Hathras Gangrape

কী জ্বলিতেছে

আইনশৃঙ্খলার অবনতির এই দায় ব্যক্তি আদিত্যনাথের বটে— নারী-বিষয়ক তাঁহার যে মতামত সম্প্রতি ফের জনসমক্ষে আসিয়াছে, তাহা খাপ পঞ্চায়েতের প্রধানদের লজ্জা দিবে— কিন্তু, দায়টি একা আদিত্যনাথের নহে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জলহাওয়া এই বিশেষ অপরাধপ্রবণতার পক্ষে অনুকূল।

Advertisement
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২০ ০১:২০
Share:

পুলিশ তড়িঘড়ি দাহ করে দিয়েছিল কি প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে?

ইয়ে ক্যা জ্বল রহা হ্যায়?’ গভীর রাত্রের অন্ধকার ভেদ করিয়া জ্বলন্ত অগ্নিশিখাটির সম্মুখে একাকী সাংবাদিকের এই প্রশ্নটি ভারতীয় গণতন্ত্রকে তাড়া করিয়া ফিরিবে। হাথরসের সেই মাঠে কী জ্বলিতেছিল? শুধুই এক ধর্ষিতা কিশোরীর দেহ, যাঁহার শেষকৃত্যের অধিকারটুকু হইতেও বঞ্চিত হইল পরিবার? না। জ্বলিতেছিল এক দরিদ্র, দলিত, নারীর দেহ— যাঁহার এই তিনটি পরিচিতির প্রতিটিই তাঁহার মৃত্যুর কারণ হইতে পারে। আশ্চর্য নহে, দেশে দলিতদের বিরুদ্ধে অপরাধের নিরিখে প্রথম স্থানে আছে উত্তরপ্রদেশ। নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের নিরিখেও। এবং, তাহা নিছক জলহাওয়ার দোষে নহে। যোগী আদিত্যনাথের রাজত্বে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের ঠিক দিকে থাকিতে পারিলে সাত খুন মাফ। উন্নাওয়ের নাবালিকা ধর্ষণের ভয়াবহ স্মৃতি তাহার সাক্ষ্য দিবে। হাথরসের এই দলিত মেয়েটিকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ যাহাদের বিরুদ্ধে, তাহারা উচ্চবর্ণের পুরুষ। ধনী। ফলে, তাহাদের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বেই হরেক অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাহাদের ধরে নাই, প্রশাসন তাহাদের নিয়ন্ত্রণ করে নাই। বিধ্বস্ত মেয়েটির জন্য যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতেও গড়িমসি করিয়াছে প্রশাসন। এবং, যে ভঙ্গিতে নিহত মেয়েটির মৃতদেহ রাত্রের অন্ধকারে, পরিবারের অসম্মতিতে, জ্বালাইয়া দেওয়া হইল, তাহাতে প্রমাণ লোপ করিবার পুলিশি তাগিদ বড় স্পষ্ট। কয়েক মাস পূর্বে বিকাশ দুবের এনকাউন্টারেও প্রমাণ লোপের চেষ্টা প্রকট ছিল। যেখানে রাষ্ট্র সর্বশক্তিতে অপরাধীকে আড়াল করিতে চাহে, সেই রাজ্য যে অপরাধের শীর্ষেই থাকিবে, তাহাতে সংশয় কী? ঘটনাক্রমে, এনকাউন্টারে মৃত্যুর হিসাবেও উত্তরপ্রদেশই দেশে সর্বাগ্রগণ্য।

Advertisement

আইনশৃঙ্খলার অবনতির এই দায় ব্যক্তি আদিত্যনাথের বটে— নারী-বিষয়ক তাঁহার যে মতামত সম্প্রতি ফের জনসমক্ষে আসিয়াছে, তাহা খাপ পঞ্চায়েতের প্রধানদের লজ্জা দিবে— কিন্তু, দায়টি একা আদিত্যনাথের নহে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জলহাওয়া এই বিশেষ অপরাধপ্রবণতার পক্ষে অনুকূল। নারীর প্রতি অসম্মান, দলিত বা মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা, দরিদ্রের প্রতি অবজ্ঞা, এবং এক ভয়ঙ্কর বিষধর পৌরুষের আরাধনা— সবই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অপরিহার্য অঙ্গ। এক দিকে প্রশাসনিক প্রশ্রয়ের ফলে এই ভয়াবহ মনস্তত্ত্ব সমানেই প্রসারিত ও শক্তিশালী হইতেছে, আর অন্য দিকে, এই মানসিকতাই হিন্দুরাষ্ট্রের ভিতটিকে মজবুত করিতেছে। যে ভাবে জামিনে মুক্ত ধর্ষকদের লইয়া বিজয়মিছিলে পথে নামেন রাজনৈতিক নেতারা, যে ভাবে সামান্যতম অজুহাতেও দলিত মানুষের উপর সর্বশক্তিতে ঝাঁপাইয়া পড়ে উচ্চবর্ণের পুরুষ, যে ভাবে একের পর এক মুসলমান-নিধনের ঘটনা বিনা বিচারে স্বাভাবিকতায় পর্যবসিত হয়, সেগুলি একাদিক্রমে এই উগ্রতাবাদী রাষ্ট্রের উপাদান ও ফসল। হাথরসের নিহত কিশোরী এই মিথোজীবিতার ভয়ঙ্কর রূপের শিকার। প্রকৃত প্রস্তাবে সে রাজনীতির হাতে লাঞ্ছিত।

এই কারণেই হাথরসের এই নৃশংস ঘটনাক্রম শুধুমাত্র একটি মেয়ের উপর পুরুষের আক্রমণ নহে, দরিদ্রের উপর ধনীর নির্যাতন নহে, দলিতের উপর উচ্চবর্ণের চড়াও হওয়া নহে— ইহা একটি রাষ্ট্রীয় অপরাধ। এবং, প্রশ্নটি শুধু আইনশৃঙ্খলার নহে, তাহা আদ্যন্ত রাজনৈতিক প্রশ্ন। উত্তরপ্রদেশ তো বটেই, দেশের বিপুল অংশে যে হিন্দু উচ্চবর্ণের পুরুষ ব্যতীত আর সকলে এই আশ্চর্য বিপন্নতায় বাঁচিতে বাধ্য হইতেছেন, তাহার দায় হিন্দুত্ববাদী নেতাদের লইতে হইবে বইকি। প্রধানমন্ত্রী এখনও এই বিষয়ে প্রকাশ্য মন্তব্য করিবার অবকাশ পান পাই— পাইবেন, তেমন ভরসাও পূর্ব অভিজ্ঞতা দেয় না। তিনিও নিশ্চয় জানিবেন, হাথরসে রাত্রের অন্ধকারে যাহা পুড়িতেছিল, তাহার নাম সুশাসনের আশা। ভারতের দিকে দিকে উগ্রতার অন্ধকারে সেই বহ্নিশিখা দৃশ্যমান।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement