশ করে নতুন দেশে স্বাধীনতার ছত্রচ্ছায়ায় নতুন জীবন গড়ে তোলার জন্য। কথাটা মনে পড়ছে এই বারের আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে, যখন অভিবাসীদের কেন্দ্র করে দেশটা প্রায় দ্বিখণ্ডিত হওয়ার জোগাড়।

Advertisement

গত কয়েক বছরে বহু দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, হতভাগ্য অভিবাসীর হাতে পড়েছে হাতকড়া, আশ্রয় জুটেছে কারাগারে, শিশুদের পরিবার থেকে আলাদা করে পাঠানো হয়েছে বহু দূরের কারাশিবিরে। অথচ এখনও কিন্তু আইন অনুযায়ী শরণার্থীদের বিদেশের সীমান্তে এসে আশ্রয় চাওয়া সম্পূর্ণ আইনসঙ্গত।

ট্রাম্প সরকারের অভিবাসন নীতিটি নির্দয়তার দিক থেকে তুলনাহীন। ২০১৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন পাওয়ার অভিযান শুরু করেন মেক্সিকো থেকে আসা অভিবাসনকারীদের অপরাধী, মাদক কারবারি, ধর্ষক বলে চিহ্নিত করেই। দাবি ছিল, প্রেসিডেন্ট হলে তিনি মেক্সিকো সীমান্ত বরাবর এক বিশাল দেওয়াল তুলবেন বেআইনি অভিবাসন রোখার জন্য। ২০১৬ সালে ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে, তিনি এ দেশে মুসলমানদের ঢুকতে দেবেন না। প্রসঙ্গত, আমেরিকায় ধর্মবৈষম্য এখনও সম্পূর্ণ বেআইনি।

Advertisement

প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরই তিনি নির্দেশ দেন পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু মুসলিম-প্রধান দেশের নাগরিকদের আমেরিকায় প্রবেশ আটকাতে। দুই দিনের মধ্যেই প্রবল প্রতিবাদ ও মানবাধিকার গোষ্ঠীর আনা মামলার জেরে আদালতের আদেশে এই নীতি বাতিল হয়। সেই দু’দিনের মধ্যে দেশে বিদেশে বিভিন্ন বিমানবন্দরে হাজার হাজার আমেরিকাগামী যাত্রী আটক হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েন। ট্রাম্প সরকার এর বিরুদ্ধে দেশের শীর্ষ আদালতে আপিল করলে আদালতের রায় দাঁড়ায় যে, এই আদেশ জাতীয় সুরক্ষা ও সন্ত্রাসবাদ রোখার ক্ষমতার অন্তর্গত।

কোভিড-অতিমারির অর্থনৈতিক ক্ষতির যুক্তিতে কর্মসূত্রে অভিবাসন বন্ধ করেছেন ট্রাম্প। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস অনলাইন হলে তাদের দেশে ফেরত গিয়ে পড়াশোনা করতে আদেশ দিয়েছেন, যদিও দেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্টেট গভর্নমেন্ট একে অন্যায্য এবং অসাংবিধানিক বলে বাতিল করেছে।

ইংল্যান্ড থেকে আসা অভিবাসীদের হাতে আমেরিকার পত্তন: তবু এই দেশে অভিবাসন-বিরোধিতার ইতিহাস বেশ লম্বা। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আমেরিকার রেলব্যবস্থার পত্তন হয় চিন থেকে আসা শ্রমিকদের হাতে। তাঁদের বিরুদ্ধে শ্বেতকায় শ্রমিকরা হিংসাত্মক আক্রমণ শুরু করেন, সরকারও নানা কড়াকড়ি শুরু করে। ১৮৮২ সালে ফেডারাল আইন পাশ করে চিনা অভিবাসন বন্ধ হয়।

বিশ শতকের প্রথম থেকেই অভিবাসন-বিরোধী প্রচার জোরদার হয়। কেউ বলেন, অভিবাসনের কারণে চাকরির টানাটানি হবে, কেউ বলেন, বিদেশি প্রভাবে মার্কিন সংস্কৃতির সর্বনাশ হবে, কেউ বলেন, অভিবাসীরা স্বভাবতই অপরাধী— দেশের আইনশৃঙ্খলা রসাতলে যাবে। রুশ বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক জুজুর ভয় বাড়তে থাকে, ১৯২৪ সালে জনসন-রিড আইনে অভিবাসনের ওপর কঠিন বাধা তৈরি হল। বর্ণবৈষম্য খুবই প্রকট ছিল এতে।

১৯২০ থেকে ষাটের দশক অভিবাসনের ক্ষেত্রে ছিল কড়াকড়ির যুগ। ত্রিশের দশকে ইহুদি শরণার্থীদের জাহাজ ফিরিয়ে তাঁদের নাৎসিদের হাতে ফেরত পাঠানো হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি অভিবাসীদের মার্কিন নাগরিকত্ব থাকলেও জাতীয় সুরক্ষার নামে অন্তরিন করা হয়। পঞ্চাশের দশকে আইজ়েনহাওয়ার সেনাবাহিনী দিয়ে মেক্সিকান অভিবাসীদের দেশান্তরিত করেন।

ষাটের দশকে বর্ণবিদ্বেষবিরোধী ও প্রগতিশীল আন্দোলনের ফলে এল বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন। ১৯৬৫ সালের আইনে সব দেশের নাগরিকদের আমেরিকায় অভিবাসনের জন্যে সমানাধিকার দেওয়া হল। এই সময় থেকেই সে-দেশে ভারত তথা এশিয়ার অভিবাসী-সংখ্যা বাড়তে থাকে। আবার ১৯৯০-এর দশকে অতি-দক্ষিণপন্থী মহলে উদার অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির ধারা শক্তিশালী হতে থাকে, যার সঙ্গে যুক্ত হয় ৯/১১-পরবর্তী ইসলামবিরোধিতা। মেক্সিকোয় মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অপরাধ ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়েও শঙ্কা বাড়তে থাকে।

ঠিকই, গত তিন দশকে আমেরিকায় চাকরির সংখ্যা কমেছে, দারিদ্র বেড়েছে। তবে এর বেশিটাই বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফল: অভিবাসনের ফল নয়। আর, ট্রাম্পই যে অভিবাসন নিয়ে প্রথম কড়াকড়ি করছেন, তা-ও নয়। কিন্তু স্পষ্টতই তাঁর মতো এতটা খোলাখুলি বিদ্বেষমূলক ভাষা আর কেউ ব্যবহার করেননি। লক্ষণীয়, ২০১৬ সাল থেকে আমেরিকায় জাতি-বর্ণ-ধর্মের ভিত্তিতে হিংসাত্মক ঘটনার সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ও-দেশের মানুষ কী ভাবছেন, তা হয়তো কিছুটা বোঝা যাবে পরের মাসেই, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement