Editorial News

হেলমেট পরিহিত গণতন্ত্র

পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিল পর্ব এত উত্তপ্ত হয়, তা আগে সম্ভবত কারও জানা ছিল না। উত্তাপ যে হেতু রয়েছে, সে হেতু বিপদও রয়েছে। বিপদের হাত থেকে বাঁচতে তাই রক্ষাকবচ খুঁজে নিয়েছে ‘গণতন্ত্র সংহার বাহিনী’।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৩৬
Share:

বাঁকুড়ায় হেলমেট বাহিনী। নিজস্ব চিত্র।

বাইক আরোহীর রক্ষাকবচ হিসেবে তার উদ্ভাবন। কিন্তু পঞ্চায়েতের বাংলায় তার ভূমিকা একটু বদলে গিয়েছে। গণতন্ত্রের সংহারে উদ্যত যাঁরা, বিরোধী দলের লোকজন মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার চেষ্টা করছেন দেখলেই গত কয়েক দিন ধরে যাঁরা রে-রে করে তেড়ে যাচ্ছেন, যাবতীয় বিরোধিতার মাথা ভেঙে দিতে যাঁরা বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছেন, হেলমেট এখন তাঁদের রক্ষাকবচ।

Advertisement

পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিল পর্ব এত উত্তপ্ত হয়, তা আগে সম্ভবত কারও জানা ছিল না। উত্তাপ যে হেতু রয়েছে, সে হেতু বিপদও রয়েছে। বিপদের হাত থেকে বাঁচতে তাই রক্ষাকবচ খুঁজে নিয়েছে ‘গণতন্ত্র সংহার বাহিনী’। রাজ্যের নানা প্রান্তের বিডিও কার্যালয় এবং এসডিও কার্যালয় ঘিরে এই বাহিনীকে অবস্থান করতে দেখা গিয়েছে গত এক সপ্তাহ ধরে। বাহিনীর সদস্যদের হাতে লাঠি বা আগ্নেয়াস্ত্র আর মাথায় হেলমেট। মাথাও বাঁচবে, মুখটাও ঢাকা থাকবে। এক ঢিলে দুই পাখি। সঙ্গে উপরি পাওনা একের পর এক পঞ্চায়েতের অনায়াস দখল।

হেলমেট বাহিনীকে এতটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখব কি না, তা অবশ্য ‘ভেবে দেখা’ দরকার। এই হেলমেট বাহিনীকে মোতায়েন করা হয়েছে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ‘নির্বিঘ্ন’ রাখার জন্যই। রাজ্যের শাসক পক্ষ ‘উন্নয়ন’ বিষয়ে অত্যন্ত ‘সংবেদনশীল’। নির্বাচনী ফলাফলে কোনও ‘অঘটন’ যদি কোনও অঞ্চলে ঘটে যায়, তা হলে সেই অঞ্চলের উন্নয়ন ব্যাহত হবে বলে বর্তমান শাসকরা বিশ্বাস করেন। কারণ বিরোধীর হাতে থাকা গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদের মাধ্যমে উন্নয়ন মূলক প্রকল্প রূপায়ণের কোনও ইচ্ছা যে তাঁদের নেই, শাসককুল তা একাধিক বার বেশ স্পষ্ট করে জানিয়েছেন। তাই সব পঞ্চায়েতকেই নিজেদের হাতে রাখতে চান শাসক দলের নেতারা। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য ‘নিজেদের মতো’ করে ‘নির্বাচন’ করতে চান তাঁরা। সেই প্রক্রিয়ায় ‘বিঘ্ন’ ঘটা একেবারেই কাম্য নয়। অতএব হেলমেট বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, সে কথা বলাই বাহুল্য।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

