ছাতনা রাজপরিবারে যে দুর্গাচালা রয়েছে, তা হুবহু মল্লেশ্বরী মৃণ্ময়ীদেবীর মতো।
সামন্তশাসিত সে দিনের ‘ছত্রিনা’ আজকের ছাতনা। বাঁকুড়ায় ‘ক্ষত্রিয়’ শব্দটির লোকমুখে উচ্চারণ ছিল ‘ছত্রি’। কোনও রাজপরিবারের সঙ্গে কুলদেবতা বা দেবীর সম্পর্ক থেকেই যায়। সামন্তভূম ছাতনা রাজপরিবারের কুলদেবী হলেন বাসলী। জনশ্রুতি, সামন্ত সর্দার শঙ্খ রায় ও তাঁর ছেলেরা ছিলেন বাসলীর বাহক। দেবীর কৃপাতেই তাঁদের রাজপাট, প্রভাব-প্রতিপত্তি। চৈতন্যজীবনীকার বৃন্দাবন দাস ‘চৈতন্যভাগবত’-এ লিখেছেন—‘বাসলী পূজয়ে কেহ নানা উপচারে।’ ছাতনার বাসলী নিঃসন্দেহে শাক্তদেবী। পরম্পরা মেনে এখনও দেবীর রোজের অন্নভোগে না ভেজে রান্না করা মাছ দেওয়া হয়। প্রশ্ন জাগে, পুরোপুরি শাক্তধর্মী একটি রাজপরিবারে আবার দুর্গাপুজোর সূচনা হল কী ভাবে।
সামন্তভূমের পূর্ব সীমায় মল্লভূম। রাজ্যের সীমা নিয়ে দুই ভূমের মধ্যে বিবাদ প্রায়ই লেগে থাকত। তার ওপর কী কারণে বাসলীর পূজারী কবি বড়ু চণ্ডীদাস সামন্তভূম থেকে বিতাড়িত হয়ে মল্লভূমে আশ্রয় পেলে পরিস্থিতি আরও ঘোরাল হয়ে ওঠে। বিবাদ চরম আকার নিলে তা থামানোর জন্য এক মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ছাতনা রাজপরিবারের প্রদীপ সিংহদেবের দাবি, আজকের বাঁকুড়া শহরের উপকণ্ঠে দ্বারকেশ্বরের তীরে যে শিব প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন, তার সামনে সেই মৈত্রী চুক্তি হয়েছিল। প্রদীপবাবুর আরও দাবি, দুই রাজার মধ্যে একতা স্থাপনের জন্যই এই শিবের নাম ‘এক্তেশ্বর’, অর্থাৎ একতার ঈশ্বর।
মল্লভূমের সঙ্গে সামন্তভূমের মৈত্রী চুক্তির কারণেই ছাতনা রাজপরিবারে শাক্ত কুলদেবী বাসলীর উপাসনার সঙ্গে দুর্গাপুজোও শুরু হয়। বিষ্ণুপুরের রাজপরিবারের মতো এখানেও জিতাষ্টমীর দিন থেকে পুজো শুরু হয়। নবমী পর্যন্ত প্রতি সন্ধ্যায় সেদ্ধ চাল, মুগ ডাল, দুধ, আখের গুড়, কাঁচা কুমড়ো, ঘি আর পাতিলেবু দিয়ে দুর্গাদালানে রান্না করা ভোগ দেবীকে নিবেদন করা হয়। এই ভোগের নাম ‘গঞ্জভোগ’।
ছাতনা রাজপরিবারে যে দুর্গাচালা রয়েছে, তা হুবহু মল্লেশ্বরী মৃণ্ময়ীদেবীর মতো। এই নিয়মও মৈত্রী চুক্তির প্রমাণবাহী। বাংলায় প্রচলিত দুর্গাপ্রতিমার চালা সাধারণত অর্ধচন্দ্রাকৃতি হয়। এক চালার দুর্গাপ্রতিমায় লক্ষ্মী-সরস্বতীর নীচের দিকে গণেশ-কার্তিকের অবস্থান। কিন্তু মল্লেশ্বরী মৃণ্ময়ীদেবীর চালা চৌকো। চালার উপরে থাকেন বাহন-সহ শিব। দেবীর দু’পাশে লক্ষ্মী-সরস্বতী আর তাঁদের উপরে যথাক্রমে গণেশ-কার্তিক। বিষ্ণুপুর ও ছাতনার দুর্গাচালায় এটি একটি ব্যতিক্রম। এ ছাড়া, মল্লভূমের মৃণ্ময়ীর সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে ছাতনা রাজপরিবারের দুর্গার বাহন সিংহেরও ধরন আলাদা। এই সিংহের গায়ের রং সাদা, কপালে তিলক চিহ্ন। এই সিংহ সর্বদেবময়।
রাঢ় অঞ্চলে দুর্গাপুজো নিয়ে একটি প্রবাদ শোনা যেত—‘মল্লে রা শিখরে পা সাক্ষাৎ দেখবি যদি নদেশান্তিপুরে যা।’ দুর্গাপুজোর সন্ধিক্ষণে মৃণ্ময়ী মন্দিরে কামান দাগার আওয়াজকে ইঙ্গিত করে ‘মল্লে রা’। ছাতনা রাজপরিবারে এখনও দুর্গাষ্টমীর সন্ধিক্ষণে কামানের পরিবর্তে ‘গেঁঠা’ ফাটানো হয়। এ ছাড়াও বেশ কিছু প্রথা ছাতনা রাজপরিবারের দুর্গাপুজোয় চালু রয়েছে। যেমন, ‘ডালা দৌড়’। সন্ধিপুজো শুরুর আগে আশপাশের গ্রামের মানুষজন নতুন ডালায় খই-মুড়কি ইত্যাদি নৈবেদ্য হিসেবে মাথায় বয়ে নিয়ে দুর্গাদালানের সামনে জড়ো হন। এর পরে দৌড়ে যিনি আগে এসে দেবীর সামনে ডালা রাখতে পারেন, তার ডালা সবার আগে দেবীকে অর্পণ করা হয়। এ ছাড়া, বিজয়া দশমীর দিনে নবপত্রিকা-সহ ঘট বিসর্জন অসমাপ্ত রেখে পরিবারের লোকজন তরোয়াল বা খাঁড়া নিয়ে পুকুর থেকে বাসলী মন্দিরের দিকে ছুটে আসেন। এটি ‘খাঁড়া দৌড়’ নামে পরিচিত।
রাজপাট অনেক দিন আগেই গিয়েছে। তবু প্রথা মেনে এখনও পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ মানুষটি একমাত্র পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার অধিকারী। এর পেছনে যুক্তি হল, প্রজাদের কল্যাণ কামনার জন্য রাজার পুষ্পাঞ্জলিই যথেষ্ট। আলাদা ভাবে সাধারণ মানুষ বা পরিবারের অন্য কারও আর পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আবার, দুর্গার পায়ে অঞ্জলি দেওয়ার পরে কুলদেবী বাসলীর পায়েও অঞ্জলি দিতে হয়। উদ্দেশ্য, কুলদেবীকেও সন্তুষ্ট রাখা।
অনেক সাবেক দুর্গাপুজোর মতো ছাতনা রাজপরিবারের পুজোতেও দশমীর সকালে দেবীকে পান্তাভাত, ন’রকমের পদ সমেত চ্যাং মাছের ঝাল নিবেদন করা হয়। প্রতিমা বিসর্জন করা হয় দশমী নয়, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সন্ধ্যায়। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, ছাতনা রাজপরিবারের মানুষজন প্রথা অনুসারে বিসর্জনে যোগ দেন না। পরিবারের নারী-পুরুষদের বিসর্জন দেখাও নিষিদ্ধ। তাই সে দিন সন্ধ্যা থেকে বিসর্জন না শেষ হওয়া পর্যন্ত রাজপরিবারের সকলে ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে রাখেন। রাজার আমলের লাঠিয়াল বাগদি সম্প্রদায় বংশ পরম্পরায় এখনও প্রতিমা বিসর্জনের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
সময়ের স্রোতে রাজপাট হারালেও প্রথা-পরম্পরার কাছে সময় যেন থেমে গিয়েছে।
লেখক বাঁকুড়ার সংস্কৃতিকর্মী