তিন মাসের গর্ভবতী পিঙ্কি ওরফে মুসকানের গর্ভপাতের খবর পেলাম আমরা। মুসকানের স্বামী রশিদ জেলে। শাশুড়ির অভিযোগ, মুসকানকে ইঞ্জেকশন দিয়ে গর্ভপাত করিয়ে দেওয়া হয়েছে, কেননা মুসকান স্বেচ্ছায় হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে এবং ভালবেসে রশিদকে বিয়ে করেছে।
গত এক দশক ধরে চরম হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি মুসলমান যুবকদের বিরুদ্ধে ‘লাভ জেহাদ’ নামে এক মিথ্যে অভিযোগের গল্প ছড়াচ্ছে। দক্ষিণ ভারতের কেরল, কর্নাটক থেকে, এই মিথ্যা প্রচারের শুরু। এখন এই প্রচার এমন পর্যায়ে যে, এই প্রচারকে কাজে লাগিয়ে দেশের রাজ্য সরকারগুলি আইন প্রণয়নে ব্যস্ত। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ সরকারের প্রহিবিশন অব আন-ল’ফুল রিলিজিয়াস কনভারশন অর্ডিন্যান্স, ২০২০, উল্লেখযোগ্য। মুসলমান পরিচয়ের ছেলেদের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের মেয়েদের প্রেম এবং বিয়ে আটকানোর জন্য এই আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগও শুরু হয়ে গিয়েছে যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে। এই আইনানুসারে, অভিযুক্তের জামিন-অযোগ্য ধারায় দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
মুসলমান যুবকদের অপরাধী প্রমাণ করা এবং জেলে ভরাই এই আইনের প্রধান উদ্দেশ্য। যে দেশে আইন পাশ হলেও তা বছরের পর বছর প্রয়োগ হয় না, পড়ে থাকে, সেখানে এক মাসও হয়নি উত্তরপ্রদেশে এই অর্ডিন্যান্স জারি হয়েছে, এরই মধ্যে উদাহরণের অভাব নেই। সম্প্রতি গোরক্ষপুরে এক দম্পতিকে এই আইনে পুলিশ আটক করে ছেলেটির মুসলিম নাম দেখে। পরে জানা যায়, মেয়েটিও মুসলিম। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি মেয়েটির ধর্ম পরিচয় না জেনেই তাঁদের নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিল! একই ভাবে, হিন্দু মহাসভার এক নেতার অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২ ডিসেম্বর লখনউ শহরে বাইশ বছরের রাইনা গুপ্ত এবং চব্বিশ বছরের মহম্মদ আসিফের বিয়ের আসরে হানা দেয় পুলিশ। মেয়ের বাবা বলেন যে, এ বিয়েতে কোনও ধর্মান্তরণ হয়নি, দুই পরিবারের সম্মতিতে হিন্দু, মুসলমান দুই নিয়মেই বিয়ে হচ্ছে। তথাপি পুলিশ জানায় যে, নতুন আইন অনুযায়ী, পাত্রপাত্রী যদি ভিন্ন ধর্মের হয়, তা হলে দুই পরিবারের মত থাকলেও জেলাশাসকের অনুমতি নিতে হবে। এই কারণে আপাতত তাঁদের বিয়ে রদ হয়ে যায়। প্রত্যেকটি ঘটনাতেই দেখা যাচ্ছে, শাসক দলের নেতাকর্মীরা মুসলিম যুবকদের অপরাধী প্রমাণ করার জন্য পাড়ায় পাড়ায় নজর রাখছেন। আর উত্তরপ্রদেশের গৈরিক পুলিশ তাঁদের অভিযোগের ভিত্তিতে মুসলিম ছেলেদের জেলে পাঠাতে উদ্যোগী হচ্ছে।
মুসলমান যুবকের সঙ্গে হিন্দু নারীর বিয়ে আটকানোর পিছনে ভারতীয় রাষ্ট্রের যে ব্রাহ্মণ্যবাদী কট্টরপনা এখন আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে, তা হল হিন্দু নারীর যৌন-স্বাধীনতার উপর নিয়ন্ত্রণ। হিন্দুত্ববাদী চিন্তায় ইসলামি পুরুষক বিয়ে করলে হিন্দু নারীর পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ হয়। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখাও কঠিন হয়ে পড়ে।
আমাদের রাষ্ট্র যে এমন ইসলাম-বিদ্বেষ ছড়িয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে তার কারণ আমাদের সমাজও ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষকে ঘৃণা করার প্রবণতা দেখা যায়। অনেক তথাকথিত উদার হিন্দু পরিবারেও বাবা-মা সন্তানকে বলেন, “আর যা-ই করো, মুসলমান বিয়ে কোরো না।’’ ঘরের মেয়ের মুসলমান ছেলের সঙ্গে বিয়ে আজও হিন্দু উচ্চবর্ণের মানুষজন পরিবারের সম্মানহানি হিসেবে দেখে।
হিন্দু ছেলে যখন মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে তখন অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিক্রিয়া হয় ভিন্ন। হয়তো মনে করা হয় যে, “একটি মেয়েকে উদ্ধার করা গেল।” প্রচলিত অনেক ভুল ধারণার একটি হল যে, মুসলমান পরিবার মাত্রেই এত রক্ষণশীল যে, তাদের ঘরে মেয়েদের স্বাধীনতা থাকে না। এ কেবল হিন্দু উচ্চবর্ণের ঔদ্ধত্যমাত্র নয়, মুসলমান নারীর স্বাধিকারকেও অস্বীকার।
এই সব মিথ্যা প্রচারের ফলে মুসলমান পরিবারের ছেলেমেয়েদের অবস্থা আজ সঙ্গিন। রশিদের মায়ের দুই ছেলেই আজ জেলে। বাড়ির ছেলেরা গ্রেফতার হওয়ার ফলে পরিবারের রোজগার কমে যাচ্ছে। তার উপর আইন আদালতের খরচ আছে।বাড়ির ছেলেদের জন্য মানসিক দুশ্চিন্তায় বাড়ির সকলে কাঁটা হয়ে আছেন।
হিন্দু রাষ্ট্র হওয়ার জন্য আমরা চালিয়ে যাব এই অবিরাম অত্যাচার। হাথরসে যে এক জন মাত্র সাংবাদিককে জেলে পোরা হয়েছে, তিনি মুসলমান। মিথ্যে অভিযোগের দায়ে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে বহু মুসলিম ছেলেকে জেলে পোরার যে কৌশল সরকার নিয়েছিল, তা অনেকাংশেই ব্যর্থ— অনেকেই বেকসুর খালাস পাচ্ছেন। তাই এখন আরও ধূর্ত চাল চেলেছে বিজেপি: হিন্দু মেয়েদের সুরক্ষার ছলে মুসলমান পুরুষদের জেলে ভরো।
শুধু অন্যায় নয়, দেশের গণতান্ত্রিক সংবিধানকে সম্পূর্ণ অমান্য করা হচ্ছে এতে। নাগরিকের ইচ্ছেমতো ধর্মাচরণ এবং বিয়ের অধিকার ভারতীয় সংবিধানে একেবারে গোড়ার কথা ছিল!