কিন্তু হেলমেট বাহিনীকে কারা মোতায়েন করলেন, সে নিয়ে কিন্তু একটু সংশয় তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এই বাহিনীকে মোতায়েন করেনি। শাসক দলও বলছে, এই বাহিনী তাদের নয়। তা হলে বাহিনী কার? বিরোধীরা শাসকের দিকেই আঙুল তুলছেন। বাহিনীর তাণ্ডবে যে শাসকের সুবিধা হচ্ছে এবং বিরোধী রক্তাক্ত হচ্ছেন, তা-ও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু শাসক তবু মানতে নারাজ। কোনও জেলায় শাসক নেতা জানাচ্ছেন, ‘উন্নয়ন’ নিজেই নিজের স্বার্থে বাহিনী মোতায়েন করেছে। অন্য আর এক জেলা থেকে শোনা যাচ্ছে, বাহিনী নাকি মোতায়েন করেছেন ‘সাধারণ মানুষ’।

ফল ভক্ষণেই মনোনিবেশ করা জরুরি, বৃক্ষ গণনা অপ্রয়োজনীয়। অতএব বাহিনী কার তা ভেবে সময় নষ্ট করা অনুচিত। বাহিনীর কর্মদক্ষতা যে ‘প্রশংসনীয়’, সে কথাই মাথায় রাখা দরকার। এর আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভোটগ্রহণের দিনে গ্রাম-বাংলা বার বারই রক্তপাত দেখেছে। এ বার কিন্তু হেলমেট বাহিনী ভোটগ্রহণের অনেক আগেই প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছে যে, ভোটগ্রহণের দিনে আর সে ভাবে গোলমাল হবে না। মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর্বেই বহু গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং একাধিক জেলা পরিষদের ফলাফল প্রায় নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। অনেক আসনেই ভোটের প্রয়োজন প়ড়বে না। ফলে ‘বিঘ্ন’ ঘটার প্রশ্নই নেই। যে সব আসনে ভোটগ্রহণ হবে, সেখানেও ‘বিঘ্নের আশঙ্কা’ কমই। কারণ মনোনয়ন পর্বেই অর্ধেক ‘হেরে গিয়ে’ বিরোধী শিবিরের মনোবল তলানিতে। তাই ভোটের দিনে শাসকের নকশায় ‘বিঘ্ন’ ঘটানোর চেষ্টা বিরোধীর তরফে আর খুব একটা যে হবে না, সে-ও বেশ বোঝা যাচ্ছে। হেলমেট বাহিনীর ‘প্রশংসা’ না করে আর উপায় কী তা হলে?

আরও পড়ুন: বিনা ভোটে দখল বীরভূম-বাঁকুড়া

আরও পড়ুন: দিনভর মারধর, বাধা অব্যাহত মনোনয়নে

‘নিন্দুকরা’ শুধু তাণ্ডব দেখতে পাচ্ছেন আর তাণ্ডবকারীদের মাথায় হেলমেট দেখতে পাচ্ছেন। আসলে হেলমেট তো পরানো হল গণতন্ত্রের মাথায়। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন পত্র জমা করার কথা যেখানে, সেই বিডিও কার্যালয় এবং এসডিও কার্যালয়গুলিকে গত এক সপ্তাহ ধরে কার্যত হেলমেটে মুড়ে রাখা হল। এ ক্ষেত্রেও ‘নিন্দুকে’ বলবেন, গণতন্ত্রকে কুক্ষিগত করা হল। কিন্তু একটু ‘উদার’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখলে যে কেউ টের পাবেন, কুক্ষিগত নয়, গণতন্ত্রকে ‘সুরক্ষিত’ করা হল। হেলমেট পরিয়ে গণতন্ত্রকে ‘রক্ষাকবচ’ দেওয়া হল।

যে ভাবে গণতন্ত্রের মাথায় হেলমেট পরানো হল, তাতে কেউ কেউ বলতেই পারেন— গণতন্ত্র নয়, এ হল হেলমেট-তন্ত্র। কিন্তু নাম যা-ই হোক, গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকার যখন হেলমেটে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে, জনতার রায়ে ‘বলীয়ান’ শাসক দল যখন হেলেমেটে সুরক্ষিত বোধ করছে আর হেলমেট না থাকার কারণে যখন রাজ্য নির্বাচন কমিশন অসহায় বোধ করছে, তখন হেলমেটতন্ত্রকেই ভবিতব্য হিসাবে মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement